জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নানামুখী সঙ্কটে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা বঞ্চিত লাখ লাখ নারী-পুরুষ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির এখন বেহাল দশায় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। রয়েছে চিকিৎসক ও কর্মচারীদের আবাসন সঙ্কট। মূল ভবনে দেখা দিয়েছে ফাটল, বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়েছে পলেস্তার। নিরাপত্তা, দূষিত পরিবেশ ও দালালদের উৎপাতে ব্যহত স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা। উপজেলার ছয় লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বর্তমানে নিজেই সঙ্কটাপন্ন। মহাসড়কের ৪২ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার রোগী নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে নেই জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারী ও অর্থোপিডিক্স চিকিৎসক।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্যতম সঙ্কটগুলো হচ্ছে-জনবল, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও আবাসন। জনবল সংকটে সৃষ্টি হয়েছে আরো অনেক সঙ্কট। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৫ পদের বিপরীতে আছে ১ জন। ফলে অপরিচ্ছন্ন ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশেই রোগী দেখতে হয় চিকিৎসদের। ওয়ার্ড বয়ের ৩ পদের মধ্যে আছে ১জন, আয়ার একটি পদ শূণ্য, ২ বাবুর্চির মধ্যে আছে ১ জন, ৩ অফিস সহকারীর আছে ২ জন। নেই জুনিয়র টেকনেশিয়ান, স্টোর কিপার ও ক্যাশিয়ার। ২টি ফার্মাসিস্ট পদের মধ্যে শূণ্য ১টি। ২৪ চিকিৎসক ও ১১ কনসালট্যান্টের মধ্যে নেই জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারী, নাক কান গলা, অর্থোপেডিক্স ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ। বেতন এখান থেকে নিলেও অর্থোপেডিক্স ও ফিজিক্যাল মেডিসিন চিকিৎসক সংযুক্তিতে রয়েছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নার্স এর ৩০ পদ থাকলেও শূণ্য রয়েছে ৯ পদ। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ৮৪ পদের মধ্যে নেই ১৪ জন।
হাসপাতাল সূত্র আরো জানায়, প্রতি মাসে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনার রোগী আসে ১৫০-২০০ জন। ৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে থাকেন ৭০-৮০ জন। দোতলায় পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের নেই বারান্দা। অতিরিক্ত রোগী বাধ্য হয়ে রাখতে হয় চলাচলের পথে। প্রতি মাসে পারিবারিক ও সামাজিক ঘটনায় সংঘর্ষে আহত রোগী আসে ৭৫০-৮০০ জন। জরুরী বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে মাসে ৩৮০০-৪০০০ জন।
সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ৮০০-১০০০ জন রোগী সেবা নেয়া প্রতিষ্ঠানটিতে নেই টিকেট অটোমেশন। এতে রোগীদের লেগে যায় লম্বা লাইন, বাড়ে ভোগান্তি। টিকেট কাউন্টারে নেই প্রয়োজনীয় জনবল। নিরাপত্তাকর্মীর ৩ পদের মধ্যে ২ পদ-ই শূন্য। ফলে সন্ধ্যা হলেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর ভেতরে ভিড় জমায় মাদকসেবীরা।
এছাড়া মহাসড়ক থেকে ৭ ফুট নিচু জায়গায় অবস্থিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অল্প বৃষ্টিতেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। গত বছরের বন্যায় প্রায় ডুবে যায় ভবনের নিচতলা। এতে নষ্ট হয়ে যায় ডেন্টাল মেশিন, টিকেট অটোমেশনসহ ৭-৮ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম। ভেঙ্গে পড়েছে দরজা, জানালা। বন্যায় নষ্ট হওয়া এক্স-রে মেশিন বহু চেষ্টায়ও মিলেনি এখন পর্যন্ত। হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘পিট’ আছে কিন্তু সেটিও অচল। হাসপাতালের পেছনেই গর্ত করে ফেলা হয় আবর্জনা। ফাটা সুয়ারেজ লাইনে দুষিত পরিবেশ, মশার উৎপাতে স্থির থাকা দায়। কখনো কখনো পৌর কর্তপক্ষ মশক দমন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এই সেবা থেকে বঞ্চিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। দোতলায় কিছু কিছু জায়গায় খসে পড়ছে পলেস্তার। নিচ তলায় ইপিআই রুমের পূর্ব পাশের দেয়াল(সমাজ সেবা রুম) ধ্বসে পড়ছে, ফাটল দেখা দিয়েছে দেয়ালে। বহির্বিভাগে নেই চিকিৎসক বসার পরিবেশ। নেই কনসালটেন্ট বসার জায়গা। একই রুমে পার্টিশন করে রোগী দেখেন ২ চিকিৎসক।
স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবার প্রতিবন্ধকতার জন্য আবাসন সঙ্কটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। আবাসন সঙ্কটের কারণে চিকিৎসক ও নার্সরা থাকেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাহিরে ভাড়া বাসায়। এ কারণে জরুরী ও অন্যান্য অসুস্থ্যতায় তাৎক্ষণিক মিলেনা সেবা। দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা কোয়ার্টারে চিকিৎসক না পেয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষায় আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। ৬টি আবাসিক ভবনের মধ্যে পরিত্যক্ত তিনটি ভবন। চিকিৎসকরা প্রায় সবাই থাকেন বাহিরে। আবাসনে সব মিলিয়ে প্রয়োজন ৬০ ইউনিট। নার্সদের কোয়ার্টারে থাকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও কিন্তু কেউ এখানে থাকতে পারছে না, দুইজন অনুপযোগী ভবনে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ রশিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘জনসংখ্যা বিবেচনায় এখানে প্রয়োজন ১০০ শয্যার হাসপাতাল। গত বছরের বন্যায় এক্স-রে মেশিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য কমল্পপ্লেক্সের মূল ভবনটি। রয়েছে চিকিৎসক ও জনবল সঙ্কট। স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে দ্রুত প্রয়োজন সম্প্রসারিত ভবন ও চিকিৎসকদের নতুন আবাসিক ভবন’।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক মোঃ জামাল হোসেন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অটোমেশন প্রতিস্থাপনে ইতোমধ্যে আমরা পৌরসভা থেকে আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছি। রোগীদের সেবা নিশ্চিতে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি’।
