বুধবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৫
১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
সোজন বাদিয়ার ঘাট
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৪০ এএম আপডেট: ০৩.১২.২০২৫ ১:৩২ এএম |

 সোজন বাদিয়ার ঘাট

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-১৯৭৭) চিরায়ত কাব্য নাটক সোজন বাদিয়ার ঘাট-এর নায়িকা গদাই-নমুর কালো মেয়ে দুলী। তার সেই কালোয় এসে মিশেছে ধানের ছড়ার আর টিয়া পাখির রং- 
দুর্বাদলে রাখলে তারে দুর্বাতে যায় মিশে 
মেঘের ঘাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে। 
না সে রহস্যময়ী বনলতা সেন নয়, আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি তোলা কঙ্কাবতী নয়, বালিগঞ্জি আর্টেমিস অথবা স্বর্ণকেশী নর্মসখীও নয়। শ্যামল তার তনু, হাতে কাঁচের চুড়ি, দুই পায়েতে কাঁসার খাড়ু, ছিপছিপে তার পাতলা গড়ন, তা দুটি পায় জড়ানো নানা সুরে ছড়ার নূপুর। 
যে শিমুলতলী গাঁয়ে তার বাস সেখানে নমশুদ্র আর মুসলমান গলায় গলা ধরে বাস করে-‘হিন্দুর পূজায় মুসলমানে বয়েত গায়েন গায়’ আর মুসলমানের ‘দরগাতলা’য় হিঁদুর মেয়ে প্রণাম করে ‘ভালে সিঁদুর দিয়ে।’ নমু পাড়ার প্রধান গদাই মোড়ল-মস্ত তার ধানের গোলা, সাতটি জোয়ান পোলা, আর তাদের সবার গরব গাদাইয়ের মেয়ে দুলালী বা দুলী। সেই দুলীর আশৈশব প্রাণের বন্ধু মুসলমান ছেলে সোজন, ‘ছমির শেখের ভাজন বেটা, বাবরী মাথায় ঘেরা।’ তারা যেন গাঙ-শালিক, সারাটা গাঁয়ে টহল দিয়ে দিয়ে বেড়ায়। 
সেই শিমুলতলী গাঁয়ে সব উৎসবেই হিন্দু মুসলমান সমান আনন্দে অংশ নেয়, ছোঁয়াছুঁই যে একেবারে নেই এমন নয়, কিন্তু কেউ বিশেষ গ্রাহ্য করে না, সরস্বতী পুজোর নাড়ু খেতে যেমন মুসলমানের বাধে না নমুর পোলার পীড়ায় তেমনই পীরের পড়া জলই হয় শেষ আশ্রয়। এই চমৎকার প্রীতির আবহাওয়াতে সোজন আর দুলীর ভালবাসা বিনা উত্তেজনায় বিনা বাধায় বিনা শহুরে নানা ন্যাকামি ছাড়াই ক্রমে বিকশিত হয়ে ওঠে। জসীমউদ্দীন গ্রাম্য কাহিনীর রীতি অনুসরণ করে ধীরে ধীরে তাদের সেই সহজ সুন্দর বিকচমান ভালবাসা রূপটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তারা বালকবালিকা থেকে ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্তির দিকে যাচ্ছে। 
    সোজন যেমন বা তটিনীর কুল, দুলালী নদীর পানি 
    জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কুল করে টানাটানি 
    নামেও সোজন, কামেও তেমনি, শান্ত স্বভাব তার     
    কুল ভেঙ্গে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার। 
