শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
নজরুল ও নক্ষত্রলোক
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: রোববার, ২৬ মে, ২০২৪, ১২:০০ এএম |


 নজরুল ও নক্ষত্রলোক
নজরুলের কবিতা তার নির্যাতিত পূর্বপুরুষের গল্পকথা। ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিতর তার গল্পগুলো যুদ্ধের স্বরূপ, সাধারণ মানুষের শক্তি উন্মোচিত করেছে, এখান থেকে একটা বিকল্প জাতির উত্থানের সম্ভাবনা তিনি ভেবেছেন। বিদ্যমান বাঙালি জাতি ইংরেজি শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য প্রভাবিত, বিদ্রোহ করতে ভুলে গেছে। বিপরীতে তিনি কবিতা লিখেছেন ইতিহাসকে সঙ্গী করে, এই বিকল্প জাতি বিদ্রোহপ্রবণ, বিকল্প অর্থ উদ্ভাবনে ক্ষমতাবহ। বিদ্রোহ থেকে প্রেমে, ধর্মজ সঙ্গীত থেকে লোকজপালায় এই বিকল্প প্রবহমান। নজরুল এই বিকল্পের মধ্যে মগ্ন থেকেছেন, বরাবর।
লোকজ বাঙালি বিদ্যমান শিক্ষিত বাঙালি থেকে ভিন্ন, তেমনি ইংরেজ শাসক থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা ইতিহাসের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, সংস্কৃতির দিক থেকে নির্মিত। এই নির্মিতির ধারণা থেকে তৈরি একটা নতুন সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এই রাজনীতি ভিন্নতা অবদমিত করে না, যেমন ভেবেছেন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিরা; এই ভিন্নতা শাসকদের সঙ্গে এবং শিক্ষিত বাঙালিদের সঙ্গে নিজেদের স্বাতন্ত্র তৈরি করে রাখে। এই স্বাতন্ত্র্য নজরুলের মধ্যে দীপ্যমান। ভিন্নতার প্রয়োজন থেকেই অটোমাস ব্যক্তিদের উদ্ভব ঘটে, যাদের আছে সমালোচনা মনস্কতা এবং সমাজের ক্ষেত্রে ইতিহাসের দিক থেকে ভূমিকা। অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, উপনিবেশের পরিসরে, নজরুল এই অটোমাস ভূমিকা পালন করেছেন। সেজন্য সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে কারও মেলে না, তাঁর সাংস্কৃতিক রাজনীতি অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। তার প্রস্তাবিত সাংস্কৃতিক স্বরূপ একই সঙ্গে প্রয়োজন ও কল্পকথা, যেমন হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ : যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,/সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুড়া।/প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ, চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।/করুক কলহ জেগেছে তো তবু বিজয়-কেতন উড়া।/ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া।
নজরুল সংস্কৃতি ও জাতি নিয়ে কাজ করেছেন এবং দেখেছেন দুইয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য। তিনি দেখেছেন বিদ্রোহী আইডেনটিটি নির্মাণ করা সম্ভব, কিন্তু এই আইডেনটিটি ঘিরে আছে সমাজের বদলে সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণীর বদলে শিক্ষিত দ্রলোকদের আস্ফালন। তার ফলে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী বিদ্রোহী সত্তা সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে এবং ভদ্রলোকদের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিদ্রোহের রাজনৈতিক অবস্থান কেবল প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল, কেবল বুর্জোয়া কিংবা রেডিক্যাল নয়, এই অবস্থানটি ইতিহাসের অংশ, বৈপরীত্য দীর্ণ, সেজন্য নজরুল সমাজের মধ্যে ভ-ামি, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মধ্যে শাণিত ছুরি লুকানো দেখতে পান, ব্রিটিশ আইনকানুনের মধ্যে হিং¯্র কদর্যতা দেখতে পান। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিরোধের ভাব, মুহূর্ত, অবস্থানকে তিনি বড়ো করে তোলেন। তাঁর এই সমালোচনমনস্কতা বায়বীয় আদর্শবাদের বিপরীতে কঠিন বাস্তবতা, এই বাস্তবতা তাঁকে তিক্ত করেছে তেমনি করেছে দূরসন্ধানী। এই সমালোচনমনস্কতা শিক্ষিত ভদ্রলোক হিন্দু ও মুসলিম মধ্যশ্রেণী সহ্য করতে পারেনি। না-পারার দরুন তাঁর সাহিত্যকর্মের নান্দনিকতা জ্বশ্রেণীর নান্দনিকতা থেকে সহ¯্র মাইল দূর। উপনিবেশবিরোধী ডিসকোর্স থেকে এবং উপনিবেশবিরোধী লড়াই থেকে তিনি কলোনিয়াল বিপ্লবের পোয়েটিক্স ও পলিটিক্স তৈরি করেছেন। এখানেই তাঁর নান্দনিকতার ভিত্তি ও তাঁর সঙ্গে সমসাময়িক অন্যদের তফাৎ। তাঁর সাহিত্যকর্ম থেকে নজরুলের যে-ইমেজ উদ্ভাসিত, সেখানে তিনি এক ট্র্যাজিক ফিগার। তিনি হয়ে ওঠেন বিপ্লবহীন বিপ্লবের কবি। তাঁর কবিতায় উচ্চকিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে পবিত্র ক্রোধ। এভাবে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে কলোনিয়ালিজমের ওপর পলিটিক্যাল ও এথিক্যাল এক টেস্টামেন্ট। নির্যাতন নামক এক ভুবনের বাসিন্দা, বঞ্চনা নামক এক ধরিত্রীর মানুষজন, অপমানিত হতে হতে লাঞ্ছিত হতে হতে জাতীয় চেতনায় পৌঁছে গিয়ে দেখে সেখানে জাতীয় চেতনার বদলে সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবল, জাতীয় ঐক্যের বদলে সাম্প্রদায়িক ধর্মজ ঐক্য প্রবল, উপনিবেশবাদ বিরোধিতার বদলে পশ্চিমের প্রতি ভক্তি প্রবল। নজরুলের কবিতা এই বৈপরীত্যের সূত্রটাকে আঘাত করেছে থেকে থেকে। নজরুল রাজনৈতিক নির্যাতনের সমান্তরালে সাংস্কৃতিক নির্যাতনকে তুলে ধরেছেন এবং ভেবেছেন জাতীয় মুক্তি সংস্কৃতির একটি প্রয়োজনীয় কাজ।
নজরুল দু’টি সংস্কৃতির মধ্যে কাজ করেছেন। নজরুল হিন্দু সমাজ উৎসারিত সংস্কৃতি এবং মুসলিম সমাজ উৎসারিত সংস্কৃতির মধ্যে কাজ করে পৌছেছেন। মানবিকতাবাদে এবং উন্মোচিত করেছেন মানবিকতাবাদের সমস্যাগুলো। কলোনির বাংলায় মানবিকতাবাদের অভিজ্ঞতা ধরা দিয়েছে বৈদেশী হেজিমনি হিসাবে। ব্রিটিশরা আমাদের ইতিহাস ছেড়ে দিতে বলেছে এবং যুক্ত হতে বলেছে তাদের ইতিহাসে কিংবা ইউরোপীয় আধুনিকতায়। জাতীয় মুক্তির অন্য অর্থ হচ্ছে আমাদের নিজেদের ইতিহাসে ফিরে আসার ইচ্ছাশক্তি। নজরুল এক্ষেত্রেই কাজ করেছেন, প্রথার বিরুদ্ধে যেতে বলেছেন, পুরনো ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার সাহসের কথা বলেছেন এবং ভবিষ্যৎ উদ্ভাবনের সাহসের কথা ভেবেছেন। সাহস না হলে প্রকৃত ইতিহাসে প্রবেশ করা যায় না। নজরুলের এই প্রজেক্টটি রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, নান্দনিক। তাঁর সাংস্কৃতিক রাজনীতির এই প্রক্রিয়া বাংলা কবিতাকে ঘিরে ধরেছে। ফণি-মনসা ও সন্ধ্যা বই দুটির এই কাব্য পাঠ বৈধ বলে মনে হয়।

