শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহতা
সমীরণ বিশ্বাস
প্রকাশ: রোববার, ২ জুন, ২০২৪, ১২:৩৫ এএম |

  বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহতা
ঘূর্ণিঝড়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সাইক্লোন (ঈুপষড়হব)’। এটি গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস (কুশষড়ং)’ থেকে এসেছে। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মৌসুম ভিন্ন ভিন্ন। উত্তর আটলান্টিকে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম শুরু হয় ১ জুনে এবং শেষ হয় ৩০ নভেম্বরে। বাংলাদেশে মূলত বর্ষাকালের শুরুতে এপ্রিল-মে মাসে এবং বর্ষার শেষে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দেখা দেয়।
ঘূর্ণিঝড় ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন:
সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা অনেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ১৯৭০ সালের পর প্রায় এক ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই এক ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশি সংখ্যক ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে।
তারা এই অস্বাভাবিকতার জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং (এষড়নধষ ডধৎসরহম)-কে দায়ী করছেন। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত অধিক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস (ঈধৎনড়হ ফরড়ীরফব ইত্যাদি) নির্গমন দায়ী যা মূলত উন্নত বিশ্বে স্থাপিত বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে নির্গত হয়।
উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড়:
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তাদের মধ্যে আলোচিত কিছু ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা উল্লেখ করা হলো-
৭ -১৩ নভেম্বর ১৯৭০: ১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড় সমগ্র বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসাব অনুসারে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ধারণা করা হয়। গবাদিপশু মৃত্যু প্রায় ১০ লাখ, বাড়িঘর ৪ লাখ এবং ৩,৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২২ কিমি/ঘণ্টা এবং ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় ১০.৬ মিটার।
২৪-২৮ নভেম্বর ১৯৭৪: ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্রমুখী দ্বীপে আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৬১ কিমি/ঘণ্টা এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ২.৮-৫.২ মিটার। এই ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা ২০০ জন। ১০০০ গবাদিপশু মারা যায় এবং ২,৩০০ ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে।
২৪-২৫ মে ১৯৮৫: তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলীয় অঞ্চলে (সন্দ্বীপ হাতিয়া ও উড়ির চর) আঘাত হানে। চট্টগ্রামে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৫৪ কিমি/ঘণ্টা, সন্দ্বীপে ১৪০ কিমি/ঘণ্টা, কক্সবাজারে ১০০ কিমি/ঘণ্টা এবং ঝড়ের কারণে জোয়ারের উচ্চতা ৩.০-৪.৬ মিটার ছিল। মৃতের সংখ্যা ১১,০৬৯ জন। ১,৩৫,০৩৩ গবাদিপশু মারা যায় এবং ৯৪,৩৭৯টি বসতবাড়ি ও ৭৪ কিমি রাস্তা ও বাঁধ বিধ্বস্ত হয়।
২৪-৩০ নভেম্বর ১৯৮৮: তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় প্রচ- আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৬২ কিমি/ঘণ্টা একই সাথে ছিল জলোচ্ছ্বাসের আঘাত যা মংলা বন্দরে পরিমাপ করা হয় ৪.৫ মিটার। মৃতের সংখ্যা ৫,৭০৮ জন। সুন্দরবনে অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও ৬৫,০০০ গবাদিপশু মারা যায়। বিনষ্ট হওয়া ফসলের মূল্য আনুমানিক ৯.৪১ বিলিয়ন টাকা।
২৯-৩০ এপ্রিল ১৯৯১: ১৯৯১ বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে ২৯ এপ্রিল শেষ রাতের দিকে আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল (সন্দ্বীপে পরিমাপকৃত) ২২৫ কিমি/ঘণ্টা। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৫-৮ মিটারে পৌছায়। মৃতের সংখ্যা ১,৫০,০০০ জন। ৭০,০০০ গবাদি পশু মারা যায়। সম্পদের ক্ষতি হয় ৬০ বিলিয়ন টাকা।
১৫ নভেম্বর ২০০৭: ঘূর্ণিঝড় সিডর ২৬০ কিমি/ঘণ্টা বেগে বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূল বরাবর আঘাত হানে এবং ফলশ্রুতিতে ৩,৫০০ এর অধিক মৃত্যু এবং মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
২৭-২৯ মে ২০০৯: তীব্র ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের ১৫ জেলার উপর দিয়ে ১২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে বয়ে যায়। প্রায় ১৫০ জন মারা যায়, ২ লাখ বসতবাড়ি ও ৩ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে করণীয়:
ইন্টারনেটে পোস্ট দেখে আতঙ্কিত না হওয়া, মোবাইল চার্জ দেওয়া ,ফার্স্ট এইড বক্স, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সংরক্ষণ করা। শুকনো খাবার, ফুলের টব, নির্মাণ সামগ্রী নিরাপদ স্থানে রাখুন। দুর্যোগের সময় কোন আশ্রয়কেন্দ্রে যাবেন, গবাদিপশু কোথায় থাকবে, তা আগে ঠিক করে রাখুন এবং জায়গা চিনিয়ে রাখুন।
বাড়িতে, গ্রামে, রাস্তায় ও বাঁধের ওপর গাছ লাগান। যথাসম্ভব উঁচু স্থানে শক্ত করে ঘর তৈরি করুন। পাকা ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিয়ে তার ওপর ছাউনি দিন। ছাউনিতে টিন ব্যবহার না করা ভালো।
উঁচু জায়গায় টিউবওয়েল স্থাপন করুন, যাতে জলোচ্ছ্বাসের সময় লোনা ও ময়লা পানি টিউবওয়েলে ঢুকতে না পারে। জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারে রেডিও রাখুন। সকাল, দুপুর ও বিকেলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন।
বাড়িতে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম রাখুন। নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে প্রত্যেকেরই সাঁতার শেখা উচিত। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে জরুরি জিনিস সঙ্গে নেওয়া যাবে এবং কী কী জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখা হবে, তা ঠিক করে সেই অনুসারে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
ঘূর্ণিঝড়ের মাসগুলোয় বাড়িতে মুড়ি, চিড়া, বিস্কুটজাতীয় শুকনো খাবার রাখা ভালো। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করুন। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপি (ঈুপষড়হব চৎবঢ়ধৎবফহবংং চৎড়মৎধসসব)-এর স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সময়ে করণীয়:
রেডিওতে প্রতি ১৫ মিনিট পরপর ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনতে থাকুন। রাস্তায় থাকলে শপিং মল, স্কুল বা যেকোনো পাকা ইমারতে আশ্রয় নিন। কোনোভাবেই খোলা আকাশের নিচে থাকা যাবে না। বাড়ির বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মেইন লাইন বন্ধ করে দিন। টিনশেড বাসা হলে বা নিচু জায়গায় হলে নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নিন।
ইন্টারনেট ব্যবহার না করে ফোনে রেডিও শুনতে হবে। ফুটিয়ে বা ভালো ফিল্টারের পানি ব্যবহার করতে হবে। বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করার সুযোগ থাকলে সাহায্য করুন। নিজে উপরতলায় থাকলে নিচতলার বসবাসকারীদের দিকে খেয়াল রাখুন। বাসার পাশের টিনশেডের বসবাসকারীদের আশ্রয় দিন।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত শেষ হলে করণীয়:
ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে প্রবেশ করবেন না। ছিঁড়ে পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক তারে হাত দেবেন না। অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণদের সাহায্য করুন। ত্রাণের পরিবর্তে কাজ করুন। আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে লোক উদ্ধারকাজ শুরু করুন।
ঝড় একটু কমলেই ঘর থেকে বের হবেন না। পুকুরের বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন। নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বণ্টন করুন। দ্রুত উৎপাদনশীল ধান ও শাক-সবজির জন্য জমি প্রস্তুত করুন, বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষিকাজ শুরু করুন, যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এদের সংখ্যা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে করণীয়, ঘূর্ণিঝড় শুরু হলে করণীয় এবং ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরে করণীয় বিষয়গুলির সুষ্ঠু পরিকল্পনা আমাদের এই মহা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথ তৈরি করবে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ












সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আন্দালিভ রহমান পার্থ ৫ দিনের রিমান্ডে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft