বৃহস্পতিবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
১১ পৌষ ১৪৩২
হাতিয়ায় চর দখলের বলি ৫: বাবাকে ফেরাতে গিয়ে লাশ হল কলেজছাত্র
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:০৪ এএম |



নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার চরের দখল নিয়ে সংঘর্ষে নিহত মোবারক হোসেন সিহাব তার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে সেই চরে গিয়েছিলেন বলে দাবি তার পরিবারের।
২৩ বছর বয়সী সিহাব সুবর্ণচর উপজেলার সৈকত সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
শিহাবের বাবা উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মো. শামছুদ্দিন। যিনি ‘কোপা শামছু’ বাহিনীর প্রধান বলে দাবি পুলিশের।
তবে তা অস্বীকার করে বুধবার শামছুর স্ত্রী মাহফুজা বেগম বলেন, “কিছু লোক আমার স্বামীকে প্রলোভন দেখিয়ে চরে নিয়ে যায়। চরে দাগ নিয়ে ভূমিহীন বসানোর কথা বলে আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হয়।
“খবর পেয়ে পরশু আমার ছেলে শিহাব তার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে যায়। কিন্তু কালকে আমার ছেলের মৃতদেহ ফিরে আসে।”
তিনি বলেন, “আমার ছেলে সৈকত কলেজের ছাত্র। সে বাবার জন্য চরে গিয়ে আর জীবিত ফিরে আসেনি, ছেলের মৃতদেহ পেয়েছি।”
এর আগে মঙ্গলবার ভোরের দিকে উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের জাগলার চরে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত এবং ১০ জনের মত আহত হয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাগলার চরের দখল ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে দিনভর শামছু বাহিনী ও আলাউদ্দিন বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এ সময় দুই বাহিনীর অন্তত পাঁচজন নিহত হন।
তারা হলেন- হাতিয়ার সুখচর ইউনিয়নের চর আমানউল্যাহ গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে মো. আলাউদ্দিন (৩৫), চানন্দী ইউনিয়নের নলের চরের প্রয়াত সেকু মিয়ার ছেলে কামাল উদ্দিন (৪০), জাহাজমারা ইউনিয়নের মোবারক হোসেন সিহাব (২৩), হাতিয়া পৌরসভার পশ্চিম লক্ষিদিয়া এলাকার প্রয়াত শাহ আলমের ছেলে হকসাব (৫৫) এবং সুবর্ণচর উপজেলার দক্ষিণ চর মজিদের মৃত জয়নাল আবেদিনের ছেলে আবুল কাশেম (৬২)।
এর মধ্যে আলাউদ্দিন তার নামে পরিচিত বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মোবারক হোসেন সিহাব শামছু বাহিনীর প্রধান শামছুদ্দিনের ছেলে।
এ ছাড়া মো. সোহাব (৩০) নামে একজনকে উদ্ধার করে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আহত সোহাহ নিঝুম দ্বীপের সাত নম্বর ওয়ার্ডের খবির উদ্দিনের ছেলে।
২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে কামাল উদ্দিন, মোবারক হোসেন, হকসাব ও আবুল কাশেম নামে চারজনের মরদেহ আসে। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরের দিকে আলাউদ্দিন নামে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জরুরি বিভাগে আনা হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার বিকালে পাঁচটি মরদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক।
খোঁজ মিলছে না শামছুদ্দিনের
এদিকে ঘটনার পর থেকে শামছুদ্দিন ডাকাত ওরফে ‘শামছু বাহিনী প্রধান’ মো. শামছুদ্দিনের খোঁজ মিলছে না। পরিবারের সদস্যরা জীবিত বা মৃত তার সন্ধান দাবি করেছে প্রশাসনের কাছে।
মঙ্লবার সন্ধ্যায় পুলিশ জানিয়েছিল জাগলার চরের দখল ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষে নিহতদের মরদেহের মধ্যে শামছুদ্দিনও ছিল।
তবে, রাতেই শামছুর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুলিশ যে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে তাদের মধ্যে শামছুর মরদেহ নেই।
শামছুদ্দিনের স্ত্রী মাহফুজা বেগম বলেন, “স্বামীর ভালো, খারাপ কোনো খোঁজ পেলাম না। স্বামীকে কোথায় রাখল, কোথায় আছে জানি না। প্রশাসনের কাছে আমি আমার স্বামীর খোঁজ চাই। আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।”
নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন বলেন, “আমরা পাঁচটি মরদেহ উদ্ধার করেছি। শামছুদ্দিনের মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। একজন আহত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া চলমান।”
আগের দিন শামছুর মরদেহ পাওয়ার তথ্য জানানোর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আঘাতের কারণে মরদেহগুলি এতটাই বিকৃত অবস্থায় ছিল, পরিচয় উদ্ধার করা কঠিন ছিল।
এদিকে হতাহতরা কোনো বাহিনীর প্রধান বা সদস্য নয় বলে দাবি সংঘর্ষে জড়ানো উভয় পক্ষের প্রধানের পরিবারের।
শামছুর বড় ছেলে মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “আমার বাবাকে জমি দেওয়ার কথা বলে জাগলার চরে নিয়ে গেছে। পরে তার সঙ্গে আমার ভাইও ছিল। ভাইয়ের মরদেহ আমরা পেয়েছি, কিন্তু বাবার কোনো খোঁজ পাইনি।
“তাকে বাগানের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। জীবিত হোক বা মৃত, আমার বাবার সন্ধান চাই।”
অপরদিকে নিহত আলাউদ্দিনের স্ত্রী তাসলিমা বেগমের দাবি তার স্বামীকে চট্টগ্রাম থেকে ফোনে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় জাগলার চরে।
স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, “আমি চট্টগ্রামে চাকরি করি। আমার স্বামীসহ সেখানে থাকি। তাকে চক্রান্ত করে ফোনে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর চরে গোলাগুলি লাগিয়ে তাকে খুন করে।”
এর মধ্যে আরো কিছু মানুষও গুলি খায়, খুন হয়। আমি এটার বিচার চাই। আমি সরকারের কাছের এটার বিচার চাই।”
তিনি আরও বলেন, “তারা তাকে সবসময় ফোনে পাঁচশ-দুইশ টাকার লোভ দেখিয়ে বিরক্ত করতো। এখন আমি আমার তিনটা সন্তান নিয়ে কি করবো। তারা আমার সন্তানদের এতিম বানিয়েছে।”
“আমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই, বলেন এই নারী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাগলার চরে কয়েকশ ভূমিহীন পরিবার বসবাস করছে। চরের অর্ধেক জমি খাস এবং অর্ধেক ব্যক্তি মালিকানা বা বয়ার সম্পত্তি। চরের জমি এখনো সরকারিভাবে কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি
এ সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে দুজন জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থেকে শামছুদ্দিন এসব জমি বিক্রি করছিলেন। ভূমিহীনদের কাছে প্রতি দাগ জমি ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায় বিক্রি করা শুরু করে। এ টাকার একটি অংশ যায় দুই জনপ্রতিনিধির কাছে।
স্থানীয়দের দাবি,কিছু দিন ধরে জমি বিক্রির টাকা ওই দুই জনপ্রতিনিধিকে দিচ্ছিলেন না সামছুদ্দিন। এ কারণে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
এর মধ্যে সুখচর ইউনিয়নের আলাউদ্দিন বাহিনী ওই জমির দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং আরও বেশি দামে জমি বিক্রি করতে থাকে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।
এর জেরে মঙ্গলবার ভোরে আলাউদ্দিন বাহিনীর নেতৃত্বে একটি দল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাগলার চরের দখল ও নিয়ন্ত্রণ নিতে যায়। তখন দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জাগলার চরের এই সংঘর্ষের সময় রামগতির ফরিদ কমান্ডারের বাহিনীও ছিল।
মঙ্গলবার সকাল থেকে শামছু বাহিনী, আলাউদ্দিন বাহিনী ও ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে গেলে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। পরে এক পর্যায়ে ফরিদ তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যান।
স্থানীয় বাসিন্দা মিরাজ বলেন, “জাগলা চর বিক্রির সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। মুশফিক, ফরিদ, সামছু, আলাউদ্দিন ডাকাত গ্রুপ সক্রিয়। মুশফিক ১ নম্বর হরণী ইউনিয়নের সাবেক প্রশাসক।”
আরেক বাসিন্দা হাছান উদ্দিন বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এই চরে উশৃঙ্খলা চলছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জমি দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট হয়েছে। এখানে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। অনেক রাজনৈতিক নেতা জড়িত। প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, লাশ গোপন করা হয়েছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে জাগলার চরে দিনভর গোলাগুলি ও হতাহেতের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। দ্রুত যৌথ অভিযানের মাধ্যমে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা না হলে জনমনে শান্তি ফিরবে না।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হরণী ইউনিয়নের সাবেক প্রশাসক মুশফিকুর রহমান বলেন, “আমি কোনো জমি বিক্রি করিনি। রাজনৈতিক সভা করেছি মাত্র। এসব ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর হাতিয়া উপজেলায় দেওয়া এক বক্তব্যে চর জাগলা ও চর আতাউরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের প্রার্থী আব্দুল হান্নান মাসউদ।
৩৮ সেকেন্ডের এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, “চর জাগলা ও চর আতাউরে সন্ত্রাসীদের এনে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। সরকারি জমি চাইলেই কেউ বুঝিয়ে দিতে পারে না। প্রশাসনকে বহুবার বলেছি- এখনো ব্যবস্থা না নিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”
হাতিয়া থানার ওসি সাইফুল আলম জানান, “এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ এখনো থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিহতদের পরিবারের কেউ অভিযোগ না দিলে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে।”













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
দেশের পথে তারেক রহমান
দেশে ফিরে তারেক রহমান তিন দিন কোথায় যাবেন, কী করবেন
জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কুমিল্লা সদরে হাজী ইয়াছিনের পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ
১০ হাজার নেতা-কর্মী নিয়ে এলডিপি ছেড়ে বিএনপিতে ড. রেদোয়ান
স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন ফরম নিলেন উপজেলা বিএনপি সভাপতি শাওন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন দেড় লক্ষাধিক নেতা-কর্মী
কুমিল্লায় জনসম্মুখে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতেহত্যা!
লালমাইয়ে শিশু ধর্ষণ চেষ্টায় শিক্ষক শ্রীঘরে
কুমিল্লায় ১১ আসনের ৮২ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ
ফাজিল স্নাতক পরীক্ষায় বই দেখে লেখার অভিযোগ, ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২