নজরুলের সাহিত্য সংখ্যালঘু সংস্কৃতি কর্ম। এই অর্থে সংখ্যালঘু যে তাঁর সময়ের সাহিত্যের তিন ধারা : রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত পাশ্চাত্য প্রভাবিত মানবতাবাদী ধারা, হিন্দু মধ্যশ্রেণী প্রবর্তিত সাম্প্রদায়িক ধারা এবং মুসলিম মধ্যশ্রেণী প্রবর্তিত সাম্প্রদায়িক ধারার মধ্যে তিনি কাজ করেননি। তিনি হিন্দু মধ্যশ্রেণীর সাহিত্য এবং মুসলিম মধ্যশ্রেণীর সাহিত্যকর্ম প্রত্যাখ্যান করে প্রান্তিক সংস্কৃতিফর্মের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করেছেন। প্রান্তিক এই অর্থে যে তার সাহিত্য কর্ম না-হিন্দু না-মুসলিম মধ্যশ্রেণীর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রবণতা গ্রহণ করেছে। বরং তিনি ঘুরে ঘুরে পরিব্রাজনা করেছেন মানুষী অভিজ্ঞতার (কিংবা তার ব্যাখ্যাত বাঙালি অভিজ্ঞতার) রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রান্তিক দিকগুলো, তার দরুন তিনি রাজনীতিহীন মানবিকতার লোভ উপেক্ষা করেছেন। তিনি সাহায্য করেছেন নির্মাণ করতে, চেতনার কাছে লগ্ন করতে সংখ্যালঘু সাহিত্যের সেইসব দিক, যেসব অন্তর্ঘাতী প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে হেজিমনিক সংস্কৃতির ক্ষমতার বিরুদ্ধে, যেসব বিরোধিতা করেছে কিংবা প্রত্যাখ্যান করেছে হেজিমনিক সংস্কৃতির ক্ষমতা।
নজরুল সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির পক্ষে ছিলেন না, তিনি বরং ভিন্নতার’ বহুবাদী ফর্মগুলোর পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি বিকল্প কলোনিয়াল ঐতিহ্য তৈরি করেছেন, তৈরি করতে সচেষ্ট থেকেছেন হেজিমনিক সংস্কৃতি এবং পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক ফলশ্রুতি হিসেবে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতার বহুবাদী ফর্মগুলো গরিব বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। সংখ্যালঘু সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতির দায়িত্ব হচ্ছে এই সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের লিবারেল। মানবতাবাদের উত্থান থেকে রক্ষা করা, একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক ¯্রােত থেকে টিকিয়ে রাখা। নজরুল এই দায়িত্ব পালন করেছেন প্রান্তিকতার চর্চা করে ও প্রান্তিকতাকে সেলিব্রেট করে।
কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে শাসিতদের, কলোনির বাঙালিদের প্রতিরোধের, সংঘাতের বিভিন্ন ফর্ম কাজ করেছে। রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শিক, আইনি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে এসব ফর্ম রুখে দাঁড়িয়েছে। মহাফেজখানার দলিল দস্তাবেজে, ইনফর্মাল টেক্সটের মধ্যে এসব প্রতিরোধের বহু নজির লুকানো, কখনো প্রতিরোধের ফর্মাল রাজনৈতিক আখ্যানে বিধৃত। পপুলার অবাধ্যতার নানা সংকেত, চিহ্ন, অলিখিত প্রতীকী চক্রচার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। এসব প্রতীক, সংকেত, চিহ্নে বিধৃত ঔপনিবেশিক শক্তির প্রত্যাখ্যান এবং বিরোধিতা, দেশজ তাবেদার শক্তির প্রত্যাখ্যান এবং বিরোধিতা, ধর্মজ।
