প্রতিটি মানুষেরই জীবনের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য বা চাওয়া থাকে। আশা-আকাঙ্ক্ষা
না মিটলে মানুষ অসুখী হয়, মিটে গেলে সুখী। কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা না মিটলেও
তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। তারা অপেক্ষাকৃত কম অসুখী।
অর্থনৈতিক
অবস্থান, পারিবারিক সম্পর্ক, নিজের বা পরিবারের অন্য কারও স্বাস্থ্যজনিত
সমস্যা দুঃখের প্রধানতম কারণ। আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল না হলে মানুষ অসুখী
হন। পারিবারিক সমস্যায় পড়লেও। বেকারত্ব, কম রোজগার, বিনোদনের অভাব,
চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা, নিজের ও সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সই মানুষের সুখ
কেড়ে নেয়।
বাংলাদেশের মানুষের কী সুখী হওয়ার কোনো সুযোগ আছে? বা কারণ
আছে? এত দারিদ্র্য, বেকারত্ব, চরম মূল্যস্ফীতির সাথে বিদ্বেষে পরিপূর্ণ
রাজনৈতিক পরিবেশ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের
স্বাধীনতার অপ্রতুলতা, অবাধ দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা নিয়ে মানুষ সুখের কথা
ভাববে কী করে? রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সামাজিক সুরক্ষা বলতে কিছু নেই,
স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সুযোগও একেবারেই সামান্য।
কিন্তু অবাক বিষয় হলো
এরপরও সুখের আলোচনা হয় এদেশে। হয়েছে কারণ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২৪
প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে সুখী দেশের তালিকায় ১১ ধাপ পিছিয়েছে
বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২৪ বলছে, বিশ্বের ১৪৩টি দেশের
মধ্যে বাংলাদের এখন অবস্থান ১২৯। আগেরবার ছিল ১১৮।
এবারের সুখ সূচকে
বাংলাদেশের পাশের দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৯৩, পাস্তিান ১০৮, মিয়ানমার ১১৮,
ভারত ১২৬ ও শ্রীলঙ্কা ১২৮ এবং আফগানিস্তান ১৪৩তম অবস্থানে। আমরা তাহলে
পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকেও পিছনে। তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান ছাড়া
দক্ষিণ এশিয়ায় সবাই আমাদের চাইতে ভাল অবস্থানে আছে যদিও সেই অবস্থানগুলো
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তলানীতেই।
জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে সুখী দেশের তালিকা করার
ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, সেই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক
পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করা হয়।
পাশাপাশি প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত
স্বাধীনতা, উদারতা, জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেয়া হয়।
সুখের
সাথে সরাসরি সম্পর্ক অর্থনীতির। গড়পড়তায় যাদের আয় বেশি, তারা বেশি সুখী।
তবে আয় বেশি থাকলে সুখী হবেই, এমন কথা নেই। অনেক পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও
পারিপার্শ্বিক কারণ থাকতে পারে। তবে একটা বড় বিষয় হলো পারিপার্শ্বিকের
তুলনায় কারও আর্থিক অবস্থান কী রকম, তার উপর সুখ নির্ভর করে। বন্ধুবান্ধব,
আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের তুলনায় কারও আয় বেশি হলে, তিনি বেশি সুখী। আমার
চার পাশের মানুষেরা আমার চেয়েও খারাপ আর্থিক অবস্থানে থাকলে, কম আয়েও আমি
সুখী থাকতে পারি।
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা
থেকেও মানুষ সুখ লাভ করে। বাংলাদেশে এ দুটোই, বিশেষ করে চিকিৎসা সাধারণের
একেবারে নাগালের বাইরে। এই লেখা যখন লিখছি তখনই অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে
একটা খবর ঘুরছে যে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পেরে রাজধানীর মগবাজারে পেটে
ছুরি ঢুকিয়ে এক রিকশাচালক আত্মহত্যা করেছেন।
যাদের আয় বেশি এবং বাড়তি,
তাদের অসুখের প্রকার আলাদা। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা,
প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। বাড়ির আশা মিটলে গাড়ি কেনার ইচ্ছা হয়। আয়ের সঙ্গে
সঙ্গে প্রত্যাশা বাড়ে, আরও জাগতিক বস্তু লাভের পিছনে মানুষ ছোটে। বাড়ি একটি
থাকলে আরেকটি চায়, গাড়ির মডেল বারবার বদলাতে চায়।
তবে এই শ্রেণির
সংখ্যা হাতো গোনা। বেশিরভাগ মানুষই লড়াই করছে এ প্রান্তে বা ও প্রান্তে।
চার বছর আগের সেই করোনা কাল থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশের মানুষকে
সবচেয়ে বেশি চাপে রেখেছে। তার প্রভাব পড়ছে সবখানে। এর সাথে রাজনীতি,
বাকস্বাধীনতা এইসব বিষয় নিয়েও ভাবেন অনেকে। সরকার মাথাপিছু আয় বাড়ার কথা
বলবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাথাপিছু আয় একটি গড় হিসাব। আসলে সবার আয় বাড়ছে
না, কিছু লোকের বাড়ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষ ভালো নেই।
সে ভোগ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। ভোগ কমছে বলে সুখও কমছে।
সুখ কমে যায়
চারিদিকে দুর্নীতির মহোৎসব দেখে, অপরাধীদের আস্ফালন দেখে। সমাজে, রাষ্ট্রে
নানা অস্থিরতা, রাজনীতির সঙ্কট, ন্যায় বিচারের সঙ্কটসহ আরো সঙ্কট দেখে
দেখেও অসুখী হচ্ছে মানুষ। একটা বড় কারণ বৈষম্য। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য
দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে দ্রুত। তবে এই দ্রুত অগ্রগতির
কারণে চরম একটি বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে। তাই সুখ কমছে।
বাংলাদেশে
একটি দীর্ঘায়িত অস্থিরতা চলছে। শহরে চলা যায় না ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে।
বাজারে গিয়ে শান্তি পাওয়া যায় না জিনিসপত্রের অত্যধিক দামের জন্য। নাই কোনো
নিরাপত্তা, নাই নাগরিক হিসেবে কোনো মর্যাদা। একটি রাষ্ট্রে বেশির ভাগ
মানুষ যদি এমন অস্থিরতায় ভুগতে থাকে তাহলে রাষ্ট্র সামগ্রিক ভাবে সুখী হবে
কেমন করে?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।