গভীর
রাত্রিতে গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতেও পারি না।
পাশের বাসার টিনের চালে বৃষ্টি বিন্দুর ইচ্ছে মতো ঝরে পড়ার হৈ চৈ শব্দে ঘুম
ভেঙে গেলো শেষ রাতে। এপাশ ওপাশ করতে করতেও ঘুম আসে না চোখে। এদিকে থামতে
শুরু করলো বৃষ্টি ঝরা। ধীরে ধীরে আলোকিত হতে লাগলো ধরনী। কিন্তু শেষ
রাত্রের বৃষ্টির তাড়নায় এখনো ঠান্ডা আমেজে জড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের
আবহাওয়া। আমার রুমের ফ্যান চলতে থাকায় ক্রমশঃ শীতের তীব্রতা যেনো বেড়েই
চলেছে। আরো কিছুক্ষণ ঘুমানোর আশায় পাতলা নক্সী কাঁথাটি গায়ে জড়িয়ে পাশ
বালিশটা আরো কাছে টেনে নিয়ে মেডিটেশন করতে করতে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হলাম।
ঘুম থেকে জেগে উঠে দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখতেই অবাক হয়ে গেলাম। ৯টা বেজেছে!
বৃষ্টির দিনে আসলেই বেশ ভালো ঘুম হয়। পৃথিবীর প্রচলিত নিয়মের আবর্তে আজ (২
জুলাই ২০০২) সূর্য উঠেছে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে। পুরো পৃথিবীকে সে রক্তিম
আভা তীব্র তাপের সাথে কতটুকু উত্তপ্ত করেছে জানিনা, তবে বাংলাদেশের আষাঢ়
মাসের এই সকালে সূর্য তাপের তীব্রতা একেবারেই কোমল। নিজের রুমটাকে নিজের
মনের মতো পরিপাটি করে গুছিয়ে যাবতীয় অল্প সল্প ঘরের কাজকর্ম সেরে সকালের
নাস্তা করেই ঝটপট কলেজের জন্যে তৈরী হতে লাগলাম। আবারো আকাশে মেঘ জমেছে।
আবারো বৃষ্টি বিন্দু ঝরতে শুরু করেছে। আষাঢ় মাসের এই সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি
শান্ত বৃষ্টির সুগভীরতায় হৃদয় মন নিমগ্ন করে প্রকৃতিলোকে তাকাতে তাকাতে
বুঝা গেলো অঝর ধারায় হৃদয়ের তন্ত্রীতে ঠিক তেমনি অনুভব যোগ্য শীতল বায়ু বয়ে
চলেছে, যেমন করে অনুভূত হয় ভালোলাগার সুকুমার স্পর্শ কিংবা কষ্টের
তীব্রতা। প্রতিদিনই তো বৃষ্টি ঝরে মাটিতে, প্রতিদিনই তো বৃষ্টি ঝরছে আকাশ
হতে, বৃষ্টি ঝরে হৃদয়ে। কিন্তু আজ ! আজ কেনো এমন হচ্ছে? জানিনা। জানিনা, আজ
কেনো এমন অনুভূতি হলো!

