বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২
ইটন কলেজ এবং জর্জ অরওয়েল -
মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
প্রকাশ: বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫, ১২:৫৯ এএম আপডেট: ২৫.০৬.২০২৫ ১:৪১ এএম |

 ইটন কলেজ এবং জর্জ অরওয়েল -
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক জর্জ অরওয়েল। ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ এবং ‘১৯৮৪’ গ্রন্থের স্বপ্নদর্শী লেখক এবং প্রত্যক্ষদর্শী, নন-ফিকশন ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’, ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ এবং ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ গ্রন্থের স্রষ্টা। জর্জ অরওয়েলের জন্ম হয় এরিক আর্থার ব্লেয়ার নামে। ১৯০৩ সালের ২৫ জুন পূর্ব ভারতের মোতিহারিতে (তখন বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত)। তার পিতা ছিলেন একজন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারি কর্মচারী। পরবর্তীতে অরওয়েল ইংল্যান্ডে শিক্ষা লাভ করেন এবং ইটন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ বার্মায় ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। ১৯২৭ সালে তিনি ইম্পেরিয়ল পুলিশ থেকে পদত্যাগ করেন এবং একজন লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অরওয়েল এর পরিবার অক্সফোর্ডশায়ারের শিপলেকে চলে যায়। সেখানে এরিক বুডিকম-এর পরিবার ও বিশেষ করে তাদের মেয়ে জেকিন্থার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাদের প্রথম সাক্ষাতের ক্ষণে তিনি একটি মাঠে মাথার উপর ভর দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। উল্টো হয়ে কেন জানতে চাইলে তিনি জেকিন্থাকে বলেন, ‘সঠিক স্বাভাবিক অবস্থার চাইতে উল্টো হয়ে মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ালে অন্যদেরকে বেশি লক্ষ্য করা যায়।’  

অরওয়েল ১৯১৭ সালের মে মাসে ইটনে 'কিংস স্কলার' হিসাবে স্থান পান। এ সময় তাদের পরিবার নটিংহিল গেটের মল চেম্বার্সে বসবাস করত। তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ইটন কলেজে ছিলেন। বয়সটি তখন তার ১৮ এবং ১৯ এর মাঝামাঝি। তার প্রধান শিক্ষক ছিলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ ফেলো এএসএফ গো।  অ্যান্ড্রু সিডেনহ্যাম ফারার গো একজন ডাকসাইটে ইংরেজি শাস্ত্রীয় পণ্ডিত ও শিক্ষক। ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ইটন কলেজে মাস্টার হিসেবে এগারো বছর ছাড়াও কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তার কর্মজীবন সম্পূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে। অরওয়েলের ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়েও তিনি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। 
 ইটন কলেজ এবং জর্জ অরওয়েল -