দুলীর ইচ্ছে করে সোজনকে সে লুকিয়ে রাখে তার সিঁদুর কৌটো ভরে। আর সোজনের ইচ্ছে যখন সে খুব বড় হবে, কোনো পাটের নায়ের ভাগী হয়ে দূর দেশে গিয়ে বহু টাকাকড়ি জমিয়ে ফিরে আসবে, তখন দুলীর জন্য নিয়ে আসবে মধুমালা শাড়ি। কিন্তু দুলী শাড়ির সঙ্গে চায় সিঁদুর কৌটো, শাঁখের চুড়ি আর ময়ুরের পাখা। 
    গোরস্থানের কবর খুঁড়িয়া মৃতেরা বাহির হয়ে, 
    সাবধান পদে ঘুরিছে ফিরিছে ঘুমন্ত লোকালয়ে 
    রহিয়া রহিয়া মড়ার খুলিতে বাতাস দিতেছে শীস 
    সুরে সুরে তার শিহরি উঠিছে আঁধিয়ারা দশ বিশ। 
এই প্রেতদের বাস তো শুধু কবরের মধ্যে নয়, আমাদের মগজের মধ্যেও। একদিন দুলীর মায়ের নজরে পড়ল দুলী এখন “ধাড়ী মেয়ে”, তার বয়েস হয়েছে, পাড়ার ধাঙড় ছেলেদের সঙ্গে খেললে লোকেরা কী বলবে! দুলী বয়সের নিষেধ না মানায় সোজনের সামনেই তার পিঠে তিন চারটি কিল পড়ল। অসহায় সোজন এই দৃশ্য দেখে এলোমেলো পায় বনবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে শেষে এসে বসল নিম গাছটির ধারে। তখন পেছন থেকে তার দু’চোখ চেপে ধরল ঘর থেকে পালিয়ে আসা দুলী। তারা ভাবতে বসল বয়স কাকে বলে; কবে তাদের বয়স হল। আর যখন তারা সবে তার কিছুটা আভাস পেয়েছে, দুলী ঠোঁট খুলে দাঁড়িয়েছে সোজনের মুখভরা গান নিজের মুখে ভরে নেবে এই আকাঙ্কায়, রসভঙ্গের মতো দুলীর মা এসে হাজির, কিল থাপ্পড় মারতে মারতে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল আপন বাড়ি। আর শাসিয়ে গেল সোজনের বাপকে ডেকে সব বলে তার বেহায়ামির শাস্তির ব্যবস্থা করতে। 
কিন্তু আমাদের সমাজে গুরুজনদের পক্ষ থেকে এ ধরনের বাধা তো হামেশাই ঘটে। সোমত্ত মেয়েকে আর একটি ছেলেকে সম্ভবত চুম্বনের পূর্বমুহুর্তে আবিস্কার করলে মায়েদের এমনতর প্রতিক্রিয়াই প্রথ্যাশিত। তবে এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত গ্রামের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বিশেষ ওলটপালট ঘটে না। বরং ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায় যখন মহরমের দিন শিমুলতলীতে বিরাট মহোৎসবে ছমুর পোলা সোজন মস্ত ভূমিকা নেয়। আজ আর ধনীগরিবে কোনো ফারাক নেই। সোজন ভাল গায়েন, লাল গামছা ঘুরিয়ে মাথায় নেচে নেচে সে মহরমের করুণ কাহিনি গায়। গাইতে গাইতে এল যুদ্ধের বিবরণ, কমবখ্ত্ এজিদের বিরুদ্ধে আক্রোশে ফুঁশে উঠল লোকেরা, 
    সেই আগুনে জ্বলে আজি শিমুলতলীর গাঁয়ের সবে 
    এবার তারা মাতবে যেন বহ্নি-নাগের মহোৎসবে 
আর সেই ভয়ঙ্কর নাচে শিমুলতলীর শুধু মুসলমানরা নয়, নমশূদ্ররাও এসে মহা উল্লাসে যোগ দিল। গদাই মোড়ল লাঠি ঘোরায়, নিতাই ধোপা খোলা কৃপাণ হাতে নাচে। উৎসবের শেষে লাঠি খেলা। লাঠির খেলায় সাতগেরামে প্রধান মদন মিঞা। তাকে এসে সোজন বিনয় করে বলে, চাচা তোমার সঙ্গে পারব না জানি, তবু বড় ইচ্ছে এক হাত খেলি। প্রচণ্ড খেলা শুরু হল, চার বারের বার সোজনের লাঠির পালটা দিতে গিয়ে মদন মিঞার লাঠি চলে গেল সোজনের হাতে। 