কলেজে
পৌঁছুলাম সাড়ে দশটায়। অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন স্যারের ক্লাস শুরু হতে এখনো
১৫ মিনিট সময় আছে। এরই মাঝে দু'একটা প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম। যথাসময়ে
স্যার ক্লাসে আসলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, তোমাদের পরবর্তী ক্লাসটা আজ হবে
না। ম্যাডাম ব্যস্ত আছেন। ক্লাসটা হবে আগামীকাল। তখন আমরা সবাই বলে উঠলাম,
স্যার আগামীদিন তো আমাদের ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেওয়ার দিন। তাছাড়া টাকা
জমা দেওয়ার পর যদি সময় হয় তবে রুটিন অনুযায়ী বুধবারের ক্লাস গুলো হবে। তার
উপর আবার অতিরিক্ত একটি ক্লাস কি করে হবে? স্যার সাথে সাথেই একটা গল্প
বললেন। 'অশ্বসেন এর কন্যা সাবিত্রী বিয়ে করতে চান সত্যবাগকে। ব্রাক্ষ্মণ
সাবিত্রীর এই ইচ্ছা সম্পর্কে জানার পর বললেন, সত্যবাগ আর মাত্র ১ বছর
বাঁচবে। তখন সবাই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লো। এ সময় দৈব বাণী এলো যে, এ
অবস্থায় সাবিত্রী যদি সত্যবাগকে বিয়ে করে তবে তাকে একটা বর/ আশীর্বাদ দেয়া
হবে। জিজ্ঞেস করা হলো সাবিত্রীকে, সে কোনো একটি জিনিস চাইতে পারবে। এখন সে
কি নিবে? সাবিত্রী বললো, আমি শত পুত্রের জননী হতে চাই।' স্যার বললেন, এখন
তোমরাই বুঝে নাও এর পর কি হতে পারে? আমরা ও বুঝে নিলাম যে আমাদের পরবর্তী
ক্লাসটা আসলে আর হবেই না। ম্যাডাম সরাসরি "না" না করে একটু ঘুরিয়ে বললেন
ক্লাসটা কাল নিবেন এই আর কি! আর আমরাও এ কথা শিখে নিলাম যে, যে কোনো কথা,
কাজ সরাসরি "না" না করে একটু ঘুরিয়ে বলাই ভালো। এখানে একটি কথা না বললেই নয়
যে, স্যার সবসময় আমাদেরকে যে কোনো বিষয় সহজ ভাবে বুঝানোর জন্যে এক একটি
গল্পের আশ্রয় নেন। এমন কি একটি শব্দ সম্পর্কেও যদি আমাদের কোনো ধরনের
সমস্যা হয় তবে স্যার গল্পের মাধ্যমে নিমেষেই তার সমাধান করেন। এরপর স্যার
আমাদের উপস্থিতির পারসেনটেজ নিলেন। সাথে সাথেই ক্লাসে নোটিশ নিয়ে এলেন
মুজিব দাদু। স্যার বললেন ওদের (আমাদের) তো কোনো নেটিশ থাকার কথা নয়। আচ্ছা
তবুও দেখি। স্যার নোটিশ পড়লেন। আমরা মনোযোগ সহকারে শুনলাম। চট্টগ্রাম
সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্রীদের ইউনিফর্ম চেঞ্জ হচ্ছে। সাদা কামিজ সাদা
সেলোয়ারের পরিবর্তে সাদা এপ্রোণ বা সাদা গাউন পড়তে হবে। গাউনের দুই পকেটে
দেয়া থাকবে কমলা রং এর বর্ডার। নোটিশ পড়া শেষে স্যার বলতে শুরু করলেন,
সেদিন একটা গল্প পড়েছি "প্রথম আলো" পত্রিকার 'আলপিন' এ। যারা পড়েছো চুপচাপ
থাকো, যারা পড়নি মনোযোগ সহকারে শোনো। --- ঈশ্বর প্রথমে গাধাকে সৃষ্টি করে
বললেন, তুমি লতাপাতা গাছপালা খাবে আর আমার পূজা করবে। এজন্যে তোমাকে ৫০ বছর
দেয়া হলো। তখন গাধা বললো, আমার ৩০ বছর হলেই চলবে। বাকী ২০ বছরের প্রয়োজন
