পূর্বে প্রকাশের পর
১০৩
বারো
বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পরে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়,
জ্যোতিঃশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রে পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ - ২৯ জুলাই ১৮৯১) কলকাতার সংস্কৃত কলেজথেকে
প্রশংসাপত্র অর্জন করেন। তার দুবছর আগেই তিনি বিদ্যাসাগর উপাধিটি
পেয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি পড়ানোর ব্যবস্থা তুলে দেওয়া
হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র মুখ্যত নিজের উদ্যোগে বিশেষ যতœ করে ইংরেজি শেখেন।
১৮৫১ সালের ২২শে জানুয়ারি মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজের
অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হবার আগেই তিনি সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অবস্থা
এবং কীভাবে তার উন্নতি করা যায় সে সম্পর্কে শিক্ষাপরিষদে একটি রিপোর্ট পেশ
করেছিলেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ঐ দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য তাকে
নির্বাচন করা হয়। অধ্যক্ষ হয়ে তিনি কলেজের নিয়মকানুন, শিক্ষাপদ্ধতি ও
পাঠ্যসূচীর ব্যাপক সংস্কার করেন। সংস্কৃত শিক্ষাকে সরলতর করা, ইংরেজিকে
অবশ্য শিক্ষণীয় বিষয়সূচীর অন্তর্ভুক্ত করা, পশ্চিমের আধুনিক দর্শনচিন্তার
সঙ্গে ছাত্রদের নির্ভরযাগ্য পরিচয় ঘটনো-তার অধ্যক্ষতায় এ সব ঘটতে থাকে।
উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার মনে কোনো অস্পষ্টতা ছিল।
“আমাদের এখন দরকার
জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার।” তিনি চাইছিলেন দেশে মাতৃভাষায় শিক্ষা
দেবার জন্য অনেকগুলি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হোক ; নির্ভর করা যায় এবং কাজে
লাগতে পারে এমন সব বিষয়ের উপরে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক লেখা হোক ; এবং এমন
কিছু লোক গড়ে তোলা যোক যারা শিক্ষকতার গুরু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম।
এই শিক্ষকদের কী কী গুণ থাকা দরকার? মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল, যে জ্ঞান
কাজে লাগে তার সঙ্গে নির্ভরযোগ্য পরিচয়, এবং স্বদেশের কুসংস্কারাবলী থেকে
মনের মুক্তি। “এই ধরনের শিক্ষক গড়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য, আর সংস্কৃত কলেজের
সমস্ত শক্তি এই উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত হবে।”
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের বিচারে
যা কুসংস্কার অনেকের কাছে তা ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার। তার কাছে যা অনপেক্ষ
সত্য, অন্যের কাছে তা উগ্র ভ্রান্তি এবং পরম্পরাদ্রোহিতা। বিদ্যাসাগরের
সমকালীন শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত বাঙালি হিন্দুসমাজের প্রধান অংশ যে সে
যুগের সর্বোত্তম বাঙালির প্রতিন্যাসের সমর্থক ছিল না সেটি প্রকট হয়ে ওঠে
আরো কয়েক বছর পরে বিধবাবিবাহ-আন্দোলনের সময়ে। কিছু লোক অবশ্য বিদ্যাসাগর
প্রস্তাবিত বিধবাবিবাহের সমর্থন করেছিলেন ; কিন্তু প্রস্তাবের বিরোধী
রাধাকান্ত দেবের গোঁড়ামির সমর্থকরা ছিলেন সংখ্যায় অন্তত তাদের দশগুণ।
সমাজসংস্কারের আগে শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রেও তাকে প্রতিকূল সমালোচনার
মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৮৪৬ সালে যখন তিনি সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট
সেক্রেটারী তখন তার সমস্ত শিক্ষাসংস্কার প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন
সেক্রেটারী রসময় দত্ত। ফলে সে বারে বিদ্যাসাগর চাকরিতে ইস্তফা দেন। রসময়কে
জানান যে বরং আলুপটল বেচে খাবেন, কিন্তু যা সঠিক মনে করেন সে ক্ষেত্রে কোনো
রফা করবেন না। রামমোহনের মত ঈশ্বরচন্দ্রও চেয়েছিলেন এদেশে শিক্ষার
ক্ষেত্রে বেকনীয় বিপ্লব” বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসার। “এতদ্দেশীয়
বিদ্যার্থিগণের চরিত্রগঠন ও জ্ঞানের দিগন্ত সম্প্রসারণের জন্য ১৮৪৯ সালে
যখন তিনি “জীবনচরিত” গ্রন্থ রচনা করে প্রকাশ করেন তখন রবার্ট ও উইলিয়াম
চেম্বার্সের “একজেমপ্লারি বায়োগ্রাফি থেকে যে ব্যক্তিদের জীবনী তিনি
নির্বাচন করেছিলেন তাদের ভিতরে অধিকাংশই বৈজ্ঞানিক। কোপার্নিকাস, গালিলিও,
নিউটন, হর্শেল, লিনিয়াস প্রমুখের সঙ্গে তুলনীয় কোনো ভাবুকের সন্ধান এই
সংস্কৃতজ্ঞ প-িত এদেশের শাস্ত্রকারদের মধ্যে খুঁজে পান নি। মাতৃভাষার সঙ্গে
ইংরেজির চর্চাকেও তিনি যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার কারণ “ইংরেজির
মারফৎই অধিকতর নির্ভরযোগ্য, উপকারী ও প্রকৃষ্ট জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় সম্ভব”।
প্রাচীন শাস্ত্রের যাঁরা নেইআঁকড়া তারা স্বাদেশিকতা বা স্বাজাতিকতার গর্ব
করতে পারেন, কিন্তু তারা সত্যের সন্ধানী নন।
সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হবার
পর ঈশ্বরচন্দ্র যেসব রদবদল চালু করেছিলেন তার মূল্যায়ন করে রিপোর্ট দেবার
জন্য শিক্ষাপরিষদ আমন্ত্রণ করেন কাশীর সরকারী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জে.
আর. ব্যাল্যানটাইনকে। মোটামুটি ভাবে ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রশংসা করার পরে সাহেব
তার আশংকা এবং মতপার্থক্যও গোপন রাখলেন না। তার আশংকা কলকাতা সংস্কৃত কলেজে
ঈশ্বরচন্দ্র যে ধরনের সংস্কৃত এবং ইংরেজি পাঠক্রম প্রবর্তন করেছেন তাতে
ছাত্রদের মনে হতে পারে পশ্চিমী সত্য আর এদেশী সত্য এদুটি আলাদা সত্য-তারা
বুঝতে পারবে না যে সংস্কৃত চিন্তার ঐতিহ্যে যেসব সত্য বীজাকারে বর্তমান
সেগুলিই “আমাদের ইংরেজি বিজ্ঞানে” (আওয়ার ইংলিশ সায়েন্সেস) পরিণত রূপ
নিয়েছে। উল্টো তারা ভাবতে পারে নব্যবিজ্ঞানের চিন্তা আর প্রাচীন হিন্দু
চিন্তা বুঝি পরস্পরবিরোধী। অতঃপর ব্যাল্যানটাইন প্রস্তাব করেন যে প্রাচীন
সংস্কৃত এবং নব্যপশ্চিমের ভিতরে সংগতি এবং অনুক্রমসম্পর্ক বোঝাবার জন্য
সাংখ্য ও বেদান্তের সঙ্গে বার্কলির দর্শন পড়ানো সমুচিত। ছাত্ররা যাতে
নিজেরা সত্য নির্ণয় করতে গিয়ে দিকভ্রান্ত না হয় সেই উদ্দেশ্যে সাহেব তার
স্বরচিত কিছু টীকাভাষ্য ও সংক্ষিপ্তসার রচনা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে কলকাতা
সংস্কৃত কলেজে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন।
বিদ্যাসাগর শিক্ষাপরিষদের কাছে
লেখা তার উত্তরে ব্যাল্যানটাইনের সমালোচনা এবং প্রস্তাব সরাসরি খারিজ
করলেন। আমহার্স্টকে লেখা রামমোহনের শিক্ষাবিষয়ক বিখ্যাত পত্রটির (১৮২৩) মতো
ইংরেজিতে লেখা ইশ্বরচন্দ্রের এই চিঠিটিও (১৮৫৩) আধুনিক ভারতের
মানস-ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দলিল। বিদ্যাসাগর লেখেন, নানা কারণে “আমাদের
বাধ্য হয়ে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত এবং সাংখ্য পড়াতে হয়। বেদান্ত এবং সাংখ্য
যে ভ্রান্ত দর্শন এ নিয়ে মতদ্বৈধ নেই। হিন্দুরা কিন্তু এই দুই মিথ্যা
দর্শনকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। এদের প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ইংরেজিতে
প্রকৃত নির্ভরযোগ্য দর্শন (সাউন্ড ফিলজফি) পড়ানো আমাদের কর্তব্য।” বার্কলির
সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংখ্য ও বেদান্তের মিল আছে ঠিকই, কিন্তু বার্কলির
দর্শন এখন সঠিক বলে ইউরোপে কেউ মনে করেন না। বার্কলি পড়ার ফলে হিন্দু
ছাত্রদের মনে তাদের ঐতিহ্যাশিত ভ্রান্ত দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা আরো প্রবল
হয়ে উঠবে। তাদের দরকার জন স্টুয়ার্ট মিলের লজিক পড়া ; সম্পূর্ণ মূল গ্রন্থই
তাদের পড়তে হবে, সংক্ষিপ্তসার তার স্থান নিতে পারে না। যতœ করে সংস্কৃত
এবং ইংরেজি দর্শন যে ছাত্ররা পড়বে তারা যে সত্য দুই রকমের এমন ধারণা করবে, এ
আশংকা নিতান্ত অমূলক। যা সত্য তা সত্যই, তার বিপরীত কথা সত্য হতে পারে না।
হিন্দু দর্শনে বিস্তর কথা আছে যা অর্থহীন এবং সেই কারণে যা বোঝানো বা
অনুবাদ করা যায় না।
যে জ্ঞানবিজ্ঞান আধুনিক কালে ইউরোপে বিকশিত হয়ে
উঠেছে তার বীজ সংস্কৃত শাস্ত্রে পাওয়া যায়, ব্যাল্যানটাইনের এই স্তোভ
বাক্যে বিদ্যাসাগরের আদৌ আস্থা ছিল।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে বৈজ্ঞানিক
মেঘনাদ সাহা যখন নব্যহিন্দুধর্মের ব্যাখ্যাতাদের কড়া সমালোচনা করে
লিখেছিলেন যে যারা আধুনিক বিজ্ঞানের সব তত্ত্বই বীজাকারে বেদে আছে বলে দাবী
করেন তারা না জানেন আধুনিক বিজ্ঞান না পড়েছেন বেদ, তখন তিনি বিদ্যাসাগরেরই
অনুসরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ব্যাল্যানটাইনের সমালোচনার উত্তরে লিখেছিলেন,
এদেশে যারা মনে করেন শাস্ত্রমাত্রই ঋষিবাক্য, সে কারণে অভ্রান্ত এবং
প্রশ্নো, তারা পশ্চিমের প্রাগ্রসর বিজ্ঞানকে না পারবেন বুঝতে না চাইবেন
স্বাগত করতে। তাদের মন রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে এমন কিছু শিক্ষিত লোক
গড়ে তুলতে হবে যাদের মন কুসংস্কারমুক্ত, যারা শাস্ত্রের আনুগত্যের চাইতে
সত্যের অনুসন্ধানকে অনেক বেশী মূল্য দেয়, যারা নিজেরা নির্ভরযোগ্য ও
প্রয়োগসিদ্ধ জ্ঞান আহরণ করে আপন মাতৃভাষায় দেশবাসীর কাছে সেই জ্ঞান পৌঁছে
দিতে আগ্রহী।
বিদ্যাসাগর ছিলেন তার যুগের সবচাইতে নির্ভেজাল বিবেকী
বাঙালি-ঋজু এবং উল্লম্ব, অভীক এবং অকৈতব, অনন্যতন্ত্র ও পরার্থপরায়ণ। তার
চরিত্রে এবং চিন্তায় কোনো অনচ্ছতা ছিল না। অক্লিষ্টকর্মা মানুষটি পরিবার
আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের কাছ থেকে অনেক আঘাত পেয়েছিলেন ; ব্যর্থতা এবং
একাকিত্বের বেদনায় আচ্ছন্ন তার জীবনের শেষ ভাগ ; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই
তিনি অপহ্নবে আশ্রয় নেন নি অথবা অধ্যাসনে সান্ত¡না খোঁজেন নি। সম্প্রতি
কোনো কোনো মিথ্যাবাগীশ কলমবাজ তাকে রামকৃষ্ণভক্ত বলে গালগল্প বানিয়ে বাজারে
চালাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যে যুগে শিক্ষিত, দায়িত্ববিমুখ,
শিথিলবুদ্ধি, পুণ্যলোভী বাঙালিরা দক্ষিণেশ্বরে ভীড় জমিয়েছিলেন সে যুগেও
বিদ্যাসাগরের যুক্তিশীলতা ও অনন্যতন্ত্রতা ছিল অক। দক্ষিণেশ্বরেই তার কাছে
এসেছিলেন, হয়ত কৌতূহলের বশে, হয়ত শংসাপত্রের আশায় ; বিদ্যাসাগর রিপুমুক্তির
আকুলতায় বা বিশ্বরূপ দর্শনের লোভে কোথাও ছোটেন নি। বিদ্যাসাগরের
জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের স্বরণীয় উক্তি: ‘‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না,
আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা
বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভুরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল
পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি,
যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের
ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের
অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স
এবং নিজের বাক চাতুর্ধ্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহবল হইয়া ওঠাই আমাদের জীবনের
প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক
জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, সর্ব বিষয়েই তিনি
ইহাদের বিপরীত ছিলেন।" বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তার অজেয় পৌরষ।
তার দীপ্যমান সত্যবাদিতা ছিল এই পৌরষের প্রমাণ।
অপরপক্ষে যে আলোআঁধারিতে
কল্পনার উদ্ভব এবং বিস্তার, শিল্পসাহিত্য এবং ধর্ম সম্ভবত উভয়েরই মূল
যেখানে প্রোথিত, যেখানে সত্য এবং অসত্যের ভেদ অনেকটা অব্যবস্থ, চেতনার সেই
অনির্ণীত লোকের সঙ্গে সাহিত্যরসিক বিদ্যাসাগরের পরিচয় থাকলেও তার চিন্তায়
এবং চরিত্রে সেটি ছিল অবজ্ঞাত। আর্জব এবং গম্ভীরতা ছিল এই সত্যসন্ধ
মানুষটির গদ্যে, কিন্তু তিনি কবি বা ঔপন্যাসিক ছিলেন না। অবশ্য ছদ্মনামে
তিনি কিছু সুতীক্ষ ব্যঙ্গ রচনা লিখেছিলেন ; তার বিবেকিতা যে কৌতুকসরস ছিল
তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে এই লেখাগুলিতে; কিন্তু সৃষ্টিপ্রেরণার দুর্বার প্রেষ
তাকে কখনো মথিত করেছিল বলে জানা নেই। এবং সমাজসংস্কার প্রচেষ্টার সমর্থনে
ধর্মশাস্ত্রকে প্রয়োগ করে থাকলেও ধর্মচর্চায় তিনি ছিলেন নিতান্তই বীতস্পৃহ।
বিদ্যাসাগরের
না ছিল তুরীয়তত্ত্বে আস্থা না অধিবিদ্যায় আগ্রহ। তিনি সত্য বলতে বুঝতেন
সেই জ্ঞান যা যুক্তিসিদ্ধ, অভিজ্ঞতাসমর্থিত, কার্যকরী। ফলে বেদান্ত বা
বার্কলি পাঠ তার কাছে সময় এবং মননশক্তির অপব্যয় বলে ঠেকেছিল। কিন্তু এদেশী
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই এখনো পর্যন্ত ব্যালান্টাইনী সমন্বয়ের অনুরাগী।
প্রাচন হিন্দুশাস্ত্রে যেসব মহা সত্য নাকি গুহ্য ছিল পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা
আধুনিক কালে তারি একটু আধটু নতুন করে আবিষ্কার করছেন, এই আজাড়িয়া কথা এদেশী
শিক্ষিত নাতোয়াজনের হীনমন্যতাকে সাময়িক ভাবে আড়াল করে। সত্য যে আমাদের মন
রেখে চলে না, এটা বিদ্যাসাগর জানতেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি এখনো বুঝতে
শেখেননি। তারা আঁকড়ে আছেন মনের নিতান্ত অপরিণত ও অসহায় শৈশবকালকে যখন
কল্পনা আর বাস্তবের ভিতরে ভেদ ব্যক্তিচেতনায় নিতান্ত অস্পষ্ট, যখন
আকাক্সক্ষাকেই মনে হয় অস্তিত্বের ধারক, যখন যুক্তির চাইতে আবেগের নিয়ামক
প্রভাব অনেক বেশি প্রবল। মনের এই অনতীতবাল্য, অনিবদ্ধ, অবলম্বী অবস্থায় আর
যাই সম্ভব হোক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। আর বিদ্যাসাগর জানতেন
যে সত্য হলো নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের মৌল উপাদান। নির্ভরযোগ্য জ্ঞান অর্জনের
জন্য যে ধরনের শিক্ষা অবশ্য প্রয়োজনীয় তিনি এদেশে তার প্রতিষ্ঠা ও প্রচার
চেয়েছিলেন। (চলবে...)