ইটন কলেজে জর্জ অরওয়েলের শিক্ষাজীবনের বছরগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যগুলি সুপরিচিত। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে জানি না যে তিনি কোন ইটোনীয় মূল্যবোধ বজায় রেখেছিলেন এবং স্কুলটি তার পরবর্তী জীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল। বিংশ শতাব্দীর লেখকদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অরওয়েল স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন: “আমি ইটনে শিক্ষালাভ করেছি ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর‌্যন্ত। কারণ আমি বৃত্তি জেতার জন্য যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিলাম, কিন্তু আমি সেখানে কোন কাজ করিনি এবং খুব কম শিখেছি। এবং আমি অনুভব করি না যে ইটন আমার জীবনে অনেকটাই গঠনমূলক প্রভাব ফেলেছে।” জর্জ অরওয়েলের এই বিবৃতি বিভ্রান্তিকর। বিশুদ্ধ ভাগ্যের দ্বারা নয়, বিপুল পরিশ্রমে তিনি বৃত্তি লাভ করেন। যদিও তিনি জোরপূর্বক এর প্রভাব অস্বীকার করেন, তিনি ইটনে অধ্যাবসায়ী হন এবং চমৎকার শিক্ষা লাভ করেন। সর্বোপরি, তিনি কীভাবে লিখতে হয় এবং নিজের মতো করে ভাবনা-চিন্তা করতে হয় তা শিখেছিলেন।
ইনসাইড দ্য হোয়েল" প্রবন্ধে অরওয়েল তার স্কুলজীবনের ও ইটন কলেজের অন্তরঙ্গ বন্ধু সিরিল কনোলিকে উদ্ধৃত করেন যিনি ‘এনিমিজ অব প্রমিজ’ গ্রন্থে বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কির স্থায়ী বিপ্লবের তত্ত্বের প্রতিধ্বনি করেছেন : “আমি যদি ইটন ছেড়ে যাওয়ার সময়ের আমার অনুভূতি থেকে কিছু অনুমান করতে পারতাম তাহলে সেটিকে স্থায়ী কৈশোরের তত্ত্ব বলা যেতে পারত। এটি এমনই এক তত্ত্ব যে বড় পাবলিক স্কুলে ছেলেদের অভিজ্ঞতাসমূহ তাদের জীবনকে আধিপত্য করা এবং তাদের বিকাশকে আটকাতে সক্ষম হওয়ার মতোই অত্যন্ত তীব্র”। অরওয়েল নিজেকে ইটন এবং এর মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করেছেন। তার প্রত্যাখ্যানের শক্তিই ইঙ্গিত করে যে তার শিক্ষার একটি স্থায়ী প্রভাব ছিল।
অরওয়েলের নিষ্ঠুর অথচ কার্যকর প্রিপ স্কুল সেন্ট সাইপ্রিয়ানস-এর মহান উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল ইটন এবং অন্যান্য মর্যাদাপূর্ণ পাবলিক স্কুলে স্কলারশিপ জেতার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করে তোলা। তিনি জমকালো একটি পুরস্কার জয়ী হন এবং ইটনে কিং’স স্কলার হন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়স থেকে প্রায় সাড়ে আঠারো বছর বয়স পর‌্যন্ত ইটন কলেজের ছাত্র ছিলেন। অভিজাত প্রতিষ্ঠানটির সংখ্যালঘু ৭০ জন মেধাবী বৃত্তিভোগী ছাত্র প্রাচীন কলেজ ভবনে বসবাস করতেন। অবশিষ্ট ৯৩০ জন ধনী, উচ্চ-শ্রেণীর ওপিডানরা (শহরবাসী) একেবারেই আলাদা ছিল। তাদের অনেকেরই ইটনের সাথে কয়েক প্রজন্মের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তারা সম্পূর্ণ ফি প্রদান করতেন এবং শিক্ষকদেরদের তত্ত্বাবধানে আলাদা ভাল ভবনে থাকতেন। এই পার্থক্য অরওয়েলকে শ্রেণীগত পার্থক্য সম্পর্কে একটি তীব্র সচেতনতা দিয়েছে যা তার ভবিষ্যতের সমস্ত কাজেই উল্লেখ পাওয়া যায়।
