এ জগতে সবাই সুখী হতে চায়। এটি খুবই সরল চাওয়া। এক্ষেত্রে সবার চাওয়া এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। জন্মের পরে যখন বুঝার সময় হয় তখন থেকেই মানুষ তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মিলিয়ে সুখী হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। তবে সুখী হতে চাওয়া ও সুখী হতে পারার মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব থাকে। সুখ বিষয়টা মরিচীকার মতো। কবিতার সেই লাইনটির মতো ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’। কে কিসে সুখী হবে তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। বলা হয়ে থাকে সুখ একেবারেই একটি আপেক্ষিক বিয়ষ। এটা নিশ্চিত যে সুখের উৎস ও মাত্রা মানুষে মানুষে ভিন্ন। আমরা যে যার মতো সুখে থাকতে চাই।
সুখী হওয়া কঠিন কিছু নয়। এর মূল চাবিকাঠি রয়েছে নিজের হাতেই। নিজের যতটুকু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে, আনন্দ খুঁজে পেলে সুখী হওয়া কঠিন কিছু না। আর নিজের কাজটা আনন্দ নিয়ে করলেও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা অনেক সময়ই দেখি মানুষ এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত, যা করতে তাঁরা নিজেরাও পছন্দও করেন না। বাধ্য হয়ে অপছন্দের কাজ করতে গিয়ে তিনি হতাশায় ভুগতে থাকেন যা তাঁকে অসুখী করে তোলে। সুখের ক্ষেত্রে বয়স অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবীন হোক আর প্রবীন হোক যারা শারীরিকভাবে সুস্থ, তাঁরা প্রকৃতই সুখী। আবার শিক্ষার সঙ্গে সুখের সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষিতরা যখন তাঁর অর্জিত জ্ঞানকে মানুষের/সমাজের উপকারে কাজে লাগাতে পারে তাহলে বেশি সুখী বোধ করেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মতে ‘তারাই সুখী যারা নিন্দা শুনে এবং নিজেদের সংশোধন করতে পারে’।
সুখ একটি মানবিক অনুভূতি। বইয়ের ভাষায় সুখ হচ্ছে এক ধরণের মানসিক অনুভূতি, একটি জৈব চেতনা যার মাধ্যমে একজনের মধ্যে ভালো লাগার একটা অনুভূতি জন্মায়। একজনের সুখের বিষয় অন্য জনের কাছে সুখের বিষয় হবে এমনটা বলা যায় না। আবার এক একটি ঘটনা বা বিষয় এক একজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সুখের অনুভূতি বয়ে আনতে পারে। সময়, এলাকা, বয়স ও পরিস্থিতির উপর ভর করে সুখের অনুভূতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ সরূপ মরুভূমি এলাকায় বা পাহাড়ি এলাকা থেকে সমতল ভূমির মানুষ নিজেকে বেশী সুখী মনে করেণ। আবার বয়স ভেদে সুখের অনুভূতির ব্যবধান তৈরী হয়। শিশু-কিশোর বয়সে চকলেট-কেক-আইসক্রীম, যুবক বয়সে মটরসাইকেল চালনা বা আধুনিক মোবাইল সেটের ব্যবহার, মাঝ বয়সে নতুন বাড়ি বা গাড়ি আর বৃদ্ধ বয়সে সু-স্বাস্থ্য ও একজন বিশ্বস্ত সংগী মানুষের সুখ ভোগের উপকরণ হয়ে উঠে। তবে একথা ঠিক একান্নবর্তী পরিবারের মানুষগুলো ছোট পরিবারের সদস্যদের তুলনায় বেশী সুখী অনুভব করেন।
সকল দেশের সরকারের মূল কাজ হচ্ছে তার দেশের মানুষদের সুখী করা। বিশ্বজুড়ে নীতি প্রণয়নকারিরা যুগে যুগে মানুষকে সুখী রাখার জন্য বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টাকে জোরদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা ও গুণগত উন্নয়ন প্রচেষ্টা কার্যক্রম গ্রহন করা হচ্ছে। এসব প্রচেষ্টার সব কয়টি উপাদান সবার জন্য সমান উপযোগ সৃষ্টি করতে না পারলেও বেশির ভাগ জনগনের জন্য যেটি উপকারি সেটিই বেশী সুখাস্মৃতি তৈরী করতে পারে। এসব উপাদান মধ্যে যাতে সুখের অনুভূতি বেশি থাকে তা নিশ্চিত করতে পারলেই ঐ দেশের মানুষ মোটামুটি সুখী।
বিশ্ব মঞ্চে নির্দিষ্ট সময়/বছর শেষে সুখী দেশের একটি তালিকা করা হয়। এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। ২০২৩ সালে সুখী দেশের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে ছিল ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। চতুর্থ ইসরায়ল এবং পঞ্চম নেদারল্যান্ডস। এসব দেশের সব কয়টি উন্নত ও সম্পদশালী দেশ। তাই বোঝা যাচ্ছে সম্পদের সাথে সুখের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে এটিও ঠিক সম্পদ থাকলেই হবে না, সম্পদের সুষম বন্টন এবং সম্পদকে ব্যবহার করে জনমানুষের জন্য কল্যাণময় হয় এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেই কোন দেশ সুখী তালিকার উপরে উঠে আসতে পারে। আমাদের কাছাকাছি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান ১৯৭০ এর দশক থেকেই মোট জাতীয় আয়ের চেয়ে মোট জাতীয় সুখকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো চাকচিক্য নয় বরং মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষকে সুখী করে তোলা।
সুখ নিয়ে গবেষণা প্রচুর হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। শিল্প ও সংস্কৃতি আর সাহিত্যে সুখ বিষয়টি সব সময়ই প্রধান্য পায়। তবে সুখ পরিমাপ করা আসলেই অত্যন্ত কঠিন। গবেষক, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যেও সুখের সংঙ্গা নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। তবে এক কথায় বলা যায় সুখ সহজাত কোন বিষয় নয়। আবার দূঃখ আছে বলেই সুখ অনুভব করা যায়। দিন-রাত্রি, আলো-আধারের মতো দূঃখ ও সুখ হাত ধরাধরি করে চলে। নিরবচ্ছিন্ন সুখ সে অর্থে সুখানুভূতির চরম প্রকাশ হতে পারে না। তবে সুখী হবার জন্য শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির নিজের প্রচেষ্টা বা কর্মপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুখ খুঁজে নেয়ার বা পাওয়ার মাধ্যমে আছে আর সেটা অর্জনের জন্য কিছু জিনিষ অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সুখী হবার এমনি কিছু উপাদানের অন্যতম কয়েকটি হচ্ছেঃ
ইতিবাচক চিন্ত করুনঃ ইতিবাচক চিন্তা মানুষের মনোজগতে আশা সঞ্চার করে। আমিও পারবো বা এটি ভালো- এ ধরণের চিন্তা সুখী হতে সহায়তা করে। সবকিছুর মধ্যে ভালো দিকটা খুঁজে নিতে চেষ্টা করুন। কেননা, আপনার সমস্যা আপনি নিজেই বুঝবেন, অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় কাঙ্খিত সুখ পাওয়া যায় না।
প্রতিদ্বন্ধী না ভেবে কাজ করুনঃ অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা না করে বা অন্যকে প্রতিদ্বন্ধী না ভেবে নিজের কাজে দৃঢ় থাকুন। প্রতিদ্বন্ধিতা মানুষের মনের উপর চাপ তৈরি করে। অন্যের সংগে তুলনা করতে গিয়ে নিজের মানসিক শক্তি কমে যায়। এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে এটি হতাশা তৈরী করে। সবার একই রকম বুদ্ধি বা প্রতিভা থাকবে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। তবে সবার সম্মিলিত অবদানেই সমাজ ও দেশ এগিয়ে যায়। তাই নিজের কাজকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে হবে।
নিজেকে, পরিবারকে, বন্ধুকে ভালোবাসুনঃ মানুষ প্রায়শই অন্যদের খুশী রাখতে গিয়ে নিজের কথা ভুলে যায়। কিন্তু ভাল থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নিজের যত্ন নেয়া। নিজেকে ভালোবাসুন। কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখুন নিজের জন্য। ঘুরে আসুন দূরে কোথাও প্রকৃতির কাছাকাছি। শখের বিষয়গুলো চর্চা করুন। পরিবারকে সময় দিন, জেনে নিন তাদের পছন্দ অপছন্দ। উপহার দিন, মনের কষ্ট বন্ধুদের খুলে বলুন, দলবেধে বেড়াতে যান, কবিতা পাঠের আসর করুন দেখবেন সুখী সুখী অনুভব করবেন।
উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলুনঃ সংসারে সবকিছু আপনার মতো চলবে এটা ভাববেন না। শোক কিংবা দূঃখ, উদ্বেগ থাকবেই। তাই বলে এগুলোকে মনের উপর চেপে বসতে দেয়া যাবে না। বেশি উদ্বেগ থাকলে সুখ অনুভব করতে বাধা তৈরি করে। প্রত্যাশা কমিয়ে ফেলুন দেখবেন ঝর ঝরে লাগবে। সব কাজেই যে প্রথম হতে হবে এমন চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। প্রত্যাশা বাড়ানোর ফলে মানুষ হতাশা বোধ করতে পারে। সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে-এ ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যান, দেখবেন ভালো লাগবে।
স্বেচ্ছাসেবী হোন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিনঃ অন্যের জন্য কাজ করুন, সহযোগীতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যান। অন্যের দূঃখ দূর করার মধ্যে নিজের সুখ খুঁজে পাবেন। সমাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলুন। ব্যক্তিগত সময় সামাজিক কাজে বিনিয়োগ করুন। দেখবেন সুখ আপনার জন্য দীর্ঘ স্থায়ী হবে, আপনি আনন্দিত বোধ করবেন।
অতীত, বর্তমানের মধ্যে সংযোগ গড়ে তুলুনঃ অতীত আমাদের বর্তমান ও ভবিৎষতের ভিত্তি গড়ে দেয়। অতীতের অভিজ্ঞতা আপনাকে বর্তমান চলার পথে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে, আরও বেশি সুখী করতে পারে। গবেষকরা বলে পরিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞরা বেশী সুখী থাকেন। পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের কাছে তাদের ফেলে আসা জীবনের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা দরকার। বলা হয়ে থাকে এক একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এক একটি লাইব্রেরীর মতোন, যাদের কাছে জমা থাকে অনেক মোহনীয় স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো আমার/আপনার সামনে এগিয়ে যাওয়ার গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে।
ব্যায়াম করুন, পরিমান মতো খাবার খান, ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন, মাদকমুক্ত জীবন গড়ুনঃ ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। গবেষণায় দেখা গেছে যারা স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন তারা সুখী জীবন যাপন করেন। প্রতিদিন ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত শান্তিময় ঘুম আপনাকে রোগমুক্ত রাখতে, টেনশন মুক্ত রাখতে সহায়তা করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। সব মিলিয়ে এর সব কয়টি আপনাকে সুখী হতে সুযোগ করে দেবে।
পছন্দের ও ভাল কাজকে গুরুত্ব দিনঃ সুখ আর দুঃখ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। তবে আপনি যদি আপনার জীবন ভাল কাজকে, পছন্ধের কাজকে বেছে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন, দেখবেন আপনার জীবনে দুঃখের পরিমাণ কমে গিয়ে সুখে ভরে উঠছে। অক্সফোর্ড-এমআইটির সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, যারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্ট, তারা অন্যদের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি উৎফুল্ল থাকে। সুখী ব্যক্তিরা কর্মক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করে এবং স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও ভালো থাকে। তারা দীর্ঘজীবী হয়।
পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিনঃ বর্তমানে বিশ্ব, দেশ, সমাজ দ্রূত পরিবর্তীত হচ্ছে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের ব্যক্তিগত অনেক আবেগ, আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের সুখী হতে সাহায্য করছে ঠিকই কিন্তু সুখের মানবিক অনেক অনুভূতি দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছে। তাই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের যেগুলো আমাদের জন্য ইতিবাচক সেগুলোকে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সেগুলোর ভাল ফলাফলটা বের করে এনে নিজের জন্য সুখের পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় সুখ কিনতে পাওয়া যায় না বা কারো কাছ থেকে ধারও নেয়া যায় না। সুখ নিজেকে তৈরী করে নিতে হয়। আমার/আপনার দৈনন্দিন জীবন যাপন, আচার-আচারণ, ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা, পরোপকারের ইচ্ছা ইত্যাদি কার্যাবলি আমাকে/আপনাকে সুখী করে তোলার জন্য যথেষ্ঠ। চলুন নিজের উপর আস্থা রাখি, ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখি, পরিবার ও আত্নীয়তার সম্পর্ককে গুরুত্ব দেই। আসুন সবাই মিলে সুখী হওয়ার চেষ্টা করি, পৃথিবীটা সুখময় করে তুলি।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।