দুনিয়াদারির
খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন যে একজন ইংরেজ বা জাপানি দিনে গড়পড়তা যত মাছ
খায় বাঙালিরা তার সামান্য অংশও খায় না বা খেতে পায় না। এই হিসেব শুনে আমরা
যদি বলি যে বাংলাদেশের অর্ধেক স্ত্রী পুরুষ তো নানান কারণে আমিষ খায় না
তাহলেও অঙ্কটার খুব হেরফের হবে না। কারণটা খুব সোজা --আমাদের দারিদ্র। যে
কোন ধনী জাতির তুলনায় আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয়, বিদ্যুৎ খরচ বা ইস্পাতের
ব্যবহার ইত্যাদি যদি ধরা যায় তা হলে সঙ্গতির দিক থেকে আমরা যে কোন অতলে
তলিয়ে রয়েছি তা বেশ বোঝা যাবে। এ ছাড়াও বাঙালিদের সংখ্যার তুলনায় মাছের
সরবরাহের পরিমাণেরও ব্যাপার আছে। এই সেদিন একটা ফিল্মে দেখছিলাম জাপানি
জেলেরা অত্যাধুনিক সার সার ট্রলার নিয়ে কিভাবে জাল টেনে জলপ্রপাতের তোড়ের
মতন ট্রলারের গলুইয়ে মাছ ভরছে। দেখে ভয় হচ্ছিল এ ভাবে মাছ ধরলে হয়ত
সুমুদ্দুর শিগ্গিরি ফুরিয়ে যাবে।
এটা ঠিক যে এককালে বাংলায় মাছের এরকম
দুর্দশা ছিল না। সে যাই হোক পরিমাণ দিয়ে তো আর দুনিয়ার সব জিনিসের মাপ বা
ওজন ঠিক ভাবে ঠাওর করা যায় না। যেমন পরমাণুর ভেতরকার শক্তি বা বাঙালির
মাছপ্রীতি। সত্যিকারের কৃঞ্চভক্তর যেমন ‘ক’ শুনলেই শরীরে রোমাঞ্চ হয় তেমনি
মাছের নাম শুনলেই বাঙালির ‘ঠাকুরমার ঝুলির’ সেই রাক্ষুসীর মতন জিভ লক্লক্
আর নোলা সক্সক্ করে। আর জ্যান্ত বাঙালি বা কেন বাঙালি-ভূতদের পক্ষেও কথাটা
খাঁটি।
মাছ নিয়ে নানা জাতের নানান প্রবাদ আছে। কিন্তু বাঙালিরাই বলতে
পারে যে ‘মাছের নামে গাছেও হাঁ করে।’ আষাঢ়ের প্রথম দিবসে বিরহী যক্ষ যখন
পূর্ব মেঘকে উদ্দেশ করে তাকে রামগিরি থেকে অলকায় তার প্রিয়ার কাছে
কুশলবার্তা নিয়ে যেতে বলে তখন কালিদাস যা বলেছিলেন বাংলায় তার মর্মার্থ হল ঃ
‘কামান্ধ এমনি অন্ধ অচেতনে সচেতন মানে।’ তাই উপরোক্ত বাংলা প্রবাদটি শুনলে
কালিদাসের মতন বলতে ইচ্ছে করে যে বাঙালি ‘মৎস্যান্ধ এমনি অন্ধ সচেতনে
সচেতন মানে।’ আর একটা কথা। আমি অন্তত অবাক হতাম না যদি ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী
পাটনী (কে তিনি ছিলেন নারী না পুরুষ?) অন্নদার কাছে বর চাইতেন যে
‘দুধেভাতে’ নয় ‘আমার সন্তান যেন থাকে মাছেভাতে’। এই কথা শুনে অনেকে হয়ত হাঁ
হাঁ করে উঠে বলবেন ঃ ‘আরে এ আবার কি কথা। ঈশ্বরী পাটনী ‘দুধেভাতে’
বলেছিলেন কারণ তা প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, আর শান্তির প্রতীক।’ এর জবাবে আমি
বলবো মাছ ভাত এ সব ছাড়াও বাঙালি জীবনেরও প্রতীক। আরও একটা কথা। সন্তান বলতে
কন্যাও বোঝায়। তাই মাছে ‘ ভাতে বললে মেয়ের বৈধব্য যাতে না হয় তারও কামনা
থেকে যায়।
বাঙালি টাকার কুমীর বা জামাইষষ্ঠীর দিনে দু-চারজন ভাগ্যবান