নেই। এরপর ঈশ্বর কুকুর সৃষ্টি করে কুকুরকে বললেন, তুমি গাধার উচ্ছিষ্ট খাবে
আর প্রভুভক্ত হয়ে থাকবে। তোমাকে দেয়া হলো ৩০ বছর। তখন কুকুর বললো, সব ঠিক
আছে, কিন্তু বয়সটা একটু বেশীই হলো। আমার ১৫ বছর হলেই চলবে। বাকী ১৫ বছরের
প্রয়োজন নেই। এরপর ঈশ্বর বানর সৃষ্টি করে বানরকে বললেন, তুমি থাকবে
বন-জঙ্গলে। তোমার কাজ হলো শুধু এক গাছ হতে অন্য গাছে ঘুরে বেড়ানো, আর
বন-জঙ্গলের ফলমূল খাওয়া, এ জন্যে তোমাকে দেয়া হলো ২০ বছর। তখন বানর বললো,
আমার ১০ বছর হলেই চলবে। বাকী ১০ বছরের প্রয়োজন নেই। এরপর ঈশ্বর সৃষ্টি
করলেন মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আশরাফুল মাকলুকাত। মানুষকে ঈশ্বর বললেন,
আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি সেরা জীব হিসেবে তোমাকে দিয়েছি জ্ঞান, বিবেক,
বুদ্ধি এবং তোমাকে দিয়েছি ২০ বছর। তখন মানুষ বললো, আমাকে মাত্র ২০ বছর না
দিয়ে গাধা, কুকুর ও বানরের ফিরিয়ে দেয়া বয়সগুলোও দিন। মানুষকে তাই দেয়া
হলো। এবার স্যার বললেন, ২০ বছর পর্যন্ত আমরা সত্যিই মানুষ থাকি। এরপর গাধার
মতো ৩০ বছর খাটাখাটি করে ১৫ বছর প্রভুভক্ত কুকুরের মতো সন্তানদের গুছিয়ে
দেওয়ার ব্যবস্থা করি এবং শেষ বয়সে বানরের মতো কিছুদিন এক পুত্রের কাছে
কিছুদিন অন্য পুত্রের কাছে আসা যাওয়া থাকা খাওয়ার মধ্যে বাকী বয়সটা কাটিয়ে
দিই। স্যার বললেন, আমি মানুষ বয়স পার করে গাধার বয়সও পার হতে চলেছি। আর
মাত্র কয়েক মাস পরেই আমার গাধার জীবন শেষ হবে। আমার এই হাটে বেঁচা কেনা
বন্ধ হবে। আজই তোমাদের সাথে আমার শেষ ক্লাস।
আমি দ্রুত হিসেব করে নিলাম,
আসলেই আজকে স্যারের সাথে আমাদের শেষ ক্লাস। এরপর যখন আমরা এম.এ তে ক্লাস
করতে আসবো তখন স্যার আর কলেজে থাকবেন না। আমরা শুনবোনা তাঁর আন্তরিকতায়
পরিপূর্ণ লেকচার। শুনবোনা আর নিত্য নতুন কাহিনী ও চির পুরাতন বিভিন্ন
গল্প। স্যারের পায়ের চিহ্ন পড়বেনা আর আমাদের ক্লাসে। হয়তো তিনি আমাদেরকে
দেখতে আসবেন কিন্তু দরদ মিশানো সেই কন্ঠে আর আমরা নিত্য নতুন শেখার মতো
কিছুই পাবোনা! স্যার প্রতিদিন ক্লাসে যেভাবে আন্তরিকতার সাথে দরদ দিয়ে
বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের পড়াতেন ঠিক তেমনি আজও নির্বিকার চিত্তে অনায়াসে এক
নাগাড়ে বিদায়ের করুণ কাহিনী বলে যেতে লাগলেন। জানিনা, কার মধ্যে কিরূপ
প্রতিক্রিয়া হয়েছে তবে শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, স্যারের কথা শুনতে
শুনতে আমার হৃদয়ের সবগুলো তার, সুরের তার কে যেনো টেনে নিয়ে চলেছিলো।
কিছুক্ষণ পরই যেনো সবগুলো তার ছিঁড়ে যাবে। বাইরের বৃষ্টির সাথে হৃদয়ের
তন্ত্রীতে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে বেশ বুঝতে পেরেছি। আমি এতোটাই কাতর,
বিহ্বল হয়ে পড়েছি যে, দীর্ঘ আলাপের পর ক্লাস থেকে স্যার যখন শেষ বারের মতো
চলে যাচ্ছিলেন আমার আর দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও ছিলো না। ম্রিয়মান হয়ে ছিলাম
বেঞ্চির কোলে।
অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক স্যার কখন যে আমার প্রিয়
শিক্ষকের তালিকায় শীর্ষ আসনটি দখল করেছেন বুঝতেই পারিনি। স্যারের সাথে
আমাদের পরিচয় মাত্র বছর খানিকের। এরই মাঝে উনার লিখিত বেশ কয়েকটি বই পড়া
হয়েছে। আসলে একটাই দুঃখ, এখনো স্যার সম্পর্কে যে অতি অল্পই জানি। বেশী
কিছুতো জানিনা। তবে চেষ্টা করবো সময় এবং সুযোগ করে স্যারের কাছাকাছি গিয়ে
স্যার সম্পর্কে পুরোপুরি জানার। খুব চেষ্টা করবো খুব। এমন অসাধারণ
প্রতিভাধর একজন আদর্শ শিক্ষকের আরো সান্নিধ্যে, অতি নিকটে যাবার আপ্রাণ
চেষ্টা করবো। সেদিন ক্লাস শেষে ভারী মন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় ফিরে
এসে আমি আমার "গোলাপী রূমে" ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেক কেঁদেছি; খুব কেঁদেছি,
খুব। কেনো জানিনা।
(বি: দ্র:- এই লিখাটা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র 'দৈনিক আজাদী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৫ জুলাই ২০০২)
নিয়মিত
লেখালেখির অভ্যাস থাকলেও মাঝে কিছু বছর লেখালেখি থেকে একটু দূরে ছিলাম
নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে। আমার সন্তানেরা একটু বড় হলে পর
২০০০ সালে করোনার সময় আবারও আমি ফিরে পেলাম আমার লেখালেখির সান্নিধ্য জীবন।
নিয়মিত পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগলো আমার হরেক রকমের লেখা।
"ড.
নিজামুদ্দিন জামি, শান্ত মারিয়ম ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
'আজকের প্রত্যাশা' পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক। এর চেয়েও বড় পরিচয় উনি
আমার ফটিকছড়ির ভাই"। আজকের প্রত্যাশা পত্রিকাতেও আমার কিছু লেখা প্রকাশিত
হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন ' অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন
ভৌমিক' স্যারকে নিয়ে জামি ভাইয়ের একটা লেখা 'দৈনিক পূর্বদেশ' পত্রিকায়
প্রকাশিত হলে তা দেখে আমি সাথে সাথেই জামি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম।
স্যারের খোঁজখবর নিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আমাকে স্যারের সাথে যোগাযোগ
করিয়ে দিলেন। যুক্ত হলাম শান্তিরঞ্জন স্যারের এফ.বি ফ্রেন্ড লিস্টে। বহু
বছর পর আমি আবার ফিরে গেলাম আমার কলেজ জীবনে! এ এক অন্যরকম অনুভূতি!
প্রিয়জনকে হারিয়ে বহু বছর পর আবার ফিরে পাওয়া!
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব"..
আমার
প্রিয় শিক্ষককে খুঁজে পেয়ে আমি বিস্মিত, আনন্দিত। আসলে মানুষের
ইচ্ছাশক্তিটাই সবচেয়ে বড়! ঐ যে আমার ইচ্ছে ছিলো, স্যারের কাছাকাছি গিয়ে
স্যার সম্পর্কে জানার.....! দীর্ঘ ১৯বছর পর আবার স্যারকে খুঁজে পেলাম!
স্যারের কাছাকাছি যেতে না পারলেও মনে হচ্ছিলো এখনও আছি আমরা একসাথে। আবার
নতুন করে আমাদের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলোতে, সেই প্রাণের উদ্দীপনা, উল্লাস ও
উচ্ছ্বাসে ভরা দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছি। শিক্ষক শিক্ষিকা ও ছাত্রীরা মিলে
আমরা ছিলাম একটি পরিবার। যে পরিবারে শ্রদ্ধা, হৃদ্যতা ও অপার ভালোবাসা ছিলো
বিদ্যমান। যার কিছুই এতোবছর পরেও একটুকুও মলিন হয়নি। যে ভালোবাসা-শ্রদ্ধার
কোনো তুলনা হয় না। স্যারের সাথে ফোনে কথা বললাম। সেই দরদ মেশানো স্নেহ
মাখানো মায়া ভরা কন্ঠে কথা বললেন। কুশলাদি বিনিময় শেষে জানতে চাইলেন, আমার
কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে কিনা? তাঁর ধারণা মতে, এরই মাঝে আমার অনেকগুলো বই
প্রকাশ হওয়ার কথা। স্যারকে বললাম এখনও বই প্রকাশ হয়নি। স্যার, আপনাকে
জানিয়েই প্রকাশিত হবে আমার বই। ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে আমার বহু
লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এরপর কয়েকজন শুভাকাক্সক্ষীর
পরামর্শে বই প্রকাশ করার মতো দুঃসাহসিক কাজে হাত দিলাম। ২০২৫ এর
ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করার জন্য যখনই প্রস্তুতি
নিলাম সাথে সাথেই স্যারকে জানালাম। এরপর স্যারের কাছে বইয়ের কপি পাঠালাম।
তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে ভালোবেসে সুদূর কুমিল্লা থেকে সময়মতো আমার
প্রথম বইয়ের ভূমিকা লিখে পাঠিয়ে আমাকে স্নেহধন্য করেছেন। আমি কৃতার্থ, চির
কৃতজ্ঞ, চিরঋণী স্যারের কাছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও উনি আমার মতো নগণ্য
মানুষকে স্নেহ করেছেন, ভালোবেসেছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন। অমর একুশে বইমেলা
উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা "চট্টগ্রামের পর্যটন, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা"
নামক প্রবন্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন আমার প্রিয় স্যার। এতেই
আমি খুশিতে আত্মহারা।
যখন জানলাম, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রাক্তন
স্টুডেন্টস স্যারের ৮০ তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছে।
মনে হলো, আমার অনুভূতি প্রকাশ করার একটু সুযোগ পেলাম। শ্রদ্ধেয়জন প্রিয়
স্যারকে নিয়ে কিছু লেখার মতো দুঃসাহস আমি দেখাতে পারি না..! তবু মনে হচ্ছে
একটু লেখা দরকার! কলেজ জীবনে তাঁকে প্রথম দেখলেও এরই মাঝে তাঁর অনেক লেখা
পড়েছি। তাঁকে নিয়ে লেখা অনেক লেখকের লেখা পড়ে অনেক কিছুই জেনেছি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে, আন্দোলনে, সংগ্রামে, রাষ্ট্রবিপ্লবে তিনি সম্পৃক্ত
ছিলেন, আছেন। সবাই তাঁকে ভালোবাসে, সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়ে অভিষিক্ত করে। এই
সৌভাগ্য তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই। একথাও সত্য যে, আজ আমরা যে সৎ ও মহৎ
মানুষটাকে দেখছি, তাঁকেও অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে, অনেক শ্রমের
বিনিময়ে, বিপরীত ও বিষম স্রোত ঠেলে একজন ' অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক' হয়ে
উঠতে হয়েছে। এই কথাটি স্বীকার করতেই হয়, তাঁর মৃদু ও শান্তভাব, ধীরস্থিরতা,
তাঁর বিনয় ও সৌজন্য আমাদের এতোটাই মোহিত করে যে তাঁর স্বভাবের অন্যদিকটা
অর্থাৎ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুনের যে ধারা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত হয় তা
যেনো আমাদের চোখে পড়তেই চায় না। তাঁর প্রতিবাদ যুক্তিনির্ভর কিন্তু
উচ্চকণ্ঠ নয়। আমরা জানি যুক্তির সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক বিদ্যমান। তাছাড়া
প্রতিরোধ প্রধানত কর্ম-নিয়ন্ত্রিত, বাকচাতুর্য তাকে শক্তিহীনই করে ফেলে।
তিনি যখন প্রতিবাদ করতে গেছেন, এমনকি প্রতিরোধও করেছেন, তখনও মুখের মৃদু
হাসিটি বিসর্জন দেননি, হারিয়ে ফেলেননি তাঁর সাহিত্য চর্চার রসবোধ। তাঁর
লেখা পড়লেই বোঝা যায় রসবোধই মৌলিকভাবে জীবনবোধ। সারা পৃথিবীর যে কোনো দেশের
যে কোনো ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে একই সমতলে দাঁড়ানো বাংলাদেশের অতি
সাধারণ মানুষের পাশেও তিনি দাঁড়ান হাসিমুখে। মুখের হাসিকে সঙ্গী করে তিনি
গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ইতিহাস। কখনো বদলায়নি তাঁর
নিজস্ব চরিত্র, শুধু দেশকাল ঘটনাপ্রবাহের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাতে
যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। কখনো বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কখনো
বাঙালি জাতিসত্ত্বা, কখনো রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, তারপর বাঙালির
আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের শেষ লক্ষ্য- মুক্তিযুদ্ধ-সংগ্রামের এসব নানা
মাত্রায় তাঁর নিজস্ব কর্মজগৎ আজ পূর্ণ সমৃদ্ধ।
অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন
স্যারের চিন্তা ভাবনার মধ্যে কোনো অন্ধকার শব্দ নেই। তিনি ভাবেন আলোর মতো।
তাঁর ভাবনায় আলোকিত হয় সবকিছু। তিনি শিক্ষক, দর্শক, বিশ্লেষক এবং
ঘটনামাত্রার বর্ণনাকারী। তাঁর জীবনের লক্ষ্য জানা এবং শব্দ শৈলীর গঠনে তা
অন্যদেরকে জানিয়ে দেওয়া। তিনি তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের লেখনীর মধ্যে
নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, উদ্ভাসিত করেছেন, করেছেন প্রসারিত। এক্ষেত্রে তিনি
ব্যবহার করেছেন তাঁর নিরাসক্ত ব্যক্তিবাদ। বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করার মধ্য
দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন বিভিন্ন গন্তব্যে। তাঁর বুদ্ধিবাদিতার কেন্দ্রে
জ্বলজ্বল করছে হীরকের দ্যুতি, যে দ্যুতির আলোকছটায় আলোকিত হয় চারপাশ।
বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন তিনি পাঠ করেছেন তেমনি আমাদেরকেও তা পাঠ করতে
শিখিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য কর্ম অপ্রতিরোধ্য। তিনি হাসতে হাসতেই বলেন, 'দেখো,
জীবনে কতো কিছু শেখার আছে!' তিনি যা ভাবেন তা বলেন, যা বলেন তা লিখেন।
