
আপন মানুষ
সম্পর্কে কিছু লেখা বিব্রতকর। কারণ, শেষপর্যন্ত সবকিছু লেখা হয়ে উঠে না।
আবার অনেককিছু লেখাও যায় না। হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক বহুমাত্রিক প্রতিভায়
সফলব্যক্তি। তিনি আমার কাছে শুধুই ‘ফটিক’। এই ফটিককে নিয়ে কিছু লেখবার জন্য
তাঁর ছোটমেয়ে আদেশ জারি করেছেন। তিনি পিতাকে দু’মলাটের মধ্যে শ্রেণিবদ্ধ
করে আমাদের অনুভূতিগুলো সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। কন্যার দায় যতটুকু নয়,
আমাদের দায়ভার লাঘবের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ।
ফটিকের
কথা বলতে গেলে প্রথমেই তাঁদের পরিবারের অভিভাবক খ্যাতিমান স্বনামধন্য
শ্রদ্ধাভাজন মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদারকে দিয়ে শুরু করতে হয়।
১৯৭২
সালে ১৫ ডিসেম্বর আমি কুমিল্লা মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক (প্রভাষক)
হিসেবে যোগদান করি। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের তখন অধ্যাপক বলা হতো।
নিয়োগপত্রেও এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। তখন কলেজের পরিচালনা পর্ষদ ছিল
‘এডহক কমিটি’ পরিচয়ে। মরহুম এম,এ মালেক বি,এ এম,সি,এ ছিলেন সভাপতি,
স্বর্গীয় অনাথবন্ধু রায়, মরহুম আবদুর রউফ (জেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদক),
শিক্ষক পরিষদ থেকে অধ্যাপক ওয়াজুদ্দীন (তিনি তখন আওয়ামীলীগের প্রচার
সম্পাদক) সদস্য ও কলেজ-অধ্যক্ষ মরহুম মোসলেহউদ্দিন আহমদ সদস্য-সচিব।
যোগদানের পর শুনতে পাই পূর্বতন কমিটিতে প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট মরহুম রুহুল
আমীন ও মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদার সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালে কুমিল্লা
জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালে কবি কাজী
নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি মর্যাদা দিয়ে মে মাসের ২৪ তারিখ কোলকাতা থেকে ঢাকা
নিয়ে আসা হয় এবং যথামর্যাদায় জন্মজয়ন্তী রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়।
যেহেতু নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য কুমিল্লা ও মুরাদনগরের দৌলতপুর, সেজন্য
১৯৭৩ সালে কবির জন্মজয়ন্তীতে কবিকে সশরীরে কুমিল্লায় আনার জন্য
জেলাপ্রশাসন, নজরুল পরিষদ ও নজরুল অনুরাগীরা যোগাযোগ ও আয়োজনের প্রস্তুতি
নিতে শুরু করেছেন। তখনই জাতীয় কবিকে সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে একটি প্রবন্ধ
উপস্থাপন করার জন্য কবি-বন্ধু সুলতান মাহমুদ মজুমদারকে অনুরোধ জানানো হয়।
তিনিও সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তখন শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে একটি প্রবন্ধ
রচনা করেন। যখন তিনি প্রবন্ধটি লিখে শেষ করলেন, তখন কীভাবে যেন আমার নামটি
তাঁর বিবেচনায় চলে আসে এবং প্রবন্ধটি প্রাথমিকভাবে পাঠ করার জন্য একদিন
সকালে তিনি, নাজিরিয়া প্রেসের মালিক ও একজন অ্যাডভোকেট (অধ্যক্ষ রেজাউল