নতুন জামাই, আর শোনা যায় যাত্রার দলের হিরোরা ছাড়া রুই মাছের মুড়ো বা রুই
মাছ খাওয়া এখন সাধারণ বাঙালির কাছে স্বপ্ন হয়ে গেছে। তবুও এই আগুন দামের
দিনে থলে হাতে মাছের বাজারে লোকের ভিড় দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এর কারণ
গৃহস্ত এমনকি গরীব বাঙালিদের সরু এক ফালি মাছ টাক্না না দিলে বা চুনোপুঁটির
গন্ধ না পেলে মুখে ভাত রোচে না। আবার একটা প্রবাদের কথা মনে পড়ছে ঃ
জোলা মরে তাঁতে।
বাঙালি কাঙালি মরে মাছে আর ভাতে।।
মাছ ছাড়া বাঙালির জীবন ভাবা যায় না যেমন কালো ছাড়া কাক, সাদা ছাড়া বরফ ভাবা যায় না।
বাঙালির
ঘরে ঘরে প্রচলিত মাছ নিয়েও ছড়া অজস্র। এখানে তার মধ্যে দু-একটা তুলে
দিচ্ছি। যেমন ‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে’ ছড়ার শেষের দিকে আছে ঃ
ত্রিপুর্ণির ঘাটে দুটো মাছ ভেসেছে
একটি নিলেন গুরুঠাকুর একটি নিলেন কে
তার বোনকে বিয়ে করি ওড়ফুল দিয়ে
কিংবা
খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে
ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে মাছ নিয়ে গেল চিলে।
অনেক
বছর আগে বাংলার ইতিহাসের আদি যুগে জীমূতবাহন ইলিশ আর ইলিশের তেলের নানান
গুণের কথা বলে গিয়েছিলেন। সে যাই হক ঘটি আর বাঙাল মাছরান্নার চিরকেলে আর
অমীমাংসিত লড়াইয়ের মধ্যে না গিয়ে দুই বাংলার মাছ রান্নার বৈচিত্র্য আর
সম্ভারের উপরোক্ত কথা পড়লে তাক লেগে যায়। সব কথা বাদ দিয়ে বলা যায় যে
রান্নার আসল উদ্দেশ্য হল ‘রাঁধা’ জিনিসের স্বাভাবিক স্বাদ-গন্ধ-রস এমনকি
চেহারা সুদৃশ্যভাবে বজায় রেখে অন্যান্য নানান-জিনিস। আর পরিমাণ মত মশলাপাতি
দিয়ে স্বাভাবিক স্বাদ-গন্ধ-রসকে আরও বাড়িয়ে সুখাদ্যে পরিণত করা। এই দিক
দিয়ে দেখলে পাঁচশ বছর আগের এই সব রান্নার কায়দার জবাব নেই। আর এটাও ঠিক যে
এই ‘রান্না-শিল্প’ দুম করে একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে বাঙালিদের শ শ
বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। বিজয় গুপ্তের কলতার আগা আর
রুই মাছের রাজযোটক বা কটু তেলে খরশোলা মাছ ভাজা কিংবা মুকুন্দরামের ‘রুহিতে
কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল বা মরিচ গুঁড়ো আর আদর রস দিয়ে কই রান্নার পেছনে
যুগ যুগের সাধনা রয়েছে।
আহামদ শরিফ বলেছিলেন যে বাংলায় বৈঞ্চবধর্মের
প্লাবনের পর কিছু কিছু বিশেষ করে উঁচু জাতের বাঙালির বাড়ির হেঁশেলের
মশলা-পেষা শিল-নোড়ায় চন্দন ঘষা শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে
ব্রাক্ষ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন প্রভাব যেমন বাঙালিকে তার আমিষ প্রীতির থেকে নড়াতে
পারেনি বৈঞ্চব প্রভাবের পক্ষেও সেই কথা খাটে। তাছাড়া তথাকথিত বহু বৈঞ্চবই
চিতল মাছের ঝোল আর যুবতীর কোলের লোভ সামলাতে পারেনি।
এক বৈঞ্চবোত্তর
আঠার শতাব্দীর ‘অন্নদামঙ্গলে’ মাছ রান্নার বর্ণনা আছে। তবে আমি এখানে সে
ব্যাপারে না ঢুকে কাব্যটির থেকে বাংলাদেশের মাছের রকমারিত্বের একটি বর্ণনা
দিয়ে মঙ্গলকাব্য আর মাছ প্রসঙ্গ শেষ করি। এই কাব্যের ‘অন্নপূর্ণার পুরী
নির্মাণ পরিচ্ছেদে এই অবাক-করা ফিরিস্তি রয়েছে ঃ
‘চিতল ভেকুট রুই কাতল মৃগল
বানি লাঠা গড়ই উল্কা শউল শাল।
পাঁকাল খয়রা চেলা তেচক্ষা এলেঙ্গা
গুঁতিয়া ভাঙন রাগি ভোলা ভোলচেঙ্গা।।
মাগুড় গাগড় আরি বাটা বাচা কই।
কালবসু বাঁশপাতা শঙ্কর ফলুই।।
শিঙ্গি ময়া পাবদা বোয়ালি ডানিকোণা।
চিংড়ি ট্যাংরা পুঁটি চান্দা গুড়া লোনা।।
গাঙ্গদারা ভেঙ্গা চেঙ্গ কুড়িশা খলিশা
খরশুলা তপসীয়া পাঙ্গাশ ইলিশা।
এরপর
উনিশ শতাব্দীতে আমি যাঁর কথায় আসছি তাঁর মতন খাদ্যরসিক কবি বিজয় গুপ্ত,
মুকুন্দরাম বা ভারতচন্দ্রের পর বাঙালিদের মধ্যে আর কেউ জন্মাননি। আমি
বাংলাভাষার পোয়েট অফ গ্যাসট্রোনমি ঈশ্বর গুপ্তর কথা বলছি। ছোট মুখে বড় কথার
মতন শোনালেও বলি যে গুপ্ত কবির পদ্যর খাদ্যরসের দিকটা নিয়ে স্বয়ং
বঙ্কিমচন্দ্র আহ্লাদে আটখানা হলেও কাজী আবদুল ওদুধের কথায় ‘বাংলার
ডাক্তাররা’ এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। তাঁর ‘পাঁচী’, ‘তপসী মাছ’
হেমন্তে বিবিধ খাদ্যে কবিতাগুলিতে খাবারদাবার নিয়ে তিনি যেরকম স্ফূর্তি এবং
আনন্দ আর মজা করে আর বগল বাজিয়ে লিখে গেছেন তার ধারে-কাছে পরে কোন বাঙালি
রন্ধন বিশেষজ্ঞ পৌঁছতে পারেনি। তবে এখানে বলা দরকার যে মাছ না হলেও দই
মন্ডা, সন্দেশ ক্ষীর পানতুয়া ইত্যাদি নানা রকমের বাঙালির প্রিয় মিষ্টি নিয়ে
একালে ডি এল রায়, রজনীকান্ত সেন, নজরুল ইত্যাদি অনেকেই হাসির গান লিখেছেন।
ঈশ্বর
গুপ্তর ‘পদ্য’ পড়ার আজকাল খুব ফ্যাসান নেই। তা ছাড়া তাঁর লেখাও বেশ
কিছুকাল ধরে দুষ্প্রাপ্য। তাই আমি এখানে বাঙালির মাছ-প্রীতির এক চরম প্রতীক
হিসেবে তাঁর মাছের রচনাগুলি থেকে একটু বেশি করেই উদ্বৃতি দেবো। আশা করি
তাতে আজকালকার বাঙালি পাঠক-পাঠিকা একটু মুখ বদলে নিতে পারেন।
প্রথমে
তপসী মাছ। যে মাছ খেয়ে বহু বিশ্বনন্দুক সাহেবরাও ম্যাঙ্গো ফিস বলতে অজ্ঞান
ছিলেন। একজন সাহেব লিখেছিলেন যে বাংলাদেশে এসে তিনি টাকা করতে পারেননি,
রোদে পুড়ে জলে ভিজে শরীর শেষ হয়ে গিয়েছে, তার মনও ছিন্ন-ভিন্ন তবুও তিনি
শান্তি পান যখন তিনি ভাবেন যে এখানে এসে তিনি ‘ম্যাঙ্গো ফিস’ খেয়েছেন।
গুপ্তকবির ভাষায় সাহেবরা ঃ
বাঙালির মত তারা রন্ধন না জানে
আধসিদ্ধ করে শুধু টেবিলতে আনে
মশলার গন্ধ গায় কিছুমাত্র নাই
অঙ্গে করে আলিঙ্গন কমলিনী রাই।।
ঈশ্বর গুপ্ত তপসে মাছকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন ঃ
কষিত কনককান্তি কমনীয় কায়
গালভরা গোঁপ দাড়ী তপস্বীর প্রায়।।
তারপর যা বলেছেন তার থেকে কিছু কিছু লাইন বাদ দিয়ে তুলে দিচ্ছি ঃ
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার
আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার।।
না করে তোমারে যেই উদরে গ্রহণ
বৃথাই জীবন তার বৃথাই জীবন
জলধি করেছে তার কত উপকার
লুণ খেয়ে, গুণ গেয়ে কাছে থাক তার
ক্ষীরোদমথন কালে অপূর্ব্ব ঘটন
দেবাসুরে ঘোর দ্বন্দ্ব সুধার কারণ।।
সে সময়ে তুমি মীন অতি কুতুহলে
খেয়েছিলে সেই জর তপস্যার ফলে।।
অমৃত ভক্ষণে তাই এরূপ প্রকা
সুমধুর আস্বাদন হয়েছে তোমার।।
এ মত অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে
সাহেবেরা সুখে তাই ম্যাংগো ফিস বলে।।
ঈশ্বরগুপ্ত এই কবিতার আর এক জায়গায় লিখেছেন যে
‘কুড়ি দরে কিনে লই, দেখে তাজা তাজা।
টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকা তেলে ভাজা।।
কবি
কোথা থেকে কুড়ি দরে তপসে কিনতেন জানি না। তবে আজ একশ বছরের ওপর ধরে বাড়ির
মেয়েরা যখন সন্ধ্যেবেলায় উনুনে আঁচ দিবেন তখন তপসের মরসুমের সময় হাঁক শোনা
যেত “চাই তপসে মাছ।” জানি না পুরান ঢাকায় আজও এই বড় মিষ্টি, বড় সাহেব ডাক
শোনা যায় কি না।
এইবার ঈশ্বর গুপ্তর বিশাল কবিতা হেমন্তে বিবিধ খাদ্য
থেকে শীতকালের সবরকম খাদ্যের জিভে-জল-আনা রসে টইটম্বুর কথা বাদ দিয়ে কিছু
মৎস-বন্দনায় আসছি। যদিও এখানে বলা দরকার যে অনেক আনাজের সঙ্গে ঠিক মাছগুলির
মণিকাঞ্চন সংযোগের কথাও এর ফলে বাদ যাবে।
প্রথম গলদা চিংড়ির কিছু কিছু
জলের ভিতরে মাছ কত রস ভরা
দাঁড়ী গোপ জটাধারী জামা জোড়া পরা।।
বিশেষত শীতকালে অমৃতের খনি
আমিষের সভাপতি মীন শিরোমণি।।
গলদা চিংড়ী মাছ নাম যার মোচা
পড়েছে চরণতলে এলাইয়া কোঁচা।।
কালিয়ে পোলাও রাঁধো রাঁধো লাউ দিয়া
ভাতে খাও ভেজে খাও হবে মুখপ্রিয়া।।
এক ক’ লাইনে সংক্ষেপে চিংড়িমাছের বেশ কিছু রান্নার বর্ণনা আছে মালাইকারি ছাড়া।
যদিও ১৮৮৬ সালে প্রথম ছাপা বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাক প্রণালীতে এর উল্লেখ রয়েছে। এর কারণ বোধহয় এই রান্নাটা তখন ওঠেনি।
এখানে
একটা ছোট টিপ্পনী দিতে চাই। ডাঃ নূরুল ইসলাম একবার বলেছিলেন যদি কেউ ভাতের
সঙ্গে রোজ একবাটি মাছের ঝোল খায় তার অন্যকিছু খাবার দরকার হয় না। তারপর
আফসোস করছিলেন যে আগেকার দিনের মা-খালা বা দাদী-নানীর মতন মাছের ঝোল এখন আর
কেই বা রাঁধতে পারেন।
রুই মাছের পর গুপ্ত কবি কৈ-মাছের কথা যা লিখেছেন তার থেকে মাগুর সম্বন্ধে দু-চার ছত্র শুনুন ঃ
এমন মধুর মাছ নাহি হয় আর
রোগী ভোগী উভয়েরই সম উপকার।।
যুবকের কত সুখ যুবতীর কোলে
কত বা অমৃত আছে বালকের বোলে?
কত বা আমোদ হয় পুর্ণিমার দোলে
সকল আমোদ এই মাগুরের ঝোলে।।
বুদ্ধদেব
বসু তাঁর বাংলা খাবার নিয়ে লেখায় বলেছেন যে যোগাযোগে মধুসূদন টাকা করে
রুপোর বাসনে খেলেও মোটা চালের ভাত, মাছ আর সাধারণ তরকারি না হলে তাঁর মুখে
রুচত না। রবীন্দ্রনাথের কথা শেষ করার আগে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’র সেই ঘটনার কথা
বলি। কবি তাঁর শিক্ষক সাতকড়ি দত্ত সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে “তিনি আমাকে
উৎসাহ দিবার জন্য মাঝে মাঝে দুই এক পদ কবিতা দিয়া, তাহা পূরণ করিয়া আনিতে
বলিতেন। তাহার মধ্যে একটা মনে আছে ঃ
রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।
কবি এই ভাবে তার পাদপুরণ করেন ঃ
মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে
খন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।
ভাবতে
ভাল লাগে যে শিশু রবি তাঁর কবিতা লেখার একটি সর্বপ্রথম প্রচেষ্টায় প্রথম
যে কথাটি ব্যবহার করে তা হল মীন। এই সুন্দর শ্রীমন্ডিত কথাটির চেয়ে তাঁর
কাব্য রচনার কি ভাল সূচনা ভাবা যেতে পারে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ একজন
মুষ্টিমেয় বাঙালি শিল্পী যিনি কাগজে আর এমনকি চামড়ার ওপর মাছের অনবদ্য ছবি
এঁকেছেন।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ইলশে গুঁড়ি কবিতা ছাড়া তিনি তাঁর ‘দূরের
পাল্লা’ কবিতায় একটি জেলেদের নিয়ে এই অপূর্ব লাইনটি লিখেছিলেন যা কিছু
পুরনো চীনে বা জাপানী ছবির কথা মনে করিয়ে দেয় ঃ ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে,
ফিরছে কারা মাছের আশে।
বাঙালি পাঠকদের কাছে মাছ আর জেলে জীবন নিয়ে লেখা
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি
নদীর নাম’ বা সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’র নাম করার দরকার নেই। এখানে আমি
‘পদ্মানদীর মাঝি’ থেকে ছোট একটি উদ্বৃতি দিতে চাই শেষ রাত্রে ভাঙা-ভাঙা
মেঘে-ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না। নৌকার
খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লন্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক
করে, নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতন দেখায়।’
শরৎচন্দ্রর কথা
আমি সবচেয়ে শেষে বলছি। ‘শ্রীকান্তর নৈশ অভিযান’ বা ‘দত্তায়’ নরেন্দ্রর ছিপে
মাছ ধরা ছাড়া বিশেষ করে তাঁর ‘রামের সুমতি’র সেই কার্তিক-গণেশের কথা বলতে
চাই। দিগম্বরীর শয়তানি আর নারায়ণীর অসাবধানতায় ভগা জেলে যখন গণেশকে খেপলা
জালে ধরে ফেলে তখন সেটা রামের প্রাণস্বরূপ এই মাছটির জন্যে সেই দামলা
বালকের শোকে ‘মহেশ’ গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এ সবই তো না হয় হল। সত্যি কথা বলতে কি পুরো আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কথা ধরলে তাতে মাছের কথা ছিটে-ফোঁটারই শামিল।
বহুদিন আগে ‘মাছ আর বাঙালি’ শীর্ষক একটি ছড়ায় আমি লিখেছিলাম-
কবীর চৌধুরী বসে ছিলেন বিষাদ ভরা মনে
কী হয়েছে কবীর চৌধুরী? শুধাই গোপনে
বলেন তিনি, সামনে দেখি মাছের আকাল
মাছের খোজে বাঙালি লোক হবে যে নাকাল
হাওয়াই জাহাজ চড়ে মাছ যে হবে হাওয়া
রুই কাতলা ইলিশ মাগুর আর যাবে না খাওয়া
এই কথাটা শুনেছিলাম বিশ শতকের শেষে
এরোপ্নেনের যাত্রী হওয়া শুরু যখন দেশে
আমিও আজ বসে আছি বিষাদ ভরা মনে
গলদা বাগদা কিনে খাওয়া হবে না জীবনে
ধানের চাষের চেয়ে নাকি চিংড়ি চাষেই টাকা
জাহাজ ভঁরা চালান দেয় সিঙ্গাপুর আর ওসাকা।।
যাই
হোক, বাঙালির জীবনে মাছ খাওয়ার সুখের জন্য আজও নিরামিষের মতন বাংলার মাছ
রান্নার কায়দার রকমারিত্বর শেষ নেই। সুখের বিষয় দাদা-দাদী, মা-খালাদের কাছ
থেকে শেখা এইসব পাক-প্রণালী এখনও বর্ষীয়ান মহিলাদের দৌলতে টিকে আছে। তবে
কতদিন এসব রান্না বজায় থাকবে তা খোদাই জানেন। এর মধ্যেই বহু ঝকঝকে তকতকে
রান্নাঘর থেকে সেই চিরকোলে শিল-নোড়া, আঁশবটি আর আঁশ চুপড়ি বিদেয় নিয়েছে।