তিনি বলেন, 'চিরন্তন মানবিক সমস্যার হয়তো কোনো সমাধান নেই, কিন্তু লড়াই তো
করে যেতে হবে'। সেখান থেকে তিনি কখনোই সরে যাননি। যে কোনো অবস্থায় আমাদের
লড়াই করে যেতে হয়, লড়াই ছাড়া চিন্তা শাণিত করা যায় না, শাণিত চিন্তা ছাড়া
সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের ভাবনা ছড়িয়ে দেয়া যায় না। সব সময় সফলতা আসবে এমন নয়।
সার্থক হওয়াটা বড় কথা নয়, লড়াই করাটাই বড়। সে জন্য তাঁর চিন্তা অমোঘভাবে
মানবিক হয়েছে আর মানবিক হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি স্পর্শ করেছেন বিশাল আকাশ। এই
মহৎ হৃদয়ের মানুষটি কল্যাণমুখী কর্মের অধিকারী। তাঁর মৃদু প্রসন্ন হাসিতে
কল্যাণের ছোঁয়া লেগেই থাকে। বড় স্নিগ্ধ তাঁর ব্যক্তিত্বের আভা, অনেকটা দূর
পৌঁছায় সেই আভা, বিক্ষোভের জ্বালা জুড়িয়ে দেয়, সংকটে-বিপদে অভয় মেলে,
কঠিনকে অজান্তেই সহজ করে দেয়। তাঁর বুদ্ধি-যুক্তি সামাজিকভাবেই ধাতস্থ।
নৈতিকতার ঔজ্জ্বল্যেই তা আলোকিত। সৃষ্টিশীলতা-সৃজনশীলতার পথে তিনি হেঁটে
গেছেন দৃঢ়-দৃপ্ত পায়ে। একজন গুণী মানুষের পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে তিনি যে আলো
ছড়িয়ে গেছেন তা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে যুগের পর যুগ।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের
ধারক-বাহক ও মুক্ত মনের প্রগতিশীল এই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে আমরা
যতো বেশি চর্চায় রাখবো ততোই সমৃদ্ধ হবো। তিনি বিশ্বাস করেন, "আমরা নিজেদের
বদল করি আমাদের যুগ এবং সংস্কৃতির সমস্যাগুলো বুঝবার মধ্য দিয়ে। এই বোঝার
চেষ্টাটাই আমাদের অনবরত সৃষ্টি করে নতুন মানুষ হতে"। এটা সত্যি, ভবিষ্যৎ
সমস্যা, সমাধান এবং প্রয়োজন কোনোভাবেই আগে থেকে বলা সম্ভব না, আগামী দিন
কেমন হবে তা বলা সম্ভব না, কিন্তু তিনি শান্তভাবে-নম্রভাবে বোঝাতে চেষ্টা
করেছেন প্রতিটি প্রজন্মের সামাজিক-রাজনৈতিক মতাদর্শিক ব্যবস্থার পথ
উন্মুক্ত করে দেবে ভবিষ্যত চাহিদার, ভবিষ্যত প্রয়োজনের। তিনি লেখক, সমাজ
সংস্কারক; সাহিত্যশাস্ত্রী, চিন্তা নায়ক ও বিদগ্ধ বিবেক। তিনি জীবন, শিল্প,
সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন, লেখেন। তিনি তাঁর ভাবনা
চিন্তাকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এ জীবনে যতোটা কাজ তিনি করেছেন তার
মূল্য স্বীকৃতভাবে প্রচুর ও সুস্থায়ী। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী বাংলা সাহিত্যে
প্রায় তুলনাহীন। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যগুলো অসাধারণ রুচি সম্মত। বুদ্ধিতে,
যুক্তিতে, মননে ব্যক্তিত্বের স্বচ্ছ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যে।
এই মনন কোনো নিরস, নির্জীব খন্ড উপাদান মাত্র নয়, তা এক অদ্ভূত সরসতায়
ভরপুর, সপ্রাণতা ও সৃষ্টিশীলতায় স্পন্দিত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক
এবং নান্দনিকভাবে সমস্ত দিক থেকেই তিনি একজন মুক্তলেখক। তাঁর প্রবন্ধে সেই
দায়িত্বেরই প্রতিফলন ঘটেছে। আনন্দময় লেখা যে হাত দিয়ে হয়েছে সেই হাতে আর
কিছু লিখতে সাধ হয় না, তবুও কর্তব্যের খাতিরে লেখার কাজটা অনেক সময় হয়ে ওঠে
মুখ্য কাজ। রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে না হলেও রাজনীতি নিয়েই লিখতে হয়
অনেক ক্ষেত্রে। জাতীয় জীবন এখন এতো জটিল হয়ে পড়েছে যে, তা নিয়ে লেখা নিছক
সাহিত্যিকের কাজ নয়, তার জন্য কিছুটা সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকও হতে হয়।
তিনি তা অনেকাংশেই হতে পেরেছেন। এই ব্যাপক ও দূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির
জন্যই তাঁর অনেক সমসাময়িক প্রবন্ধও যুগোত্তীর্ণ হবে নিঃসন্দেহে।
বাঙালি
জীবনে সততা, মননশীলতা ও উদারতা প্রতিষ্ঠা যাঁদের কাম্য, বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যের উন্নতি যাঁদের অভিপ্রায়, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক স্যারের প্রতি তাদের
সমবেতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করাই বাঞ্ছনীয়। তাঁর দেখার ধরন স্বতস্ত্র, লেখার
ভঙ্গি স্বচ্ছ। গভীর কথাকেও নিতান্ত সহজ করে বলতে পারেন তিনি। যে প্রসঙ্গেই
কিছু বলুন না কেনো তাঁর বক্তব্য শুনতেই হয়। তাঁর চিন্তা ঋজু ও
যুক্তিপূর্ণ, মতামত দ্বিধাহীন ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। প্রসঙ্গ সাময়িক হলেও
জীবনবোধ থেকে উৎসারিত বলে প্রতিটি মতামত অমূল্য। চিন্তার স্পষ্টতায়, ভাষার
স্বচ্ছতায়, বিশ্লেষণের ব্যাপকতায়, উপলব্ধির গাঢ়তায়, প্রত্যয়ের দৃঢ়তায়
শান্তিরঞ্জন স্যারের প্রবন্ধগুলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। তাঁর একটি
লেখাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এক কথায় নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না তাঁর
চিন্তার যুক্তি পরম্পরাকে। তিনি সেই বিরল প্রাবন্ধিকদের মধ্যে অন্যতম
যাঁদের রচনা পরবর্তীকালেও প্রাসঙ্গিকতাপূর্ণ থাকে, যা আমাদের বহু
ভাবনাচিন্তার সমস্যা কিংবা সংকটের জট ছাড়াতে, কর্মপন্থা নির্বাচন করতে
সহায়ক হয়ে উঠে। তাঁর প্রবন্ধে প্রায় সর্বত্রই অসামান্য অর্ন্তদৃষ্টি ও
ভাষার নিপুণতা লক্ষণীয়। তাঁর বৈদগ্ধ এবং সংবেদনশীলতা যতটা প্রখর, তাঁর
দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিকতা যতটা স্বচ্ছ এবং যুক্তিবিন্যাসের দৃঢ়তা যেমন
সিদ্ধহস্ত, তেমনি তাঁর ভাষার গতিশীলতায় পাঠক হিসেবে আমারা অভিভূত হই।
নির্লোভ,
নিরহংকারী, সাদামাটা জীবন যাপনকারী আমার প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক
শান্তি রঞ্জন ভৌমিক স্যারের জন্য রইলো আমার অনিঃশেষ ভালোবাসা। শান্তিতে
কাটুক আপনার পরবর্তী জীবন। আপনার ৮০ তম জন্মদিন উদযাপনের এই শুভ মুহূর্তে
আপনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আপনার জ্ঞান, আদর্শ ও স্নেহ
আমাদের জীবনের অমূল্য সম্পদ। আপনি শুধু একজন শিক্ষক নন বরং আমাদের জীবনের
প্রতিটি ধাপে অনুপ্রেরণার উৎস। আপনার দীর্ঘ জীবন হোক আরও শান্তিময়, সুস্থ ও
আনন্দময়। আপনি আমাদের জীবনে যেমন আলোর দিশারী হয়েছেন, তেমনি আপনার জীবনও
হোক আনন্দ আলোয় ভরা। আপনার জন্যে অনেক অনেক শুভকামনা।
নুসরাত সুলতানা
চট্টগ্রাম