পাবলিশমেন্ট শক্তির প্রত্যাখ্যান এবং বিরোধিতা। এলিট রচিত ইতিহাসে এসব খুঁজে পাওয়া যায় না এবং ঔপনিবেশিক শক্তি রচিত ইতিহাসে এ সবের বিকৃত তথ্য, ঘটনা, বিবরণ উপস্থিত। অবাধ্যতার এবং আইডেনটিটি এসার্সনের নৈরাজ্যিক এবং নিহিলিস্টিক এনার্জির (নজরুলের ব্যক্তিস্বরূপ তাই) খোজ পাওয়া যায়, স্বপ্নকথায়, বিভিন্ন নাক্ষত্রিক, সংকেতে, দরবেশ ফকির সন্ন্যাসীর বক্তব্যে, যাত্রায়, পালা গানে এবং কথকতায়। নজরুল এসব প্রান্তিকতা থেকে বিষয়, বক্তব্য, উপমা, প্রতীক খুঁজে বের করেছেন। নজরুলের কাজে এসব সংকেতচিহ্ন অজ¯্র ছড়ানো। মেসিয়ানিক আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে সূত্র আছে ও কলোনিয়াল শক্তি এবং প্রফেটিক ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। এই সূত্র তিনি ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে এবং এই দ্বন্দ্ব তিনি ব্যবহার করেছেন সাবলীলভাবে। নজরুলের বিভিন্ন কবিতা : আমার কৈফিয়ৎ, সর্বহারা, দ্বীপান্তরের বন্দিনী, সব্যসাচী, বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, কামাল পাশা, চিরঞ্জীব জগলুল, ফরিয়াদ, এভাবে পাঠ করলে বিভিন্ন অর্থ উদ্ভাসিত হয়। তার শব্দ ব্যবহারের একদিকে আছে স্মারক খোঁজার তাগিদ, অন্যদিকে আছে মতাদর্শিক সূত্র। জা বদ্রিলারের অনুসরণে তাঁর ঈশ্বর সন্ধানী কবিতাগুলোর মধ্যে চুপ থাকা, স্তব্ধ থাকা, ধর্মজ মৌনতার মধ্যে প্রতিরোধের বীজ খোজা সম্ভব। নজরুলের ধর্মজ পথ পরিক্রমার এই দিকটি এভাবে ভেবে দেখা যায়।
কলোনির ব্যক্তি বহুবিধ গঠন থেকে নির্মিত হয়, বহুবিধ বৈপরীত্য, বহুবিধ চাপ তার মধ্যে কাজ করে। নজরুল তার বিশিষ্ট উদাহরণ। তাঁর কাছে বাঙালি’ শব্দটা অবাধ্যতার দ্যোতক। অবাধ্যতার সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন প্রত্যাখ্যান। তার সময়ে তিনি অবাধ্যতা ও প্রত্যাখ্যানের আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করেছেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অবাধ্য হয়েছেন দ্রলোক সংস্কৃতির, কলোনিয়াল সংস্কৃতির, দ্রলোকদের ধর্মজ সংস্কৃতির, দ্রেেলাকদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির। এসব সংস্কৃতি থেকে তৈরি হয়েছে অধমন্যতার বোধ। তিনি ভদ্রলোকদের স্বার্থপরতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে সাহিত্যের মাধ্যমে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ভেবেছেন সাধারণ মানুষ সব সময় খুঁজে ফিরছে তার স্মারক, তার এই স্মারক প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার কংক্রিট চেতনাবোধ : আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে, এই ইতিহাস সুন্দর ও মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ; গুরুত্বপূর্ণতার দিক থেকে, মহত্তের দিক থেকে, সুন্দরের দিক থেকে পৃথিবীতে আমাদের স্বতন্ত্র, বিকল্প অবদান রাখার স্পেস তৈরি করতে হবে। এই সাধারণ মানুষ বাংলাকে ছিনিয়ে আনবে ভদ্রলোকদের আপস করার ভুবন থেকে, যে-ভদ্রলোকরা লড়াইয়ের আগেই আত্মসমর্পণ করে বসে থাকে। সন্ধ্যা ও জিঞ্জীর কবিতা গ্রন্থ দুটি এভাবে পাঠ করা জরুরি। নজরুল বাংলা সাহিত্যকে শালীন সংকরতা থেকে, শালীনতার বিষ থেকে, ঝেটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছেন এবং তীক্ষ্ণ তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন ভদ্রলোকদের ঐতিহ্যকে। এসব ভদ্রলোক সাধারণ মানুষদের দুশমন, যেমন দুশমন কলোনিয়াল রাজশক্তি। রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে উৎসারিত তিরিশের ভদ্রলোকদের সাহিত্য নজরুলকে সহ্য করতে পারেনি। সাহিত্য কি শিষ্টাচারের জন্য? নজরুলের জবাব : সাহিত্য লড়াইয়ের জন্য, এই বোধ থেকে তিনি কাজ করেছেন।