কাব্যকাহিনীর এই অংশ (এবং এটি যদি মঞ্চে অভিনীত হয় এই দৃশ্য) পাঠক তথা দর্শককে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। মাইকেলকে জসীমউদ্দীন পাহাড়ের চুড়া থেকে নামিয়ে এনেছেন গ্রামের সমতল জমিতে-এখানে অমিত্রাক্ষর চলে না- কিন্তু কবির ভাষা এখানে খুবই দ্রুতগতি এবং মানানসই। এমনিতর জমজমাট নাটকীয় ঘটনা এই কাহিনীতে আরও আছে। 
মদন মিঞা সোজনকে সাবাস দিয়ে বলে, তিরিশ বছর এই লাঠি ছিল আমার প্রাণ, ভেবেছিলাম যখন গোরে যাব এ লাঠি ধুলোয় পড়ে থাকবে। সে লাঠি ধরবার যোগ্য লোক যে আজ পেলাম এ আনন্দ রাখার জায়গা নেই। এই লাঠি এখন তোমার। 
আর ঠিক যখনই এই কাহিনী রাজসিক বিজয়পর্ব থেকে সাত্ত্বিক ত্যাগ পর্বে উঠে এসেছে সেই মুহুর্তে তামস পর্ব এসে সব গ্রাস করে নিল। সামান্য কী কারণ নিয়ে হঠাৎ নমুন-মুসলমানের মধ্যে কাজিয়া শুরু হয়ে গেল। বাইরে থেকে অনেকে এসেছিল কাজিয়া বাধাবার উদ্দেশে, তাদের আক্রোশ শিমুলতলীল এই শান্ত অসাম্প্রদায়িক মেলামেশার ওপরে। সাউদ পাড়ার, ভাজনপুরের শেখরা দলে দলে এসে জমা হয়েছিল। নমুরা মহরম উৎসব ছিল নিতান্তই সংখ্যালঘু। তারা সবাই বেদম মার খেল। কাহিনীর এক-চতুর্থাংশে পৌঁছে কাহিনীর মোড় পালটে গেল, লিরিক রূপ নিল নাটকে, প্রেমের কাহিনীতে প্রবেশ করল সমকালীন সাম্প্রদায়িক আখচা-আখচির ইতিহাস। 

রামনগরের নায়েব মশায়-চাষির ভিটের ঘুঘু চরানো যার পেশা, চাষির রক্ত শুষে যার দালানকোঠা-তার কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গদাই আর নমশূদ্রর দল। নায়েব মশাই ঠিক করেছিলেন শিমুলতলী থেকে নমু আর নেড়ে দুই-এরই উচ্ছেদ করে সেখানে জমিদারের হাট বসাবেন, এতদিন নমশুদ্র আর মুসলমানদের সৌহার্দ্যরে সামনে তাঁর প্যাঁচ খাটছিল না। যেই খবর পেলেন সেই সৌহার্দ্য টুটে গেছে, অমনই তার গোড়া হিন্দুত্বে আঘাত হাবে। রফেকালীর মালা গলায় জড়িয়ে হুকুব দিলেন শিমুলতলীর গ্রাম থেকে মুসলমানদের একেবারে উচ্ছেদ করে দিতে তিনি এর দলবল পেছনে থাকলে রক্ষাকালীর আশীর্বাদে ভয়টা কোথায়। উচ্ছেদের প্রস্তাবে ঘাবড়ে গিয়ে গদাই এবং আরো কিছু নমশুদ্র প্রবীণজন আপত্তি তুলল। 
এক গেরামের গাছে তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে
মাথার ওপর একই আকাশ হাসছে নানা রঙের নীলে
এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি
সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি।
যারা আমাদের মেরেছিল তারা ভিন্ন দশ গেরামের লোক। শিমুলতলীতে যে মুসলমানরা থাকে তারা সংখ্যায় অনেক কম। তারা ভাইয়ের মতো, তাঁদের কি করে উচ্ছেদ করব? 
