শুক্রবার ৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
রবীন্দ্রনামা ও কবি-স্বীকৃতি
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম আপডেট: ০৮.০৫.২০২৫ ২:২২ এএম |

 রবীন্দ্রনামা ও কবি-স্বীকৃতি
বাংলাদেশের কিংবদন্তী ইতিহাস অনুসারে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষের ইতিহাসও বৈচিত্র্যপূর্ণ। জানা যায় অষ্টম-দশক শতকের কোনো সময়ে আদিশূর নামে রাজার আহ্বানে কান্যকুজ থেকে আগত পঞ্চসাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের অন্যতম শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ক্ষিতীশের পুত্র ভট্টনারায়ণ, তাঁর পুত্র দীন রাজা ক্ষিতিশূরের নিকট থেকে কুশ গ্রাম (বর্ধমান) পেয়ে 'কুশারী' পদবীতে পরিচিত হন। দীনকুশারীর অষ্টম কী দশম পুরুষ জগন্নাথ কুশারী। তখন কাশ্যপগোত্রীয় রায় চৌধুরী বংশের দু'ভাই পীর-আলি নামে কোনো মুসলমান দ্বারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হন। তখন থেকে তাঁদের আত্মীয়রা 'পীরালি' বলে পরিচিত। জগন্নাথ কুশারী বিবাহসূত্রে পীরালি।
জগন্নাথ কুশারীর পাঁচ-ছয় পুরুষ পরে পঞ্চানন কুশারী ও তাঁর খুরাতভাই শুকদেব কলকাতায় এসে আদি গঙ্গার তীরে বাসস্থান স্থাপন করেন। এ স্থানটিকে বলা হতো গোবিন্দপুর। পঞ্চানন কুশারী যেখানে ঘর বাঁধেন সেখানে হরিজনদের বাস। ব্রাহ্মণ পঞ্চাননকে তাঁরা ভক্তিভরে 'ঠাকুরমশাই' বলত। এ পঞ্চানন কুশারী ইংরেজ জাহাজী কাপ্তেনদের মাল সরবরাহ করতেন, সাহেবরা তাঁকে 'ট্যাগোর' নামে ডাকত, তখন থেকে কুশারী পদবীর পরিবর্তে ঠাকুর বা ট্যাগোর নাম প্রচলিত হয়।
পঞ্চানন ঠাকুরের পুত্র জয়রাম কোম্পানির আমীনগিরি করে প্রভূত ধনের মালিক হন। ১৭৫৬ সালে জয়রামের মৃত্যু হয়। এদিকে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিবাদ আরম্ভ হয় এবং নবাব কর্তৃক কোম্পানির শহর কলকাতা লুণ্ঠন, ফোর্ট ইউলিয়াম ধ্বংস হয়। ১৭৫৭ সালে সিরাজের লুণ্ঠনে ক্ষতিগ্রস্ত ধনীদের মধ্যে ঠাকুর বংশীয়েরা প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ লাভ করেন এবং বহু সম্পদের মালিক হন। ১৭৬৫ সালে জয়রামের পুত্র নীলমণি (রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ) উড়িষ্যার নিম্নকি অফিসে চাকুরি পেয়ে ধনার্জন করেন। নীলমণি ও তাঁর ভাই দর্পনারায়ণ পাথুরিয়াঘাটার জমি ক্রয় করে গৃহাদি নির্মাণ করেন।
১৭৮৪ সালে নীলমণি তাঁর ভাই দর্পনারায়ণ থেকে পৃথক হয়ে জোড়াসাঁকোয় বৈষ্ণবচরণ শেঠের নিকট থেকে জমি ক্রয় করে গৃহ নির্মাণ করেন। ১৭৯১ সালে নীলমণি ঠাকুরের মৃত্যু হয়। ১৭৯৪ সালে নীলমণির পৌত্র, রামমণির পুত্র দ্বারকানাথের জন্ম হয়। ১৭৯৯ সালে নীলমণির জ্যেষ্ঠপুত্র নিঃসন্তান রামলোচনের পত্নী অলকাদেবী দেবরপুত্র দ্বারকানাথকে (বয়স ৫) দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮০৭ সালে রামলোচনের মৃত্যু হয়, রামমণির জ্যেষ্ঠপুত্র (দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ সহোদর) রাধানাথ পরিবারের অভিভাবক নির্বাচিত হন। ১৮১৭ সালে দ্বারকানাথের পুত্র (রবীন্দ্রনাথের পিতা) দেবেন্দ্রনাথের জন্ম হয়।
১৮২৯ সালে দেবেন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। তখন তাঁর বয়স ১২। বধূ সারদাদেবীর বয়স ৬।
১৮৩৪ সালে দ্বারকানাথ 'কার-টেগোর' কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দেবেন্দ্রনাথ (বয়স ১৭) ইউনিয়ন ব্যাংকের কাজে নিযুক্ত হন। ১৮৩৮ সালে দ্বারকানাথের চেষ্টায় 'বেঙ্গল ল্যানড-হোল্ডার্স এসোসিয়েশন' স্থাপন করা হয়। তাঁর উত্তর ভারত সফরকালে দ্বারকানাথের জননী অলকাদেবীর (দেবেন্দ্রনাথের পিতামহী) মৃত্যুতে দেবেন্দ্রনাথের গভীর শোক ও বৈরাগ্য দেখা দেয়। ১৮৩৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ একদল যুবকের সাহচর্যে ধর্ম ও দর্শন চর্চার জন্য 'তত্ত্বরঞ্জিনী' (পরে ভত্ত্ববোধিনী) সভা স্থাপন করেন। ১৮৪০ সালে দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। ১৮৪২ সালে দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম, ১৮৪৪ সালে তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের জন্ম, ১৮৪৫ সালে চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। এদিকে ১৮৪৬ সালে ১ আগস্ট বিলাতে দ্বারকানাথ মৃত্যু বরণ করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর দেবেন্দ্রনাথের কাছে পিতার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছায়।
১৮৪৭ সালে দেবেন্দ্রনাথের প্রথম কন্যা সৌদামিনীর জন্ম হয়। সে বছরই দ্বারকানাথের ঋণ শোধের জন্য দেবেন্দ্রনাথ সর্বস্ব ত্যাগ করেন।
১৮৪৯ সালে দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম হয়। ১৮৫০সালে দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারীর জন্ম হয়। ১৮৫৪ সালে তৃতীয় কন্যা শরৎকুমারীর ও ১৮৫৬ সালে চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম (রবীন্দ্র সাহিত্যে ন'দিদি হিসেবে পরিচিত) হয়। ১৮৫৮ সালে দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম কন্যা বর্ণকুমারীর (রবীন্দ্র সাহিত্যে ছোড়দি) ও ১৮৫৯ সালে সপ্তম পূত্র সোমেন্দ্রনাথের জন্ম হয়।
১৮৬১ সালে ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দ; ১৭৮৩ শক, বৈশাখ ২৫) কৃষ্ণাত্রয়োদশী, সোমবার ৬নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি (মহর্ষিভবন) শেষ রাত্রে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর চতুদর্শ সন্তান, অষ্টম পুত্র।
একই বছর প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মদনমোহন মালব্য, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও মতিলাল নেহরু জন্ম গ্রহণ করেন। সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত অমিত্রাক্ষর ছন্দে 'মেঘনাদবধ কাব্য' প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ 'ছেলেবেলা' প্রসঙ্গে লিখেছেন--
'আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে-বসে দিন চলত। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির
হাঁফধরানো অন্ধকারে, গাড়ী চড়তে ছিল ভারি লজ্জা। তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলিবাতি; কেরোসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক। আমাদের পড়বার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ। মাস্টার মশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্টবুক।--- তখন জলের কল বসে নি। বেহারা বাঁকে করে কলসি ভরে মাঘ-ফাল্গুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। এক তলার অন্ধকার ঘরে সারিসারি ভরা থাকত বড়ো বড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল। নিচের তলায় সেইসব স্যাঁৎসেতে এঁধো কুটুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাস করে ছিল কে না জানে তাদের মস্ত হাঁ, চোখদুটো বুকে, কানদুটো কুলোর মত, পা দুটোউলটো দিকে। সেই ভুতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যখন বাড়ি-ভিতরের বাগানে যেতুম, তোলপাড় করত বুকের ভিতরটা, পায়ে লাগাত তাড়া'।
১৮৬৬ সালে রবীন্দ্রনাথের বছর বয়সে সোমন্দ্রনাথের সঙ্গে 'হাতে ঘড়ি' হলো। ১৯৬৮ সালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারী স্কুলে ভর্তি করানো হয়- পরে নর্মাল স্কুলে। সে বছর ৫ জুলাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের (বয়স ১৯) কাদম্বরীর (বয়স ৯) সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৭ নভেম্বর স্বর্ণকুমারীর (বয়স ১৩) বিয়ে হয় জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে।
১৮৬৯ সালে বালক রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখা আরম্ভ করেন। স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
'একদিন দুপুর বেলায় আমাকে তাঁহার (বয়সে বড় ভাগ্নে জ্যোতিঃ প্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৯১৯) ঘরে ডাকিয়া লইয়া কেমন করিয়া চৌদ্দ অক্ষর মিলাইয়া কবিতা লিখিতে হয় আমাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইলেন এবং আমার হাতে একটা শ্লেট দিয়া বলিলেন পদ্মের উপর একটি কবিতা রচনা কর। তাহার পূর্বে বারম্বার রামায়ণ মহাভারত পড়িয়া ও শুনিয়া পদ্যচ্ছন্দ আমার কানে অভ্যস্ত হইয়া আসিয়াছিল।গোটাকতক লাইন লিখিয়া ফেলিলাম। জ্যোতি খুব উৎসাহ দিলেন'।
১৮৭০ সালে স্কুলের শিক্ষা ছাড়াও দাদা হেমেন্দ্রনাথের পরিকল্পনামতো বাড়িতে বিচিত্র বিদ্যাচর্চা করছেন। তন্মধ্যে আছে কংকাল দেখে অস্থিবিদ্যাচর্চা, কুস্তি ও সংগীত। কাব্যরচনার অভ্যাস চলছে- নীল ফুলস্ক্যাপের খাতাটি 'ক্রমেই বাঁকা-বাঁকা লাইনে ও সরুমোটা অক্ষরে কীটের বাসার মতো' ভরে উঠতে লাগল। নর্মাল স্কুলে এক বছর পাঠ নেন রবীন্দ্রনাথ।
১৮৭১ সালে রবীন্দ্রনাথকে বেঙ্গল একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। স্কুল ভালো লাগছে না- পড়াশোনায় অযত্ন। পড়াশোনার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে চার দেয়ালে বন্ধ স্কুলের পরিবেশ আর সহপাঠীদের দুর্ব্যবহার।
তখন মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্য' পড়লেন- ভালো লাগল না,
কারণ ভাষাশিক্ষার জন্য ওটি পড়ানো হয়েছিল। বিজ্ঞানের পরীক্ষাগুলো হাতে কলমে দেখে বিস্মিত হলেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের 'বিবিধার্থসঙ্গ' পত্রিকা পড়ে আনন্দ পেলেন। আর 'অবোধবন্ধু' পত্রিকায় 'পৌল-বর্জিণী' পড়ে মন্তব্য করেছেন-'প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত'।
১৮৭২ সালে কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের উপদ্রব হওয়ায় পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পেনেটির বাগানবাড়িতে বাস শুরু করেন। বাংলাদেশের গ্রামের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। লিখেছেন-
'প্রত্যহ প্রভাতে ঘুম হইতে উঠিবামাত্র আমার কেমন মনে হইত, যেন দিনটাকে একখানি সোনালি পাড় দেওয়া নূতন চিঠির মতো পাইলাম।
লেফাফা খুলিয়া ফেলিলে যেন কী অপূর্ব খবর পাওয়া যাইবে।'
'প্রভাত সংগীত'-এর কবিতায় এখানকার স্মৃতি বর্ণিত আছে।
১৮৭৩ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পরিবারের মধ্যে প্রথম অপৌত্তলিকভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ তিনজনের উপনয়ন হলো। গায়ত্রীমন্ত্রের সঙ্গে প্রথম অর্থবোধেরচেষ্টা। পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ভ্রমণে বের হলেন। বোলপুরের দৃশ্য চোখে দেখলেন প্রথমবার-খেলা করে বেড়ালেন খোয়াইয়ের মধ্যে। তারপর উত্তর ভারত ভ্রমণ- ডালহাউসি পাহাড়ে দু'মাস। বাবার কাছে সংস্কৃত, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করছেন।
জুন মাসে কলকাতায় ফিরে আবার বেঙ্গল একাডেমীতে যাওয়া আরম্ভ করতে হলো। ভালো লাগল না মোটেই, বছরের শেষে স্কুল ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৮৮৭৪ সালে অন্য ভাইদের সঙ্গে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হলেন রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্মাল না- বাড়িতে নানা শিক্ষাদানের চেষ্টা চলতে লাগল। জ্যেষ্ঠ ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ স্বয়ং কিছুকাল পড়াশোনা করালেন।
জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য- গৃহ শিক্ষকের নিকট সংস্কৃত কুমারসম্ভব ও ইংরেজি ম্যাকবেথ নাটক মূলপাঠ ও তা বাংলায় ছন্দে রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করানো হয়।
১৮৭৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হিন্দু মেলার বার্ষিক উৎসবে কবিতা পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ। তা স্বনামে অমৃতবাজার পত্রিকায় (২৫ ফেব্রুয়ারি) 'হিন্দু মেলার উপহার' নামে প্রকাশিত হয়।
১০ মার্চ রবীন্দ্রনাথের মা সারদাদেবীর মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
'কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলামনা। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাইরে লইয়া গেল--- তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে একদমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে হাহাকার তুলিয়া দিল।'
২ মে গুণেন্দ্রনাথের বাড়িতে বিদ্বজ্জন সভায় 'প্রকৃতির খেদ' কবিতা পাঠ করলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রচিত 'সরোজিনী' নাটকের জন্য 'জ্বল জ্বল চিতা' গানটি লিখেন। 'জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব' মাসিক পত্রিকায় (অগ্রহায়ণ ১২৮২ থেকে কার্তিক ১২৮৩ পর্যন্ত) রবীন্দ্রনাথের 'বনফুল' কাব্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়।
১৮৭৬ সালে প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রকে চাক্ষুস দেখেন। উল্লেখ্য, সেন্ট জেভিয়ার্সে ফেল করায় স্কুলে যাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
সে সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। আকস্মিকভাবে কবি নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়। এ প্রসঙ্গে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখেছেন-
স্মরণ হয় ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে আমি কলিকাতায় ছুটিতে থাকিবার সময় কলিকাতার উপনগরস্থ কোনো উদ্যানে 'নেশনাল মেলা' দেখিতে গিয়েছিলাম। তাহার বৎসরেক পূর্বে আমার 'পলাশীর যুদ্ধ' প্রকাশিত হইয়া কলিকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। একজন সদ্য পরিচিত বন্ধু মেলার ভিড়ে আমাকে 'পাকড়াও' করিয়া বলিলেন যে একটি লোক আমার সঙ্গে পরিচিত হইতে চাহিয়াছেন। তিনি আমার হাত ধরিয়া উদ্যানের এক কোণার এক প্রকাণ্ড বৃক্ষতলায় লইয়া গেলেন। দেখিলাম সেখানে সাদা ঢিলা ইজার চাপকান পরিহিত একটি সুন্দর নব-যুবক দাঁড়াইয়া আছেন। বয়স ১৮/১৯ শান্ত স্থির। বৃক্ষতলায়


যেন একটি স্বর্ণমূর্তি স্থাপিত হইয়াছে। বন্ধু বলিলেন, 'ইনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ।' তাঁহার জ্যেষ্ঠ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সী কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। দেখিলাম সেই রূপ, সেই পোশাক। সহাসিমুখে করমর্দন কার্যটা শেষ হইলে, তিনি পকেট হইতে একটি 'নোটবুক' বাহির করিয়া কয়েকটি গীত গাহিলেন ও কয়েকটি কবিতা গীতকণ্ঠে পাঠ করিলেন। মধুর কামিনী-লাঞ্ছন কণ্ঠে, এবং কবিতার মাধুর্য ও স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভায় আমি মুগ্ধ হইলাম। তাহার দুই একদিন পরে বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার চুঁচুড়ার বাড়িতে লইয়া গেলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে আমি 'নেশনাল মেলায়' গিয়া একটি অপূর্ব নব-যুবকের গীত ও কবিতা শুনিয়াছি, আমার বিশ্বাস তিনি একদিন একজন প্রতিভাসম্পন্ন কবি ও গায়ক হইবেন। অক্ষয়বাবু বলিলেন-'কে'? রবিঠাকুর বুঝি? ও ঠাকুরবাড়ির কাঁচামিঠে আঁব।' তাহার পর ১৬ বৎসর চলিয়া গিয়াছে আজ ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দ। আমার ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হইয়াছে।
১৮৭৭ সালে ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী করার প্রস্তাবকে ধিক্কার জানিয়ে হিন্দুমেলায় দীর্ঘ কবিতা পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথ। এ বছর ভানুসিংহের পদাবলী, মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা, বড় গল্প ভিখারিণী, প্রথম উপন্যাস করুণা (অসম্পূর্ণ) প্রভৃতি রচনা করেন।
১৮৭৮ সালে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'কবি-কাহিনী' প্রকাশিত হয়। পরের বছর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কবি-কাহিনী' (১৮৭৯) পুস্তিকাকারে বের হয়। সে বছর বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'সারদামঙ্গল' কাব্যটি ডিসেম্বরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
এখানে উল্লেখ করতে হয়- ১৮৭৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ২০ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।
সতরো বছর বয়সের (১৮৭৮) প্রথম বিলেত যাত্রার আগে রবীন্দ্রনাথ এলেন আমেদাবাদে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে পাঠালেন বোম্বাইয়ে- দাদোবা পাণ্ডুরঙ্গ তড়খড়ের পরিবারে। উদ্দেশ্য ভাইকে বিলিতি সহবত শেখানো- শিক্ষয়িত্রী তড়খড়ের কন্যা আন্না তড়খড়। অসামান্যা সুন্দরী, চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
'যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাকচতুর, তেমনি মিশুক। যাকে বলে চারমিং।'
তাঁর কঠাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল, তাঁকে দেখলে পুরুষের বক্ষোমাঝে নাচে রক্তধারা।
রবীন্দ্রনাথ কম কিসে। সুঠাম সুদর্শন রবীন্দ্রনাথের মুখে তখন লাবণ্য, কণ্ঠে গান, হৃদয়ে উন্মাদনা। আন্না তাঁকে দেখে দারুণ মুগ্ধ হলেন। সম্পর্ক নিবিড় হলো অল্পদিনেই, দু'জনে কাছাকাছি এলেন বিনা বাধায়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন-
আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসতো। কত ছুতো করেই যে ঘুরতো আমার আনাচে কানাচে।'
'ছেলেবেলা'য় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
'মেজদাদা মনে করলেন বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেই রকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া-মন আরাম পাবে। ইংরেজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায়। তাই কিছুদিনের জন্য বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়ে ছিলাম। সেই বাড়ির কোনো এখানকার কালের পড়াশুনোওয়ালা মেয়ে ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন তাঁর শিক্ষা বিলাত থেকে। আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেতে পারতো না। তা করেননি। পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মতো পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে। আদর আদায় করার ওই ছিল আমার মূলধন। যাঁর কাছে নিজের কবিয়ানার জানান দিয়েছিলেম, তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেননি, মেনে নিয়েছিলেন'।
আন্না তখন কবির সর্বক্ষণের সঙ্গিনী। পড়ার ঘরে, খাবার টেবিলে, বাইরের বাগানে। আর দুজনে কেবল কথা আর কথা, গান আর গান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
'একথা আমি মানবো যে, আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতন কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু হায়রে, সে হাওয়াটাকে উসকে দেওয়ার দিকেআমার না ছিল তৎপরতা, না ছিল কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।'
আন্না রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে একটু বড়, একটু বেশি প্রগলভ, বেশি উচ্ছল।
সুতরাং তুষার গলানোর দায়িত্বটা তো আন্নার উপরই পড়েছে। ইংরেজিয়ানায় তালিম কতোটা হলো তা ঠিক জানা যায় না কিন্তু আন্না রবীন্দ্রনাথের কাছে বাংলা শিখেন, বাংলা গান শিখেন এবং বাংলা কবিতা পড়েন। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আন্না পুলকে রোমাঞ্চিত হন। বলেন-
'কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।'
রবীন্দ্রনাথ তখন 'কবি-কাহিনী'র কবিতা সংশোধন করছেন। আন্নাকে পড়ে শোনাতে হবে। কারণ, আন্নার আবদার- 'আজ কোনো কাজ নয়, সব ফেলে দিয়ে তোমার কবিতা শুনবো।' রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনে আন্না শুধু মুগ্ধই নন, তাঁর ছন্দোবদ্ধ সুরেলা কণ্ঠস্বরে জগৎ সংসার ভুলে যান আন্না, রবির কবিতা শুনে, তাঁকে দেখে দেখে মুগ্ধ আন্না তন্ময়, গান শুনে বিমোহিত। এক সময় বলে উঠেন-
'রবি, তুমি কোনো দিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন ঢাকা না পড়ে।'
রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত এ অনুরোধ রাখতে পারেননি। বলেছেন-
'আমার মুখে অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল।'
আন্না- রবীন্দ্রের মিলন-স্মৃতি খুবই রোমাঞ্চকর।
ক. একদিন রাত্রে রবীন্দ্রনাথ ঘরে বসে উদাসমনে হয়তো বা বাড়ির কথা ভাবছেন। বাইরে জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। এমন সময় আন্না এসেই বলেন- 'আহা, কী এত ভাবো আকাশ পাতাল?'
আন্নার মুখে হাসি, চোখে বিদ্যুৎ, রবীন্দ্রনাথ শঙ্কিত হলেন, এসেই তাঁর বিছানায় বসে পড়লেন। মনে হলো গান বা কবিতা নয়, আজ তিনি সতেরো বছরের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল তরুণ কবির শরীরের কাছাকাছি আসতে চান, কবির বিব্রতভাব কাটার আগেই সরাসরি আবদার- 'আমার হাত ধরে টানো তো-দেখি টাগ অব ওয়ারে কে জেতে?' রবীন্দ্রনাথ হাত ধরতেই তিনি শ্লথভাবে হার মেনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের বুকে।