নজরুল যে-সব নারীদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন তাদেরকে তিনি দেখেছেন নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক পরিসরে। তারা সবাই একই ধরনের সংস্কৃতিঅতিক্রমী অধস্তনতার অন্তর্গত, সেই অধস্তনতা থেকে তারা সর্বব্যাপ্ত পিতৃতান্ত্রিকতা এবং পাশ্চাত্যের নারীবাদকে প্রশ্ন করেছে। একইসঙ্গে তারা নিজেদের অস্তিত্বের দিক থেকে নির্যাতনময় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্ক চুকাবার চেষ্টা করেছে। এভাবেই নজরুল কলোনিয়াল ডিসকোর্সের একটি দিক তুলে ধরেছেন। মানবিকতা, তার দিক থেকে পাশ্চাত্যের মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক প্রজেক্ট, যে-প্রজেক্টে অন্তর্গত পূর্ব ভূখ- এবং অন্য' হিসেবে নারী। ব্রিটিশ সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতির অনুকরণে বাংলা ভুবনের নারী এবং বাংলা ভুবনের সাহিত্য সম্বন্ধে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই আগ্রহ পুনরুৎপাদন করেছে সা¤্রাজ্যবাদী ধারণা, যেমন প্রশ্ন না করে নারীবাদী ব্যক্তিকতার প্রমোশন ইতিহাসকে বাদ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখায় এই ঝোঁক আছে।
নজরুলের দিক থেকে, সাহিত্যে কিংবা ইতিহাসে নারীদের আবির্ভাবে একই ধরনের পিতৃতান্ত্রিক, কলোনাইজিং প্রক্রিয়া কাজ করেছে : কলোনিয়াল পুরুষ কিংবা নারীতে দীপমান নার্সিসিস্টিক নির্মাণ। কোনো বিষয় হিসেবে নারীদের গঠনকে তিনি আক্রমণ করেছেন, বিপরীতে তিনি তুলে ধরেছেন নারী বিষয়টি, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, বিভিন্ন ব্যক্তি, এসব বিভিন্ন ব্যক্তি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক পরিসরে বিভিন্নভাবে সাড়া দিয়েছে। এই নারী ব্যক্তিটি জেন্ডার বিষয় হিসেবে অধস্তন, এই অধস্তনতা শ্রেণী বিষয়ের অধস্তনতা থেকে ভিন্ন। নারীদের অবস্থান, ইতিহাসের দিক থেকে দু'ধরনের কর্তৃত্বের অন্তর্গত। প্রথম কর্তৃত্ব হচ্ছে : পিতৃতন্ত্র। দ্বিতীয় কর্তৃত্ব হচ্ছে : কালোনিয়ালিজম। সেজন্য তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও, বৈপরীত্যমূলক। নজরুলের দিক থেকে এই সূত্রে, নারী হচ্ছে মতাদর্শিক যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধক্ষেত্রে হিন্দু নারীদের অবস্থান এবং মুসলিম নারীদের অবস্থান ভিন্ন। সর্বহারা কবিতা বইয়ের ‘মা’ (বিরজা সুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দ-র সঙ্গে জিঞ্জির কবিতা বইয়ের মিসেস এস রহমান কবিতার তুলনা করলে মনোভঙ্গির বৈপরীত্য ধরা পড়ে। সমস্যাটা জটিল এবং এই জটিলতার চারপাশে নজরুল ঘুরে ঘুরে ফিরেছেন। সমস্যাটা এ নয় যে নারীরা নিজেদের কথা বলতে পারে না, সমস্যাটা হচ্ছে উল্টো। বাংলা সংস্কৃতিতে কোনো সেক্স নেই যেখান থেকে