শুক্রবার ৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
বাহার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার সাইফুলের কাজগুলো এখন করছে কারা?
জহির শান্ত
প্রকাশ: শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ১:৫৮ এএম আপডেট: ২১.০৩.২০২৫ ২:২৩ এএম |


বাহার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার সাইফুলের কাজগুলো এখন করছে কারা? ২০২২ সালের জুনে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত দায়িত্ব পাওয়ার পরই ঠিকাদারি কার্যক্রম শুরু হয় বহুল আলোচিত ঠিকাদার সাইফুল ইসলামের। এরপরই যেনো আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান তিনি। দুই অর্থ বছরে বাগিয়ে নেন ২৩১ কোটি টাকার ঠিকাদারী কাজ। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় চাওর রয়েছে- পলাতক সাবেক এমপি বাহার সিটি কর্পোরেশনের যে সমস্ত কাজ নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছিলেন সেগুলি মূলত সাইফুলের ঠিকাদারি লাইসেন্স এর মাধ্যমে নেয়া হয়েছিল। একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর আরফানুল হক রিফাত প্রয়াত হলেও নগর ভবনে প্রভাব কমেনি সাইফুলের। এরপর বাহার কন্যা সূচনা মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ভাগ্য যেনো আরো খুলে যায়। দখলে নিতে থাকেন একের পর এক উন্নয়ন কাজের টেন্ডার। হঠাৎ করে নগরভবনে সাইফুলের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় নাখোশ ছিলেন আওয়ামীপন্থী অন্যান্য ঠিকাদাররাও। বলা হয়ে থাকে অন্য ঠিকাদারদের পাশ কাটিয়ে বাহার ও সূচনা নগরীর উন্নয়নকাজগুলো নিজেদের মতো করে টাকা হাতিয়ে নিতেই সাইফুলকে ব্যবহার করতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বদলে যায় সব চিত্র। ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বাহার-সূচনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও ঠিকাদাররা। এরপর সময় যতো গড়িয়েছে; একে একে বের হয়ে এসেছে থলের বিড়াল। এরই মধ্যে ঠিকাদার সাইফুলের বিষয়ে তথ্য জানতে নগর ভবনে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন -দুদকের একটি দল। 
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী কাজগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই অর্থ বছরে এন এস গ্যালারীর সাইফুলের নামে যে ঠিকাদারী কাজগুলো নেওয়া হয়েছে- ইতোমধ্যে সেসব কাজের ৮০ শতাংশেরও বেশি বিল উত্তোলন করে ফেলা হয়েছে। ঠিকাদার সাইফুল দেশ ছেড়ে পালিয়ে সুদূর আমেরিকা চলে গেলেও তার নামীয় লাইসেন্সের অসমাপ্ত ঠিকাদারী কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে কথিত ‘প্রতিনিধির’ মাধ্যমে। সময়ে সময়ে বিলের টাকাও জমা হচ্ছে তার একাউন্টে। যদিও প্রশ্ন উঠেছে- সাইফুলের ‘প্রতিনিধি’ নামে তার ঠিকাদারী কাজগুলো চালিয়ে নিচ্ছেন কারা? ব্যাংকগুলোর একাউন্ট থেকে কিভাবে সাইফুল টাকা তুলছেন? ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী তো দেশে না থাকা লোক টাকা তুলতে পারার কথা নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই বিএনপির কর্মী ও সিটি কর্পোরেশনের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর- যারা বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি কর্পোরেশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে কুমিল্লা সিটিকর্পোরেশনে গিয়ে জানা যায়, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কুমিল্লা সিটিকর্পোরেশনের ২৩১ কোটি টাকার ৩১টি উন্নয়ন কাজ পেয়েছেন মেসার্স এন এস গ্যালারীর সাইফুল ইসলাম। এসব কাজের জন্য বরাদ্দের প্রায় ৮০ শতাংশ টাকাও উত্তোলন করে নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় থেকে রাণীর বাজার সড়কটি সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য বরাদ্দ ছিলো ৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এ কাজের ২০ শতাংশের বেশি বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে সাইফুলের একাউন্ডে চলে গেছে ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ৫ নং ওয়ার্ড পুরাতন চৌধুরী পাড়া এলাকায় রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য বরাদ্দ হয় ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে এ কাজের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে গেলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এ প্রকল্পের কাজ অর্ধেক শেষ না হলেও ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা জমা হয়ে গেছে ঠিকাদারের একাউন্টে। নগরীর ৭নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রমসহ আশপাশের এলাকার একটি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৭০ শতাংশ। ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার ওই প্রকল্পের ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকাই তুলে ফেলা হয়েছে। 
একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে, অন্যান্য কাজগুলোর ক্ষেত্রেও। নগরীর ১২ নং ওয়ার্ড এলাকার বজ্রপুর, নানুয়ার দিঘির পাড় ড্রেন/সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার মধ্যে ঠিকাদার সাইফুলের একাউন্টে জমা পড়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের উনাইসার এলাকার রাস্তা-ড্রেন  নির্মাণে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার মধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ না হওয়ার আগেই ঠিকাদারের তহবিলে চলে গেছে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। 
শুধু এ কয়েকটি প্রকল্পই নয়; এমপি বাহারের আনুকূল্যে সাইফুলসহ অন্যান্য ঠিকাদাররা যে সকল কাজ পেয়েছেন সবগুলোরই একই চিত্র। কাজ করে; না করে বেশির প্রকল্পের টাকাই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সেসব টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতে পালিয়ে থাকা সাবেক এমপি বাহার ও তার কন্যা অপসারিত মেয়র সূচনার কাছে। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সূত্র। 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়েম ভূইয়া বলেন, এন এস গ্যালারীর সাইফুল ইসলাম ২০২২ সাল থেকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে ঠিকাদারী করছেন। তার বিষয়ে তথ্য জানতে দুদকের কর্মকর্তারা এসেছিলেন। আমরা তার বিষয়ে তথ্য দিয়েছি। তার চলমান যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোর বিষয়েও তথ্য দেওয়া হয়েছে।
সাইফুল পলাতক, তার কাজগুলো কারা চালাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে সায়েম ভূইয়া বলেন, আমরা মূলত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হই। ঠিকাদারের সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ না হলেও সমস্যা নাই, তারা প্রতিনিধিরাই কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। কাজ শেষে প্রকল্পের বরাদ্দের টাকাও ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের একাউন্টেই জমা হচ্ছে। 
তার দাবী, সাইফুলের ঠিকাদারী কাজের প্রায় ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে।
এ আগে বুধবার দুপুরে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে ঠিকাদার সাইফুল অনিয়মনের বিষয়ে অভিযান শেষে দুদক কুমিল্লা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা কার্যালয় নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত দল তথ্য নিতে এসেছিলাম। আমরা ঠিকাদার সাইফুল ইসলামের কাগজপত্রগুলো চেয়েছি এবং সেগুলো পর্যালোচনা করছি। 
তিনি আরো জানান, সাইফুল ইসলাম ২০২-২৩ অর্থবছরে ১০ টির মত টেন্ডার পেয়েছেন। যার আনুমানিক মূল্যমান ৫৯ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। পরবর্তীতে ২৩-২৪ অর্থবছরে তিনি টেন্ডার পেয়েছেন ২১ টির কাজের। যেগুলোর আনুমানিক মূল্যমান প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তিনি কাজটি নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করেছেন। আমরা যে আইডিগুলো পেয়েছি সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন ঢাকা অফিসে পাঠাবো। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসবে পরবর্তী কার্যক্রম সে অনুযায়ী নেয়া হবে। 
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার শামছুল আলম জানান, দুদক আমাদের কাছে যেসব তথ্য চেয়েছেন আমরা সেসব তথ্য দিয়েছি। সকল তথ্য ও প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে রয়েছে - তারা যা যা চান সকল তথ্যই পাবেন। দুদকের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার কিছু নেই।
তার ভাষ্য, দুই অর্থবছরে সাইফুল এতোগুলো কাজ পেলেও এতে অনিয়ম হয়নি। দুদক যে তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।


















সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম গ্রেপ্তার
নাগরিক সেবার ফি ৫ গুণ বৃদ্ধি করল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়ল
কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর অভিযানে বিপুলপরিমাণ মাদকসহ আটক ৪
কুমিল্লায় বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী পালিত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন হচ্ছে আধুনিক ডিসি পার্ক
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম গ্রেপ্তার
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী আজ
কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থেকে আয় হলেও চালু হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ রুট
নাগরিক সেবার ফি ৫ গুণ বৃদ্ধি করল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২