নায়েব মশায় তখন তাঁর চরম অস্ত্র ছাড়লেন। মুসলমানদের যদি তোরা মেরে না তাড়াস, দু’চার  দিনের মধ্যে ডিক্রিজারি করে তোদের সব কটাকে গ্রামছাড়া করব। নিরুপায় নমুরা নায়েবের নির্দেশ মেনে নেয়, বলে রক্তখাকির এই আদেশ। 
শিমুলতলীর মুসলমানদের কাছে এ খবর পৌঁছতে দেরি হল না।  মসজিদে যুবা-বুড়ো সকলের জমায়েত। প্রাচীন হাজি সাহেব শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি বললেন কাজিয়া/লড়াই না করে, চল আমরা মুসলমানেরা সকলে শিমুলতলী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই, বসত করি। প্রশান্ত মুখ, মমতা জড়ানো আশি বছরের বৃদ্ধ মনির মুন্সির কথা উষ্ণরক্ত তরণরা গুনবে কেন? তাদের মুখপাত্র হয়ে সোজন বলল, প্রাণ দেব কিন্ত আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে কিছুতেই পালাব না। 
গাছেরা ইহার দোলায়েছে ছায়া, বাতাস করেছে মায়ের মত
মাটি দেছে তার সোনার ফসল লাঙলের গায়ে হইয়া ক্ষত।
বাপ ভাইদের কবর খুঁড়িয়া শোয়ায়েছি এর মাটির তলে
ভিজায়েছি এর শুস্ক ধূলিরে কত বিষাদের নয়ন জলে।
এ গাঁও ছাড়িয়া যাব না যাব না, রক্ষা করিতে ইহার মাটি,
প্রাণ যদি যায় সে প্রাণ হইবে বাঁচাব চাইতে অনেক খাঁটি।
মুন্সি কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে পারলেন। মুন্সি সাহেবের পিছনে পিছনে দেশ ত্যাগ করে চলল শিমুলতলীর সর্বস্বাস্ত মুসলমমানরা। পিছনে পড়ে রইল পূর্বপুরুষের কবরস্থান যেখানে শবেবরাতের রাতে আর মোমবাতি জ্বলবে না। মুন্সি সাহেবের- 
পিছে পিছে শিমুলতলীর সকল মানুষ চলেছে কাঁদি,
পৃথিবীর যত অন্যায় আর বেদনার যেন হইয়া বাদী।
এদিকে নায়েবের কাছে কথা দিয়ে এসে নমশূদ্ররা মুসলমান প্রতিবেশীদের সমূলে উচ্ছেদের জন্য তৈরী হচ্ছে। অষ্টম সর্গে তারই বিবরণ। এ সর্গ-ও বেশ নাটকীয়, জমজমাট। মুসলমানদের গ্রামত্যাগের বার্তা তখনও এসে পৌঁছয়নি। 
উল্লাস ভরে নাচে নমুদল মশালের পর মশাল জ্বালি
খড়গ ঘুরায়ে, সড়কী ঘুরায়ে ডাক ছেড়ে চলে হাজার ঢালী।
চলে আসে তারা বাঙড়ের পথে, চরণে মথিত মেদিনী মাটি
হাতে উলঙ্গ আগুন নাচিছে, কালো মশালের ধরিয়া ডাঁটি।
কিন্তু যেমন মুসলমানদের ক্ষেত্রে তখনও ঠাণ্ডা মাথা মিষ্টি স্বভাবের মুন্সি সাহেবের করুণ নির্দেশের প্রাধিকার ছিল, তেমনই নমশূদ্রদের ওপরেও তাদের বিচক্ষণ গদাই মোড়ল ভ্রাতৃহত্যার বিরুদ্ধে শেষ মুহুূর্তে তার ক্যারিজম্যাটিক প্রভাবকে সেদিন সপ্রতিষ্ঠ করতে পেরেছিল। মোদ্দা কথা মুসলমানরা গ্রাম থেকে বিতাড়িত হল বটে, কিন্তু যে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ঘটতে চলেছিল দু’পক্ষেই বুঝদার নেতা থাকায় শিমুলতলীতে সেদিন তা ঘটল না। রক্তপাত না করেই নমুরা তাদের গাঁয়ে ফিরে গেল। 
কিন্তু রাতের অন্ধকারে মুসলমানেরা শিমুলতলী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যখন আবার সকাল এল, জল থই থই দিঘির ধারে কুমারী মেয়েরা যখন নীরবে মাঘ-মণ্ডল ব্রতের শোলক পাঠ করছে, শিশুদের কাকলীতে নমুদের বাড়িগুলি ভরে গিয়েছে, তখন আকস্মিক বজ্রাঘাতের মতো খবর এসে পৌঁছল সন্ত্রস্ত গোটা মুসলমান সমাজের স্বদেশের কথা আলাদা। কিন্তু “নমু মেয়েদের চোখ ভরে আসে জলে”। আর দুলালী? বীরপর্ব, ষড়যন্ত্র পর্ব, সম্ভাব্র যুদ্ধপর্ব এবং স্বভূমি থেকে নির্বাসন পর্ব পাঁচ থেকে আট পর্ব (পৃঃ ২৬-৫৫) -পেরিয়ে আমরা ফিরে আসি আমাদের মূল কাহিনীতে। শিমূলতলী ত্যাগের সময় সোজন দুলালীকে কিছুই বলে যেতে পারেনি। দুলালীর সম্বল এখন বিগত দিনের নানা সুখস্মৃতি, আর বর্তমানের শূন্যতা আর অনিশ্চয়তা। কে আছে যার কাছে দুলী তার মনের কথা খুলে বলতে পারে? তার আশৈশব বন্দু সোজন যে তার জীবনের কতখানি সে কথা কে জানে? এদিকে গদাই মোড়ল তার আদরিনী মেয়ের বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। নতুন উৎসরে স্রোতে পড়শিকে দেশত্যাগের সকরুণ স্মৃতি সহজেই ভেসে যায়। নমুদের পাড়ায় বিয়ের গানে আকাশ-বাতাস ভরে উঠেছে। সবাই বিয়ের বিরিধ উদ্যোগ আয়োজনে ব্যস্ত। এদিকে অন্যেরা না শুনুক দুলী শুনেছে রাতের বেলা বাঁশির সেই মর্মভেদী উদাস সুর, দুলীর বুকের কান্দনখানি ধরা পড়েছে যে সুরে। সবাই যখন উৎসবে ব্যস্ত বিয়ের কনে হলুদ চান করে, লাল চেরি পরে, আলতায় পা রাঙিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে সেই বনের কিনারায় যেখানে পলাতক সোজনের বাঁশি বাজে। তারপর এই গাথার দশম পর্ব জুড়ে দুই প্রেমিক প্রেমিকার যে সকরুণ আলাপ নিরলংকার ভাষায় তার সরল গভীর অনুভূতি আমাদের আলোড়িত করে। দুলী নিশ্চিন্ত জানে সোজনকে ছাড়া তার পক্ষে বাঁচা অসম্ভব, সে সাক্ষী মানে চন্দ্র, বনের গাছপালা, বিশ্বজগৎকে যে সোজন ছাড়া ইহকালে পরকালে তার আর কেই কোশাও নেই। সে সোজনকে বলে কোনো অজানা দূরে দেশে তারা পালিয়ে গিয়ে বাসা বাঁধবে, যত বাধাবিপত্তিই আসুক তারা পরস্পরকে কখনো ছাড়বে না। কিন্তু সোজন পুরুষ, শুধু প্রেমিক এবং শক্তিশালী নয়, বিবেকবানও বটে। সে জানে, তারা যদি পালিয়ে যায় তার দাম দিতে হবে সেই মুসলমানদের যারা শিমুলতলী গাঁ থেকে পালিয়ে এসে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। নমশূদ্ররা এত বড় সর্বনাশের দায় সে কেমন করে নেবে? তা ছাড়া তাদের এই মিলন কোনো সমাজই তো মেনে নেবে না। তারা একদিন না একদিন ধরা পড়বে, ভয়াবহ শাস্তি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু দুলীর গভীর একান্ত আবেদনের স্রোতে সোজনের সব বিবেচনা বিবেকিতা ও আপত্তি ভেসে যায়। সোজন বলে ঃ 
    সাক্ষী থাকিও আল্লা-রসুল, সাক্ষী থাকিও 
    যত পীর-আউলিয়া, 
    এই হতভাগী বালিকারে আমি বিপদের পথে
    চলিলাম নিয়া। 
    সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য! সাক্ষী থাকিও 
    আকাশের যত তারা, 
    আজিকার এই গহন রাতের অন্ধকারেতে 
    হইলাম ঘর ছাড়া। 

দুলী আর সোজন এসে পলাতক প্রেমের কুড়ে বাঁধে গড়াই নদীর তীরে। জসীমউদ্দীনের শব্দ দিয়ে আঁকা ছবির পর ছবি-চোখ জুড়িয়ে যায়। কুটিরের বেড়ার গায়ে দুলী এঁকেছে যেমন বেহুলা-লখাই, জন্মদুখিনী সীতার ছবি তেমনই তারই পাশাপাশি কারবালার করণ কাহিনী। আর এঁকেছে ডালিম গাছের নীচে লায়লা মজনুর কবর, আর ছেড়ে আসা সেই শিমুলতলী গাঁয়ের মসজিদ। 
কিন্তু প্রেমের এই লিরিকের পিছনে উঠছে ট্র্যাজিকের ঝড়। বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে কনে, সারা গ্রাম বেরিয়ে পড়েছে তাঁর খোঁজা। খোঁজ না পেয়ে অবশেষে আবার সেই নায়েবেরই কাছে প্রণিপাত। নায়েব তো এমনই একটু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এবারে সে নমশূদ্রদের ক্ষেপিয়ে তুলল। এর শোধ তোলবার উপায় মুসলমানদের একেবারে কচুকাটা উচ্ছেদ। চাগিয়ে উঠল খুনে বৃত্তি। এদিকে মলুদ-শরিফ উপলক্ষে মোল্লা বাড়ির উঠানে সাত গেরামের ছেলেমেয়ে সাজগোজ করে উৎসব করতে একত্র হয়েছে। সেখানে শুভ্র কেশ শুভ্র শ্মশ্রু মনির মিঞা কোরাণ পাঠ করছেন, তাঁর দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে লুবানের ধোঁয়ার মতো সুগদ্ধ। সবাই একমনে নবীর কাহিনী শুনছে। এমন সময় উৎসবের সুর কেটে গেল। খবর এল নমুরা দল বেঁধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুসলমান নিধন করতে আসছে। এবারে লড়াই অনিবার্য, মুন্সি সাহেব যখন অনেক বলেও তাদের শান্ত করতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত হার মেনে বললেন তোমরা যদি সবাই লড়াই করেই মরতে চাও তবে আমাকেও সঙ্গে নাও। তারপর পঞ্চদশ সর্গে সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গার বিবরণ। 
    গ্রাম জ্বলিল, ঘর পুড়িল, দেশ হল ছারখার 
    কিবা নমু মুসলমানের হুস নাহিক কার। 
    সকল মানুষ হদ্দ বেহুঁশ পতঙ্গেরই মত,- 
    আপন হাতে জ্বালল আগুন, আপনি হতে হত। 
সারাদেশে হাহাকার উঠল, “শ্মশান ঘাটায় রাত্রিদিবায় চিতার পরে চিতা”, আর গ্রাম জুড়ে কবরের পর কবর। ফায়দা ওঠালেন নায়েব মশায়। শিমুলতলীতে তাঁর আগের উদ্দেশ্য অনুযায়ী গ্রাম উচ্ছেদ করে জমিদারের হাট বসল। সোনার শিমুলতলীতে 
    নমু-মুসলমানের কেহ আর নাহি সে গাঁয়। 
    আজকে তারা চিতায় চিতায়, গৃহন মাটির গোরে, 
    ঘুমিয়ে আছে, হাজার ডাকেও শব্দ নাহি করে। 
দুলালী-সোজন কিন্তু এই দাঙ্গার মধ্যে পড়েনি। বেশ সুখেই অজ্ঞাতবাসে ছিল তারা। কিন্তু সোজন তো পুরুষ, সে ঠিক করল অন্য গাঁয়ের এক পাটের ব্যাপারীর সঙ্গে ভাগে কাজ করবে, তাতে নাকি “কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা”। ব্যাপারীর সঙ্গে কয়েক দিনের জন্য দূরে সফরে যাবে। ফেরবার সময় দুলীর জন্য আনবে “জলে-ভাসা-শাড়ী”, “ময়ূরের পাখা”, “গলার হাঁসুলী”, “দুটি পায়ের গোল খাড়ু।” দুলীর মিনতি নিষেধ সে মানল না, বেরিয়ে পড়ল ব্যাপারীর নাওয়ে। দিনের পর দিন যায়, দুলী তাদের জীবনের কাহিনী ঘরের দেয়ালে একটির পর একটি আঁকে, আর শেষে আঁকে গড়াই নদীতে দুরদেশী মাঝির নৌকো, আর 
    ঘাটের কেনারে প্রতীক্ষমানা দাঁড়ায়ে একটি মেয়ে
    দুটি চোখ তার ভরিয়াছে জলে কাঁখের কলসী চেয়ে। 
হায়রে প্রতীক্ষা! সোজন ফেরে বটে, তবে পুলিশের সঙ্গে, হাতে হাতকড়া পরে। নায়েব তার নামে নারী হরণের মামলা ঠুকে দিয়েছে। বিচারের তার সাত বছরের জেল হয়। কিন্তু মহা ঘোড়েল নায়েবও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায় না। দাঙ্গা করতে গিয়ে গদাই মোড়ল তার সাত সাতটি পোলা হারিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার শোধ তুলল। একদিন বিলের ধারে খুঁড়ে পাওয়া গেল কবরের গর্তে নায়েব মশায়ের আধখানা শরীর। 
কিন্তু না, কাহিনী এখানে শেষ হয়নি। বাংলাদেশের গ্রাম ইথাকা নয়, সেখানে দুলীর পক্ষে পেনেলোপি হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সাত বছর দীর্ঘ সময়। দুলীর কথা কে শুনবে? তার “মনের অনল যে নেভে না” কবি ছাড়া সে কথা জানে? যে বিধি দুলীর কপালে এমন দুর্ভাগ্যের কথা লিখেছিল তার কি নিজের কখনো এই যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা হয়েছে? দুলীর আবার বিয়ে হয়-তার সিঁথেয় সিঁদুর, দু-হাতে কাঁকন, গোলাভরা ধান, “চন্দ্রের সম সোয়ামীর খ্যাতি”। এদিকে সাত বছর কেটে গেছে, সোজন ছাড়া পেয়ে যোগ দিয়েছে বেদের দলে। একদিন এই দল ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছল দুলীদের গ্রামে। মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল বেদে-বেদেনিদের কাছে হরেক রকম সৌখিন জিনিস কেনবার জন্য। দুলীও এল, আর এক বুঝি অচিন বেদে তাকে বলল ঃ    তোমার লাগিয়া এনেছি কন্যা, 
    রাম লক্ষণ দুগাছি হাতের শাঁখা, 
    চীন দেশ থেকে এনেছি সিঁদুর 
    তোমার রঙিন মুখের মমতা মাখা। 
কী দাম শুধাতে বেদে বললঃ 
    আমার শাঁখার কোনো দাম নাই
    ওই দু’টি হাতে পরাইয়া দিব বলে, 
    বাদিয়ার ঝুলি মাথায় লইয়া 
    দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া নয়ন জলে। 
    সিঁদুর আমার ধন্য হইবে, 
    ঐ ভালে যদি পরাইয়া দিতে পারি, 
    বিগানা দেশের বাদিয়ার লাগি 
    এইটুকু দয়া কর তুমি ভিন-নারী । 

এরপর কি আর বেগানা দেশের বাদিয়া আর ভিন দেশের নারীর মধ্যে কোনও আড়াল বজায় থাকতে পারে। কিন্তু দুলী যে তার নতুন সংসারে জড়িয়ে গেছে। স্বামী থাকতে প্রণয়ীকে গ্রহণ করবার মতো মেয়ে তো সে নয়। 
    কে তুমি? কে তুমি? সোজন! সোজন! 
    যাও-যাও তুমি! এক্ষুনি চলে যাও! 
    আর কোনো দিন ভ্রমেও কখনো 
    উড়ানখালীতে বাড়াওনা তব পাও। 
    ভূলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি 
    সোজন বলিয়া কে ছিল কোথায় কবে, 
    ভ্রমেও কখনো মনের কিনারে 
    আনিনাক তারে আজিকার এই ভবে। 
কিন্তু ভুলেছি বললেই কি ভোলা যায়? তবু দুলী বারবার সোজনের মনে আঘাত দিয়ে বলল, পুরোনো সব স্মৃতি মুছে ফেলতে। সাত বছর ধরে সোজন যে স্বপ্ন নিয়ে বেঁচেছিল তা দুলীর প্রত্যাখানের আঘাতে ভেঙে গেল। বুকে চিতার জ্বালা নিয়ে টলতে টলতে সোজন ফিরে চলল। কিন্তু দেবতারাই নাকি নারী চরিত্র বোঝেন না, সোজন তো নিতান্ত চাষির ঘরের ছেলে, এখন বেগানা দেশের বেদে। সে তার বুকের ব্যথা উজাড় করে বাঁশি বাজাতেই জানে। সেইদিন রাতে দুলী খুব সাজল, পরনে জামদানি শাড়ি, পায়ে হাতে আলতার দাগ, সিঁথিতে পুরু করে সিঁদুর, নানা ফুলে সেজে যে স্বামীর সঙ্গে সে ছ’মাস কথা পর্যন্ত বলেনি, তাকে অনেক ভালবাসার কথা বলল। কিন্তু নিষ্ঠুর বাঁশি যে বেজেই চলেছে। দুলী সব ঘরদোর জানলা বন্ধ করল, কানে তুলো দিল, কিন্তু বাঁশি যে তাকে ডেকেই চলেছে। বাঁশির সুর শুনতে শুনতে তার স্বামী ঘুমিয়ে পড়ল। তখন অসহায় দুলী কী করে! 
    সাক্ষী থাকিও চন্দ্র সুর্য আর যত দেবগণ 
    তোমরা সকলে শুনিতেছ এই অভাগীর ত্রুন্দন। 
    সাক্ষী থাকিও সিঁথার সিঁদুর, আমারে ডাকিছে বাঁশী, 
    কাঞ্চা বয়সে পরাইয়া মোর গলায় কঠিন ফাঁসী।.... 
    সাক্ষী থাকিও রাতের আঁধার-তারার বসন ধরে, 
    সাক্ষী থাকিও বসুমতী মাতা, নাগের মাথার পরে; 
    এই হতভাগী চলিল আজিকে লয়ে তার ভাঙা বুক, 
    নিয়ে যাও সবে-নিয়ে যাও তার জীবনের সব সুখ। 
স্বামীর পায়ে কপালখানি ঘসে শেষ বিদায় নিয়ে দুলী দুয়ার খুলে অন্ধকার পথে বেরিয়ে পড়ল। বাঁশি তখন চিরবিদায়ের সুরে বাজছে, দুলী তোমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছি, এই ভেবে ক্ষমা করো আমি তার হাজার গুণ ব্যথা পেয়েছি। অবশেষে দুলী এসে পৌঁছল সেই বাঁশিওয়ালার কাছে। কিন্তু তার আগেই গভীর হতাশায় সোজন বিষ-লক্ষের বড়ি খেয়েছে। এখন শুধু দুলীর রূপটুকু শেষবার দেখতে দেখতে সে চিরকালের মতো চোখ বুজতে চায়। আর যখন তার না আছে ফেরার পথ না মিলিত জীবনের সম্ভাবনা, তখন বড় বেদনায়, বড় অসহায় আত্মোদ্ঘাটনে দুলী ডুকরে উঠল ঃ 
    তোমরা পুরুষ কি করে বুঝিবে একেরে পরাণ দিয়া, 
    নারীর জীবন কি করে বা কাটে আরেরে বক্ষে নিয়া। 
    নিজের সঙ্গে অনেক যুঝিয়া পারিলাম নাক আর,
    বুঝিলাম আর সাধ্য নাহিক এ জীবন বহিবার।.... 
    আজো দুলী তার সোজনেরে ছাড়া কাহারেও নাহি জানে, 
    সোজন তাহার ঘরে ও বাহিরে দেহে মনে আর প্রাণে। 
কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। নতুন করে শুরুর আর সময় নেই। পরদিন গাঁয়ের লোকেরা এসে দেখল বালির চরে “একটি যুবক একটি যুবতী আছে গলাগলি করি” আর তারপর থেকে নদীর সেই ঘাটটির নাম সোজন বাদিয়ার ঘাট। 













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় ১৬ বছরের কিশোর নিখোঁজ: খোঁজ দিতে পরিবারের আকুতি
কুমিল্লার ১৮ থানার লটারির মাধ্যমে নতুন ওসির পদায়ন
আমি রাজমিস্ত্রির ছেলে এমপি ইলেকশন করছি এটাই তো বড় বিষয়: হাসনাত আব্দুল্লাহ
মাধ্যমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি স্থগিত
বাঁচতে চায় ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত কুবি শিক্ষার্থী অনন্যা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা নগরী যানজটমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান
আমি রাজমিস্ত্রির ছেলে এমপি ইলেকশন করছি এটাই তো বড় বিষয়: হাসনাত আব্দুল্লাহ
কুমিল্লার ১৮ থানার লটারির মাধ্যমে নতুন ওসির পদায়ন
লাকসামে রেললাইনের পাশ থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৯
যে কারণে টিউলিপের সাজা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২