সেন্ট সাইপ্রিয়ানসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরে অরওয়েলের কাছে ইটনকে একটি সংস্কৃতিবান জায়গা বলে মনে হয়েছে। অরওয়েল প্রতিষ্ঠানটির ইতিবাচক দিকসমূহের প্রশংসা করেছেন এবং অনিচ্ছায় স্বীকার করেছেন যে তিনি সেখানে “অপেক্ষাকৃত খুশি” ছিলেন। ১৯৪৮ সালের রিভিউ অব ইটন মেডলিতে তিনি ইটনকে তার প্রিপ স্কুলের সাথে স্পষ্টভাবে প্রতিতুলনা করেন এবং স্বীকার করেন যে ইটনে "অসাধারণ ভবন এবং খেলার মাঠ রয়েছে এবং ...সুন্দর পরিবেশ। এর একটি মহান গুণও রয়েছে...একটি সহনশীল এবং সভ্য পরিবেশ যা প্রত্যেক ছাত্রকে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বিকাশের ন্যায্য সুযোগ দেয়। ...এর কিছু ঐতিহ্য মনে রাখার যোগ্য”। প্রিপ স্কুল যা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ইটন তাকে তা দিয়েছিল : স্বাধীনতা, অবসর, উদ্দীপক সহপাঠী, প্রাণবন্ত শিক্ষক, একটি আলোকিত পরিবেশ এবং তার নিজের একটি স্বতন্ত্র ছোটো শয়নকক্ষ।
তিনি স্মরণ করেছিলেন যে “ইটনে আপনার নিজের জন্য একটি কুঠুরি ছিল - এমন একটি ঘর যাতে এমনকি  আগুনও থাকতে পারে।...এবং আরো নিজস্বতা থাকবে।” এমনকি তিনি আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক বৈশিষ্টাবলীর একটি উৎকর্ষ তৈরি করেন। সেখানে “অধিক উপেক্ষা, নিষ্ক্রিয়তা, আত্মমগ্ন এবং অধঃপতিত হওয়ার আরও সুযোগ” থাকবে। 
ইটনে পড়ার সময় যুদ্ধকালীন সামরিক প্রশিক্ষণসমূহ পরবর্তীতে বার্মায়, স্পেনে এবং লন্ডন বিমানাক্রমণের সময় অরওয়েলকে অনেক সুবিধা দিয়েছিল। ইটনে অরওয়েলের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ ও বহুভাষাবিদ স্টিভেন রানসিম্যান। এ সময় ইংরেজ লেখক এবং দার্শনিক অ্যালডাস লিওনার্ড হাক্সলি তাদেরকে সংক্ষিপ্তাকারে ফরাসি ভাষা শেখান। রানসিম্যান উল্লেখ করেছেন যে তিনি এবং তাঁর সমসাময়িকরা হাক্সলির ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। অর্ধ-অন্ধ অ্যালডাস হাক্সলি অফরওয়েলকে ফরাসি ভাষা শিখিয়েছিলেন কিন্তু অত্যাবশ্যক ভাষা ব্যতিত গালিগালাজের ভাষা সেখানে অনুপস্থিত ছিল। শেষোক্ত ভাষা তিনি জাঁকজমকপূর্ণ প্যারিসের একটি হোটেলে ডিশওয়াশার হিসাবে কাজ করার সময় শিখে নিয়েছিলেন। গালিগালাজ রপ্ত করার সময়ে  “বিরল এবং অদ্ভুত শব্দাবলী ...এবং তাদের সঠিক ও উল্লেখযোগ্য ব্যবহার” অরওয়েলকে এক অভূতপূর্ব স্বাদ দিয়েছিল। অরওয়েল দাবি করেছেন যে একজন সহানুভূতিহীন শিক্ষকের সাথে ধ্রুপদী ভাষার ক্লান্তিকর অনুশীলনের কোনও ব্যবহারিক উপকার নেই : “আমি আট বা দশ বছর গ্রীক অধ্যয়ন করেছি এবং এখন তেত্রিশ বছর বয়সে আমি গ্রীক বর্ণমালার পুনরাবৃত্তিও করতে পারি না”। কিন্তু যখন তিনি আধুনিক ভাষা - ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং কাতালান - পাশাপাশি হিন্দি, বার্মিজ, শ-কারেন এবং কিছুটা উর্দু শিখেছিলেন তখন বিষয়টি একটি দুর্দান্ত অবলম্বন ছিল। তিনি পুলিশ পরীক্ষায়  গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষার জন্য সর্বোচ্চ গ্রেড অর্জন করেন।
ইটনে কিছু সময় কাটানোর পর অরওয়েল নিজ অক্ষমতার জন্য ক্রমশ সমালোচিত হয়ে ওঠেন। তিনি তার শ্রেণীর শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য একটি সুচতুর কৌশল অবরম্বন করেন: “একদিকে কিংস স্কলারশিপ আমার ভদ্রতাকে আগের চেয়ে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল; অন্যদিকে এটা আমাকে সেই ছেলেদের বিরুদ্ধে বিরক্তিতে ভরিয়ে দিল যাদের বাবা-মা আমার চেয়ে ধনী এবং যারা আমাকে সেটি জানাতে উন্মুখ। ...সঠিক এবং মার্জিত জিনিস, আমি অনুভব করেছি, কোমল জন্ম হতে হবে কিন্তু কোন টাকা নেই. এটি নিম্ন-উচ্চ-মধ্যবিত্তের বিশ্বাসের অংশ”।  উচ্চবিত্ত ঘরে জন্ম হয়নি এমন একটি ছেলেকে পরিণত করেছিল একটি জঘন্য-সুশীল বিদ্রোহীতে।
অরওয়েল ইটনের খাবার, নিষ্ঠুরতা এবং উন্নাসিকতার সমালোচক ছিলেন। ইটন কলেজ সেখানকার বড় ছাত্রদেরকে তাদের ক্ষোভ নিবৃত্তির যথেষ্ট সুযোগ দিত। স্কুল ছাড়ার কিছুদিন আগে একটি অসাধারণ অনুষ্ঠানের সময় ১৮ বছর বয়সী অরওয়েল একটি ছোটখাট ভুলের জন্য তার নিজের বয়সী একজন প্রিফেক্টের দ্বারা মারধরের শিকার হন। তিনি প্রার্থনার জন্য দেরীতে উঠেছিলেন। এটা পরিষ্কার নয় যে কেন চিরবিদ্রোহী এই ধরনের অপমানে সয়েছিলেন যদি না শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না।
লর্ডসে বার্ষিক ইটন-হ্যারো ক্রিকেট ম্যাচের প্রতি তার আজীবন আগ্রহ বজায় ছিল তবুও ওল্ড বয়েজদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের অনুমানকে নিন্দা করেছেন। তিনি বস্তুগত সম্পদ অপছন্দ করতেন, এবং কখনোই একটি দামী নৌকা, এমনকি একটি স্বল্প-ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ি বা নিকৃষ্ট দেশীয় কুটিরের মালিকানা বা মালিক হতে চাননি। এনিম্যাল ফার্ম এবং নাইনটিন এইট্টি-ফোরের সফল প্রকাশনার পরে এবং তার দুঃখজনক মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “আমি এই সমস্ত অর্থ উপার্জন করেছি এবং এখন আমি মরতে যাচ্ছি।”
ইংরেজ সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যও অরওয়েল ইটনকে দায়ী করেন। “দ্য লায়ন অ্যান্ড দ্য ইউনিকর্ন” রচনায় তিনি ডিউক অব ওয়েলিংটনের বিখ্যাত এপিগ্রামের সমালোচনা করেন এবং যুক্তি দিয়ে বলেন, “সম্ভবত ওয়াটারলু যুদ্ধটি ইটনের খেলার মাঠে জিতেছিল কিন্তু পরবর্তী সমস্ত যুদ্ধের প্রারম্ভিক যুদ্ধগুলি সেখানে হারিয়ে গেছে। গত এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে ইংরেজদের জীবনের একটি প্রভাবশালী ঘটনা হল শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার ক্ষয়”। তিনি উচ্চ-শ্রেণীর বামপন্থীদেরও সমানভাবে নিন্দা করেছেন।
তার নায়ক চার্লস ডিকেন্সের বড় ছেলেকে ইটনে পড়তে পাঠিয়েছিলেন জেনে অরওয়েল বরং হতবাক হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে কমিউনিস্ট জন স্ট্র্যাচি তাঁর সবেমাত্র একটি ছেলেকে ইটনে পড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছে শুনে অরওয়েল অতিশয় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অরওয়েল তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কীভাবে এটি করতে পারলেন?” জন স্ট্র্যাচি উত্তর দেন, “আমাদের বিদ্যমান সমাজের বিবেচনায় ইটনের শিক্ষাই সর্বোত্তম”। একধরনের আপস হিশেবে অরওয়েল তাঁর নিজের ছেলে রিচার্ডকে লন্ডনের একটি গ্র্যান্ড পাবলিক স্কুল ওয়েস্টমিনস্টারে ডে-বয় হিসাবে পাঠান। তিনি শুনে খুশি হয়েছিলেন যে, ছাত্রদের আর আগের মতো অযৌক্তিক শিরস্ত্রান পরতে হয় না।
অরওয়েল ইটনের মূল্যবোধ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি তাঁর ছাত্রজীবনকে আর দীর্ঘায়িত করতে চাননি এবং নিজেকে “উন্নাসিকতার উষ্ণ স্নানে” ডুবিয়ে রাখতে চাননি। তিনি সমকামিতা বিষয়ে প্রচণ্ড সংস্কারগ্রস্ত ছিলেন তাই “ন্যাকা স্বভাবের ছেলেদের” প্রতি বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাতেন। সিরিল কনোলি রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম হল “দ্য রক পুল”। সেই উপন্যাসের যুক্তিযুক্তভাবে পর্যালোচনা করে তিনি তাঁর নিজের জগত এবং তাঁর বন্ধুর ক্ষয়িষ্ণু জগতের মধ্যকার নৈতিক খাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন: “এমনকি তথাকথিত শিল্পীদের সম্পর্কে লিখতে চাই যারা আধ্যাত্মিক অপ্রতুলতার কারণে পায়ুকামিতাকে অবলম্বন করে জীবন ধারণ করছে।” অরওয়েল অক্সব্রিজের পরিবর্তে একজন দায়িত্বশীল প্রাপ্তবয়স্ক হতে চেয়েছিলেন, তাই কিশোর বয়সেই একজন ঔপনিবেশিক পুলিশ কর্মকর্তার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইউনিফর্ম, অর্থ, বিপদ, দুঃসাহসিকতা, কর্তৃত্ব এবং একটি আধা-সামরিক পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন।
ইটনের ফ্যাগিং প্রথার বদৌলতে সিনিয়রদের আদেশ মেনে অল্পবয়সী ছেলেদের দিয়ে ছোটখাটো কাজ করানোর পাশাপাশি সাজা হিশেবে চাবকানি প্রভৃতির সাথে অরওয়েলের পরিচয় ঘটেছিল। দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে ব্রিটেনের কতিপয় শতাব্দীপ্রাচীন পাবলিক স্কুল ও বোর্ডিং স্কুলে এই অনুশীলন চলেছে। বয়সে বড় আবাসিক ছাত্রদের জুতো পরিষ্কার করা, জামাকাপড় কাচা, জলখাবার তৈরি করার মতো কাজ করতে হত কমবয়সিদের। এর পোশাকি নাম ছিল ফ্যাগিং। যাদের খাটানো হত, তাদের বলা হত ‘ফ্যাগ’। কাজ করতে না চাইলে জুটত শারীরিক নিগ্রহ বা যৌন হেনস্থার মতো কড়া শাস্তি। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডের সেন্ট পলস স্কুল, ইটন কলেজ ও উইনচেস্টার কলেজ এগিয়ে ছিল ফ্যাগিং প্রতিষ্ঠান হিসাবে। বিশিষ্ট রোমান্টিক কবি পার্সি বিশে শেলী ইটন কলেজে তাঁর প্রিফেক্টের ফ্যাগ হতে অস্বীকার করায় চরম হেনস্থার শিকার হন। ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর তথা আচার্য স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে একুশ বছরের এক তরুণী বিপ্লবী বীণা দাস।  ইতিহাসের একটি সূত্র বলে, খোঁপায় রিভলভার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন ২১ বছরের বীণা। সেই স্ট্যানলি জ্যাকসন পড়তেন গ্রেটার লন্ডনের হ্যারো স্কুলে। তাঁর ফ্যাগ ছিলেন চার বছরের ছোট উইনস্টন চার্চিল। এই হ্যারো স্কুলেই পড়তেন অভিনেতা সাইমন উইলিয়ামস। ফ্যাগিংয়ের যন্ত্রণা নিয়ে পরে মুখ খুলেছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার টায়ারম্যান তাঁর বই “আ হিস্টরি অফ হ্যারো স্কুল”-এ উল্লেখ করেছেন যৌন নিগ্রহের কথা। ১৯৩০ সালে পশ্চিম লন্ডনের সেডবার্গ স্কুলের ১৪ বছর বয়সী এক ছাত্র ফ্যাগিং সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এরপর টনক নড়ে প্রশাসনের। সেডবার্গে ফ্যাগিং বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে এসে ধীরে ধীরে বন্ধ হয় এই কুসংস্কৃতি।এইসব বিষয়সমূহ অরওয়েলকে পরবর্তীতে বার্মিজ কর্মচারীদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে একধরনের নেতিবাচক উপায়ে প্রস্তুত করেছিল। তাদের তিনি লাথি ও ঘুষি মেরেছেন এবং বার্মায় কয়েদিদের তত্ত্বাবধান করার সময় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মারধরের আদেশ দিয়েছেন। ধারনা করা হয় যে, তাঁর আরোপিত নিষ্ঠুর আচরণ পরবর্তীতে তাঁর সহজাত অপরাধবোধকেই তীব্র করে তুলেছে।
স্বেচ্ছায় শ্রেণীচ্যুত হওয়া অরওয়েল পুরোদস্তুর একজন অভিনেতার মতো একটি চরিত্রের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে জনৈক  শ্রমজীবী শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিলেন। তিনি কনুইতে চামড়ার তালিমারা একটি পুরনো পশমী জ্যাকেট, গাঢ় ফ্ল্যানেলের শার্ট, লোমশ টাই এবং ঢোলা কর্ডুরয় ট্রাউজার্স পরতেন। তিনি কোনো ফ্ল্যাট ক্যাপ পরেননি কিন্তু তার নিজের হাতে বানানো এবড়ো থেবড়ো সিগারেট টানতেন এবং এমনকি পিরিচে ঢেলে নিয়ে মব্দ করে চা পান করতেন। বিবিসিতে অনুষ্ঠান করার ফাঁকে ক্যান্টিনে তিনি চরম সর্বহারাদের উচ্চারণে কথা বলতেন। তার সহকর্মীরা চমকে যেতেন।
অরওয়েল কোনোকালেই অর্থপিশাচ ছিলেন না। তরতর করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি বরাবর সংগ্রাম করে গেছেন। তবে অন্যান্য ইটোনিয়ান লেখক এবং বন্ধুদের মূল্যবান সাহায্যের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সিরিল কনোলি, রিচার্ড রিস, ক্রিস্টোফার হলিস এবং অ্যান্টনি পাওয়েল তাঁর সম্পর্কে সহানুভূতি নিয়ে লিখেছেন। দ্য অবজারভারের স্বত্ত্বাধিকারী এবং সম্পাদক ডেভিড অ্যাস্টর ছিলেন তাঁর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ঔপন্যাসিক এল এইচ মায়ার্স মরক্কোতে তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারমূলক ভ্রমণের জন্য গোপনে অর্থ প্রদান করেছেন। রবিন ফ্লেচার স্কটল্যান্ডের জুরা দ্বীপে তাঁর কটেজে অরওয়েলকে সপরিবারে বসবাস করতে দিয়েছেন। রিচার্ড রিস অ্যাডেলফি সাময়িকীতে, সিরিল কনোলি হরাইজন পত্রিকায়, পেঙ্গুইন নিউ রাইটিং সাময়িকীতে জন লেহম্যান, অবজারভার পত্রিকায় ডেভিড অ্যাস্টর এবং সেকার অ্যান্ড ওয়ারবার্গ প্রকাশনায় রজার সেনহাউস অরওয়েলের লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছেন।
অস্বীকার করলেও ইটন সারা জীবন অরওয়েলকে প্রভাবিত করেছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই স্কুলের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তবুও এর সর্বোত্তম মূল্যবোধ দ্বারা অবিস্মরণীয়ভাবে চিহ্নিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি পুরানো ইটোনিয়ানদের অবসন্ন আচরণ বজায় রেখেছিলেন। তিনি একটি উচ্চতর শিক্ষা পেয়েছিলেন, আত্মবিশ্বাসী এবং গোঁড়া ছিলেন, তার নেতৃত্বমূলক উপস্থিতি ছিল এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে পেরেছিলেন- বার্মিজ পুলিশে, স্পেনের গৃহযুদ্ধে এবং যুদ্ধকালীন হোম গার্ডে।
১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে এরিক আর্থার ব্লেয়ার ইটন কলেজের প্রবেশিকা বইতে স্বাক্ষর করেন। ব্লেয়ার-পুরো পৃথিবীতে বর্তমানে যিনি জর্জ অরওয়েল নামে বেশি পরিচিত, প্রথমবারের মতো কিংস স্কলার হিসেবে স্কুলের উঠোন অতিক্রম করার পর থেকে ১০১তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইটন কলেজ লাইব্রেরিতে প্রদর্শিত সম্পদের মধ্যে এই খণ্ডটি একটি মাত্র।
জর্জ অরওয়েলের ১০১তম স্কুল সম্মেলন বার্ষিকীতে এবং স্কুল পাঠাগারে জর্জ অরওয়েলের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচনের পরিপূরক হিসেবে প্রদর্শনীটি তৈরি করা হয়েছিল। যদিও অরওয়েল সম্ভবত কখনও কলেজ লাইব্রেরির ভেতরের দিকে নজর দেননি, সেই বছরের ৩রা মে তার ছেলে, নাতি এবং প্রপৌত্র সকলেই প্রদর্শনীটি দেখতে এসেছিলেন যেখানে অরওয়েলের ইটনের দিন থেকে শুরু করে সাংবাদিকতা এবং লেখালেখির ক্যারিয়ার পর্যন্ত তার জীবনকে খুব গোছালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র :
The Complete Works of George Orwell, ed. Peter Davison (London: Secker & Warburg, 1998).
Enemies of Promise. By Cyril Connolly. (1938).
 George Orwell Letter to F J Warburg, 31 May 1947, The Collected Essays Vol 4 (1968).
Such, Such Were The Joys, By George Orwell.
Remembering George Orwell. Edited Stephen Wadhams. (Markham, Ontario, Canada: Penguin, 1984).
Orwell: Wintry Conscience of a Generation. By Jeffrey Meyers. (NY: Norton, 2000).
ÒSt. CyprianÕs Days,Ó By W. H. J. Christie. BlackwoodÕs Magazine, 309 (May 1971), 391.

 লেখক: তথ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র নির্মাতা, আবৃত্তিকার ও অনুবাদক এবং পরিব্রাজক।













সর্বশেষ সংবাদ
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু আজ
ঘরেই জন্মাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা
অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেন কুমিল্লার কৃতি সন্তান ডাঃ মহিউদ্দিন মাসুম
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এক্সকিউজ’ দেয়ায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত : হাসনাত আব্দুল্লাহ
জুলাই স্মৃতি উদযাপনে 'কুবির ১১ জুলাই’ অন্তর্ভুক্তির দাবী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
কুমিল্লায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলের পর গ্রেপ্তার ৬
কুমিল্লায় এ বছর এইচএসসিতে ঝরে গেছে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী
কুমিল্লায় ৬ হাজার ভারতীয় শাড়ি ও লেহেঙ্গা জব্দ, আটক ১
কুমিল্লায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু, স্ত্রী হাসপাতালে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২