অধস্তন, যৌনজ বিষয়ে তারা কথা বলতে পারে। সবাই তাদের পক্ষে কথা বলে, রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র থেকে নজরুল পর্যন্ত সবাই নারীদের পক্ষে কথা বলেছেন। এই বলার মধ্যে দিয়ে। নারী ধারাবাহিকভাবে পিতৃতন্ত্র কিংবা কলোনিয়াজমের উদ্দেশ্য হিসেবে পুনর্লিখিত হয়েছে। এদের কাজে কিংবা উদ্দেশ্যে নারীদের বদল হয়েছে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে কলোনিয়ালকালে কিংবা কলোনিয়াত্তোরকালে নারীদের অবস্থানের অধস্তনতা বদল হয়নি, একট পিতৃসুলভ পিঠচাপড়ানি কিংবা স্নেহ থেকেই গেছে, থেকেই গেছে। পুরুষের অর্থ এবং নারীদের দেহের মধ্যকার বাছাইয়ের সমস্যা।
পিতৃতন্ত্র, কলোনিয়ালিজম এবং ধর্মজ মতাদর্শের মধ্যে নারীর অবস্থান চিহ্নিত। নজরুলের কৃতিত্ব হচ্ছে ইতিহাসের আরোপিত এই তিন স্তব্ধতা ভেঙে তিনি নারীকে। বাইরে এনেছেন। কিন্তু তিনি দেখেছেন পিতৃতন্ত্রের নির্যাতন, দেখেছেন কলোনিয়াল সমাজব্যবস্থার নির্যাতন, দেখেছেন ধর্মজ মতাদর্শের নির্যাতন। এই তিন নির্যাতন নারীকে তৈরি করে যৌন-বিষয় হিসেবে। তার বাইরে তার নির্মাণে কোন সামাজিক মূল্য নেই। এই মূল্যহীনতাই পিতৃতন্ত্র থেকে তৈরি হয়, কলোনিয়াল সমাজ ব্যবস্থা থেকে তৈরি হয় এবং ধর্মজ মতাদর্শ থেকে তৈরি হয়। মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির অর্থাৎ নারীর এই মূল্যহীনতা অন্তর্নির্মিত নজরুল এই ক্ষেত্রটি চিহ্নিত করে লড়াই করেছেন।
নজরুলের অন্য সব বৈপ্লবিক কবিতার পাশাপাশি তার নারী বিষয়ক কবিতা পাঠ করলে একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। তাঁর স্টাইলের অতিরঞ্জনতা দু’ক্ষেত্রেই সক্রিয় কিন্তু এক ক্ষেত্রে তিনি কলোনিয়াল, সমাজ সম্পর্কের কুশ্রী নীরবতার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, কলোনিয়াল সমাজ সম্পর্ক ব্রিটিশ সভ্যতার শীর্ষবিন্দু নয়, বরং ব্রিটিশ সভ্যতার অন্ধকার দিক : অন্যক্ষেত্রে নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যৌনজতার সক্রিয় অনুমোদন ধর্মজ অনুশাসনের অন্ধকার দিক, এই দিকটি গ্রহণযোগ্য নয়। দু’ক্ষেত্র থেকে দু'ধরনের স্তর বিন্যস্ততা তৈরি হয়েছে, এই স্তর বিন্যস্ততা যেমন ধর্মজ সম্পর্কের দিক থেকে মানুষকে ক্ষুদ্র করে, তেমনি অধস্তন করে রাখে ধর্মজ মতাদর্শের দিক থেকে। যেন নজরুল বলতে চান : যারা কলোনিয়ালিজমকে ভাঙতে চায় তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে সকল বিদ্রোহ, সকল বেপরোয়া কাজকে সমর্থন করা, সব অন্যায় রক্তের নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া।
তার দিক থেকে সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের বাস্তবিক ও আধ্যাত্মিক বাস্তবতার ডায়নামিক সমন্বয়, এই সমন্বয় শারীরিক ও মনোজ শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে এবং এখান থেকে তৈরি হবে অদম্য, অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ সকল সংস্কারের বিরুদ্ধে সকল ধর্মজ বিশ্বাসের নেতিবাদী দিকগুলোর বিরুদ্ধে। তিনি যেন বলতে চান একটি বৈপ্লবিক সংস্কৃতির উদ্ভব তখন হয় যখন সবাই : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তির দিকে অগ্রসর হয়। লড়াই বাদে মুক্তি হয় না, তেমনি লড়াই বাদে বৈপ্লবিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয় না। তাঁর সময়কার বাংলার সমস্যা হচ্ছে ভক্ত লোকরা, শিক্ষিত হিন্দু ও শিক্ষিত মুসলমান লড়াই চায় না, বৈপ্লবিক সংস্কৃতির বদলে কলোনিয়াল শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে টিকে থাকতে চায়। সেজন্য মুক্তি হয় না, নারীরা ধর্ম অনুমোদিত যৌনজ বিষয় হিসেবে থেকে যায়। এই থেকে যাওয়া শক্তিশালী করে বিদেশী সংস্কৃতি এবং বিদেশী শাসন, একইসঙ্গে শক্তিশালী করে মনুষ্যস্বভাববিরোধী ধর্মজ শাসন। ধর্মজ শাসন বিদেশী শাসনের মতো সাংস্কৃতিক নির্যাতনকে শক্তি জোগায় ও জাতীয় মুক্তিকে পিছিয়ে দেয়।
কলোনিয়াল শাসন ও শোষণ এবং ধর্মজ শাসন ও শোষণ নারীদের সম্বন্ধে যে জ্ঞান তৈরি করেছে, সেই জ্ঞান সংকীর্ণ এবং সেই জ্ঞানে যুক্ত ঈশ্বর ও কলোনিয়ালিজমের ডেসপটিজম। এ ক্ষেত্রটিকে নজরুল উন্মোচিত করেছেন, এ যেন জ্ঞানের এক ষড়যন্ত্র নারীর বিরুদ্ধে। নজরুল ধরতে পেরেছেন জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক, এই ক্ষমতা ঈশ্বরকেন্দ্রিক ও সে কারণে কি অপরিবর্তনীয়? কলোনিয়াল জ্ঞান স্থিতাবস্থার পক্ষে কাজ করেছে, সেজন্য ঈশ্বর ও পুরুষতান্ত্রিকতা সমালোচনার উর্ধ্বে। নজরুল এই সংযোগটি আক্রমণ করেছেন তাঁর ধরনে। তিনি সচেষ্ট ছিলেন নারীদের সম্বন্ধে এক সেকুলার বোধ তৈরি করতে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন জ্ঞান পদ্ধতিকে, এই জ্ঞান পদ্ধতি ক্ষমতায়নবিরোধী। ক্ষমতায়ন বাদে মুক্তির পতাকা উড়ানো যায় না।
তিনি রাজনৈতিক চোখে সামাজিকতার স্তর দেখেছেন এবং এই স্তরটি সামাজিক জীবনের রাজনৈতিককরণ হবে না (মনে কি পড়ে না এই স্লোগানটি : ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক) ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল ক্রোধে উন্মত্ত হয়েছেন, ভাঙতে চেয়েছেন চার দেওয়াল, তার করাঘাতে ও পদাঘাতে প্রকম্পিত হয়েছে দশ দিগন্ত, সেই আওয়াজ ফিরে ফিরে এসেছে মাঠে ময়দানে গৃহের অন্দরে। কান পেতে শুনেছে বন্দিরা। ঐ আসে ঐ আসে মুক্তির ঝঞা। নজরুল এভাবে তৈরি করেছেন কলোনিবিরোধী, ঐশ্বরিক শাসনবিরোধী বুদ্ধিজীবী ঐতিহ্য। কলোনির বাসিন্দা নজরুলের মধ্যে সকল নির্যাতন সকল অসম্মানের বিরুদ্ধে ক্রোধ তৈরি হয়েছে। এই ক্রোধ তাঁর কবিতা, তার সাহিত্য। সেজন্য ক্রোধ মানবিক। যাদের মধ্যে ক্রোধ নেই তাদের পক্ষে সাহিত্য করা সম্ভব হয় না। ক্রোধের ভাষা স্পষ্ট, শাণিত। তিনি স্পষ্ট, শাণিতভাবে তার আবেগ প্রকাশ করেছেন। আবেগের এমন প্রকাশ, উজ্জ্বল স্পষ্ট শাণিত প্রকাশ বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যে ব্যতিক্রম। সেজন্য অনেকের পক্ষে তার আবেগ সহ্য করা সম্ভব হয় না। ক্রোধ সহ্য করা সম্ভব হয় না। ভাষা ব্যবহারের অমিতাচার সহ্য করা সম্ভব হয় না। কলোনিবিরোধী কিংবা যে কোনো নির্যাতন শাসনবিরোধী অথবা ঐশ্বরিক শাসনবিরোধী বুদ্ধিজীবী ঐতিহ্য নজরুল এভাবেই ক্রোধ দিয়ে আবেগ দিয়ে, প্রকাশের সততা দিয়ে তৈরি করেছেন।














সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আন্দালিভ রহমান পার্থ ৫ দিনের রিমান্ডে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft