কুমিল্লায়
একে একে বন্ধ হচ্ছে পাটজাত পন্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন কারখানা। এক সময় এ
জেলার সড়ক ও মহাসড়ক ধরে গড়ে উঠা অর্ধশতাধিক কারখানা পাটজাত পন্য উৎপাদনে
সার্বক্ষনিক ব্যস্ত ছিলো। যান্ত্রিক গতি আর কারিগরি দক্ষতায় সোনালি আঁশ পাট
রূপ নিতো নানা বাহারি পণ্যে। সুতা, ব্যাগ, জুতাসহ উৎপাদিত এসব পণ্য দেশের
চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হতো ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান এবং ভারতেও। কিন্তু
ধারাবাহিকভাবে পাট (কাঁচামাল), দক্ষ কারিগর ও শ্রমিক সংকটে ধীরে ধীরে বন্ধ
হয়ে এখন টিকে আছে মাত্র ৬টি কারাখানায়। সেগুলোও ধুঁকছে একই সংকটে। ফলে পণ্য
রপ্তানি কমে নেমে এসেছে প্রায় শূণ্যের কোঠায়।
জেলার কৃষিবিদরা বলছেন,
এখনই পাট চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা না গেলে জেলায় বিলুপ্তি ঘটবে পাটের। আর
পাট হারিয়ে গেলে তৈরি হবে কাঁচামালের ভয়াবহ সংকট। বন্ধ হয়ে যাবে সংকট
মোকাবেলা করে টিকে থাকে পাটনির্ভর কারখানাগুলো।
কুমিল্লার কলকারখানা ও
প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কুমিল্লার সদর, সদর দক্ষিণ,
দেবিদ্বার, চান্দিনা, মুরাদনগর ও দাউদকান্দি এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ও
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের পাশে পাট থেকে পাটজাত পণ্য উৎপাদন করতেন
এমন অর্ধশতাধিক কারখানা ছিল। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যেই আশা, ঊষা,
ডাজীসহ উৎপাদন বন্ধ করেছে বেশকিছু কারাখানা। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো
উৎপাদন করতেন পাট থেকে সুতা, ব্যাগ ও বস্তাসহ নানা পণ্য।
তথ্য বলছে, গত
এক যুগে অর্ধশতাধিক কারাখানার মধ্যে বর্তমানে পাটজাত পণ্য উৎপাদনে টিকে
আছে ফুলহার, সোনালী আঁশ-১, সোনালী আঁশ -২, আশ্রাফ, এনএসআর ও সাদাত জুট
মিলসহ ৬টি কারখানা। নানা সংকটের সাথে নিয়মিত যুদ্ধে করে টিকে থাকা
কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে অবস্থিত।
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া
মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা জিহান ফুডওয়্যারের প্রোডাকশন ম্যানেজার আল আমিন
বলেন, পাটের তৈরি পণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। কিন্তু কাঁচামালের দাম বাড়ায়
পণ্যের দামও বৃদ্ধি পায়। এতে ক্রেতারা পণ্য থেকে বিমুখ হয়। জিহানে তৈরি
করা জুতা পশ্চিমা বাজারে রপ্তানি হয়ে থাকে। কাঁচামাল সংকটে পণ্যে দাম
বাড়লেও বিদেশি রপ্তানিকারকরা আগের দামই দিয়ে যাচ্ছেন। এতে আর্থিক সংকটের
মুখে কারখানা।
বন্ধ হওয়া কারাখানা আশা পাটকলের ব্যবস্থাপক কৃষ্ণ জানান,
কারখানায় পাটজাত পণ্য উৎপাদন বন্ধের অন্যতম কারণ আর্থিক ও পাটের কাঁচামাল
সংকট। গত কয়েক বছর তারা চাহিদামতো পাট না পাওয়ায় এবং পণ্য রপ্তানির সঙ্গে
পাটের মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় ধীরে ধীরে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য
হয়েছেন।
কুমিল্লার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের
উপপরিচালক সৈয়দ নাজমুল রাশেদ বলেন, কুমিল্লায় বেসরকারিভাবে পাট থেকে
বিভিন্ন পাটজাত পণ্য উৎপানকারী বহু কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সকল
প্রতিষ্ঠান এক সময় বিভিন্ন ধরনের বাহারি পণ্য উৎপাদন করতেন। সুতা, ব্যাগ,
জুতাসহ তাদের উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারে সরবরাহ ছাড়াও বিদেশের বাজারে
রপ্তানি করতেন। কিন্তু ধারাবাহিরভাবে কাঁচামাল, দক্ষ জনবল ও আধুনিক মেশিনের
অভাবে উৎপাদন বন্ধ করেছেন চল্লিশের বেশে কারখানা। বর্তমানে পণ্য উৎপাদনে
আছে মাত্র ৬টি কালখানা। সেগুলোর মধ্যেও এনএসআর ও আশ্রাফ মিল কাঁচামাল, দক্ষ
জনবল ও আধুনিক মেশিনের অভাবে নাম মাত্র পণ্য উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে তারা সবচেয়ে বেশে পাটের কাঁচামাল সংকটে
ভুগছেন।
মাঠপর্যায়ে সংকটের কারণ কী জানতে গিয়ে দেখা গেছে, ভুট্টা ও
আউশ ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না পাটচাষ। শুধু কুমিল্লার ১৭
উপজেলাতেই বছরের ব্যবধানে পাটচাষ কমেছে ২১২ হেক্টর জমিতে।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, গেল মওসুমে জেলায় পাট চাষ হয়েছে ১ হাজার ২২ হেক্টর জমিতে। আর চলতি মওসুমে চাষ হয়েছে ৮শ১০ হেক্টরে।
কৃষি
কর্মকর্তাদের দাবি, উচ্চফলনশীল পাটের বীজের অভাব, বাড়তি উৎপাদন খরচ ও
ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কমছে পাট উৎপাদন। আরও কৃষক বলছেন, ভুট্টাসহ অন্য
ফসলে লাভ বেশি হওয়ায় পাটচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। তাই পাট উৎপাদন কমায় এর
প্রভাব পড়ছে পাটজাতপণ্য উৎপাদনে।