খ. আন্নার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে রবীন্দ্রনাথকে। কতটুকু বিলিতি শিক্ষা হলো তা বোঝা হলো না। কবি যেন তাঁর দৃষ্টি দিয়ে বলতে চান অনেক কথা। আন্নাও যেন নিরব নয়নের ভাষা দিয়ে বলতে চান, 'কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত জ্যোৎস্নারাতে, কত গোপন গানে তুমি আমায় অনেক বলেছিলে। বন্ধু, আমি যে এই কথাটিই তোমার কাছে জানতে এসেছি।'
গ. কবির আড়ষ্টতা ভাঙতে শুরু করেছে, আন্না প্রগলভ হয়ে ওঠেন, বিলিতি উপাখ্যান রবীন্দ্রনাথকে শোনান-
'জানো রবি, ঘুমে অচেতন কোনো কুমারীর ঘুম না ভাঙিয়ে যদি কেউ তার হাতের দস্তানা চুরি করে নিতে পারে, তাহলে তাকে চুম্বন করার অধিকার সেই পুরুষের জন্মায়।'
এবং মুহূর্তের মধ্যে আন্না এক জোড়া দস্তানা বের করে রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে নাচাতে নাচাতে শুয়ে পড়েন এবং ঘুমের ভান করেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন, এ কপট নিদ্রা, মন চঞ্চল, হৃদয় উদ্বেল। দস্তানা খুলে নেবেন কি নেবেন না ভাবতে সময় উৎতীর্ণ হয়ে যায়, ভয় লজ্জা এবং কুণ্ঠা তাঁকে গ্রাস করে ফেলে।
কবি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকেন।
ঘ. তারপর বিদায়ের দিন প্রিয় বান্ধবীর বিষন্ন মুখখানি তুলে ধরে মনে মনে বলেন-
'মিটিয়ে দেব সকল খোঁজা সকল বোঝা, 
ভোর বেলাকার একলা পথে চলব সোজা,
তোমার আলোয় ডুবিয়ে নেব সজাগ আঁখি।'
তাই জীবনস্মৃতি রোমন্থন করে দিলীপকুমার রায়কে বলেন-
'সে মেয়েটিকে ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন। আমার জীবনে তারপর নানান অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে-বিধাতা ঘটিয়েছেন কতো যে অঘটন-কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনও ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যে রকমই হোক না কেন।'
ঙ. আন্নার সঙ্গে জীবনের স্মৃতিময় মধুর দিনগুলো কাটিয়ে বিলেতে পাড়ি দেবার আগে 'কবি-কাহিনী', তাড়াতাড়ি ছাপার ব্যবস্থা করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে লেখেন, ছাপার পরই প্রথম কপি যেন আন্নাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বই পেয়ে আন্না লেখেন-
ঞযধহশ ুড়ঁ াবৎু সঁপয রহফববফ ভড়ৎ ংবহফরহম সব ঃযব বহঃরৎব ঢ়ঁনষরপধঃরড়হ ড়ভ কবি-কাহিনী ঃযড়ঁময ও যধাব ঃযব ঢ়ড়বস সুংবষভ রহ ঃযব হঁসনবৎং ড়ভ ভারতী রহ যিরপয রঃ ধিং ঢ়ঁনষরংযবফ, ধহফ যিরপয গৎ. ঞধমড়ৎব ধিং মড়ড়ফ বহড়ঁময ঃড় মরাব সব নবভড়ৎব মড়রহম ধধিু ধহফ যধাব যধফ রঃ ৎবধফ ধহফ ঃৎধহংষধঃবফ ঃড় সব ঃরষষ ও শহড়ি ঃযব ঢ়ড়বস ধষসড়ংঃ নু যবধৎঃ.
অনেক দিন পর এ চিঠিটি দেখে রবীন্দ্রনাথ চিনতে পারেন এবং বলেন-
'তোমরা রবীন্দ্র-জাদুকর যদি করতে চাও তো এই পত্রটিকে সর্বাধিক গৌরবের স্থান দিও।'
প্রথম পরিচয়ের পর আন্নার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আর কখনো দেখা হয়নি। কবি আন্নার নাম দিয়েছিলেন 'নলিনী'। এই নামটি কবির অত্যন্ত প্রিয়।
'কবি-কাহিনী'র নায়িকা নলিনী, 'ভগ্নহৃদয়ের' নায়িকা নলিনী এবং 'নলিনী' নামে আলাদা একটি ছোট নাটকও রচনা করেছেন কবি। এক গানে লিখেন-
'শুনো, নলিনী খোলো গো আঁখি-
ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কি!
দেখো, তোমারি দুয়ার 'পরে
সখী এসেছে তোমারি রবি।'
'ভগ্নহৃদয়ের' নায়িকা নলিনীর পরিচয় প্রসঙ্গে কবির উক্তি-
'এক চপল স্বভাবা কুমারী।'
লিখেন-
'শুনেছি শুনেছি তাহা,
নলিনী নলিনী নলিনী নলিনী
কেমন মধুর আহা'।
তিনি আন্না ছাড়া আর কেউ নন।
১৮৭৯ সালে সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ব্যারিস্টার তারকচন্দ্র পালিতের ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথকে লণ্ডনে বাস করতে হয়। প্রথম রিজেন্ট উদ্যানের সম্মুখে একটি বাসায় থাকাকালে লাটিন শিখাবার জন্য একজন শিক্ষক আসতেন। পরে মি. বার্কার নামে শিক্ষকের বাড়িতে বাস করতেন, এখানে 'মগ্ন ভগ্নতরী' কবিতা (বিলেত বাসকালে একমাত্র কবিতা) রচনা করেন।
লণ্ডনে ডাঃ স্কটের বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর দু'কন্যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরলেন, জাহাজে 'ভগ্নহৃদয়' লিখতে লিখতে। বিলেতে তাঁর ইংরেজির উপর এতই দখল জন্মেছে যে সাহিত্যের ইংরেজ অধ্যাপক তাঁর লেখার স্টাইলে প্রশংসা করলেন।
দেশে ফিরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'মানময়ী' গীতিনাট্যের জন্য গান রচনা ও অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেছেন। 'ছেলেবেলায়' লিখেছেন-
'এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম সুর তৈরী করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে। তখনি তখনি সেই ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে রাখবার কাজ ছিল আমার।'
১৮৮১ সালে রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবের জন্য প্রথম ব্রহ্মসংগীত রচনা করলেন।
'বাল্মীকি- প্রতিভা' রচনা করলেন, বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করলেন। 'রুদ্রচণ্ড' ও 'ভগ্নহৃদয়' নামে কাব্যনাটক লিখলেন। সে সময়ে 'বউ ঠাকুরানীর হাট' (উপন্যাস) ও সন্ধ্যা সংগীত (কবিতা) লিখতে আরম্ভ করলেন।
১২৮৮ সনে রবীন্দ্রনাথের 'সন্ধ্যা-সঙ্গীত' প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) রবীন্দ্রনাথের 'সন্ধ্যা-সঙ্গীত' পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার আগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে 'বাল্মীকি-প্রতিভা' গীতি নাট্যের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
১২৮৯ সনের শ্রাবণ মাসে রমেশ চন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা কমলার সঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুর বিয়ে হয়। সে বিবাহ সভায় বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বিবাহ সভায় রমেশবাবু এক গাছি মালা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের গলায় পরাতে এলে, বঙ্কিমচন্দ্র সেই মালাটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়ে, এ মালা এঁরই প্রাপ্য বলে তাঁকে অভিনন্দিত করেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বঙ্কিমচন্দ্র' প্রবন্ধে এ ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন-
"একদিন আমার প্রথম বয়সে কোনও নিমন্ত্রণ সভায় তিনি নিজ কণ্ঠ হইতে আমাকে পুষ্পমাল্য পরাইয়া ছিলেন। সেই আমার জীবনের সাহিত্য-চর্চার প্রথম গৌরবের দিন।.. তদপেক্ষা পুরস্কার আর এ
জীবনে প্রত্যাশা করিতে পারিব না।"
১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' পাঠ করে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য তরুণ কবিকে অভিনন্দন প্রেরণ করেন। কবি হিসেবে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন কবি।












সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম গ্রেপ্তার
নাগরিক সেবার ফি ৫ গুণ বৃদ্ধি করল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়ল
কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর অভিযানে বিপুলপরিমাণ মাদকসহ আটক ৪
কুমিল্লায় বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী পালিত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন হচ্ছে আধুনিক ডিসি পার্ক
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম গ্রেপ্তার
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী আজ
কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থেকে আয় হলেও চালু হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ রুট
এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতেকুমিল্লায় শিবিরের বিক্ষোভ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২