করিমের পিতা, নানুয়াদিঘির পশ্চিমপাড়)-এই তিন বৃদ্ধ প্রাতঃভ্রমণ করতেন
নানুয়া দিঘির পাড়ে, তাঁরা দিগম্বরীতলায় আমার ভাড়া বাসায় এসে হাজির, নিজেদের
পরিচয় দিলেন, অভ্যর্থনা জানানোর সুযোগ দিলেন না। মজুমদার সাহেব
বললেন-‘শুক্রবার সকালে নানুয়াদিঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘শাহানা মঞ্জিল’-এ
আপনার চা-এর দাওয়াত, আপনি আসবেন। আগেই বলেছি, তাঁদের স্ব স্ব পরিচয় দিলেন,
তাঁরা আমার পিতার বয়সী। নির্ধারিত শুক্রবার গিয়েছিলাম, বসার পর যে মেয়েটি
চা-নাস্তা নিয়ে এলো, তাকে কলেজে ক্লাশে দেখেছি। মজুমদার সাহেব পরিচয় করিয়ে
দিয়ে বললেন-‘আমার ছোটভাইয়ের মেয়ে যদুফা, আপনার ছাত্রী।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৩
সালে বা পরেও কবি নজরুল ইসলামকে কুমিল্লায় আনা সম্ভব হয়নি। অবশ্যই শারীরিক
অসুস্থতার কারণে। মজুমদার সাহেবের প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে মনে হলো-এই প্রবন্ধের
আলোকে একটি বই লেখা যায়। এই প্রস্তাব জানিয়ে অনুরোধ করায় তিনি অনুকূল সাড়া
দিলেন এবং তাঁর অসাধারণ গবেষণামূলক স্মৃতিকথার আদলে ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন
কবি’ বইটি প্রথমে নজরুল পরিষদ, কুমিল্লা এবং পরে ঢাকা নজরুল ইন্সটিটিউট
প্রকাশ করে। বইটির ভূমিকা লিখেন ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ এনামূল হক। এই
বইলেখার সূত্র ধরেই আমি মজুমদার সাহেবের পরিবারের অঘোষিত সদস্য।
মরহুম
সুলতান মাহমুদ মজুমদার ছিলেন বিপত্মীক। তাঁর একমাত্র মেয়ে বিবাহিত। তাঁর
স্ত্রীর নাম শাহানা, আদি নিবাস ত্রিপুরা কুলুবাড়ি, ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম
মুসলিম গ্রেজুয়েট ও ম্যাজিস্ট্রেট। কুমিল্লায় বাড়ি ক্রয় করে বাড়ির নাম
রাখেন ‘শাহানা মঞ্জিল’। আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয়, তখন তাঁর সঙ্গে
ছোটভাইয়ের সদস্যেরা থাকেন, তাঁরাই তাঁর নিজস্ব পরিবার-পরিজন এবং ভাইয়ের
সন্তানাদির অভিভাবক ও তাঁদের লেখাপড়াসহ সকল দায়িত্ব পালন করছেন। বলতে
দ্বিধা নেই জনাব আলী ইমাম মজুমদার, প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও হাসান
ইমাম মজুমদার ফটিক অধ্যক্ষ-তাঁর পরিচয়েই ঋদ্ধ।
ফটিকের দু’কন্যা।
জ্যেষ্ঠটি আমেরিকাবাসী, ছোটটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স
বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। গুণিকন্যাদ্বয় নিয়ে ফটিক-সেলিনা (কাজী সেলিনা
আক্তার) দম্পতি সংগতকারণেই গৌরবান্বিত। ছোট কন্যারত্নটি ‘একটি অনুরোধ
পত্র’-এ ‘আমরা আমার বাবা সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে আগ্রহী’-এই
প্রত্যাশায় স্মৃতিকথায় ফটিককে উপস্থাপন করার জন্য বলেছেন। সন্তান বাবাকে
অন্যের মূল্যায়নে আবিষ্কার করতে চায়, এ এক অভিনব প্রত্যাশা। আমরা
জানি-সন্তান বাবা-মাকে যতটুকু জানে-চিনে-বুঝে অন্যেরা কিন্তু সেভাবে নয়। এ
ক্ষেত্রে সন্তানরা আবেগ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পরও নির্মোহ বিচারক। সন্তানের
কাছে বাবা-মা দেবতা, স্রষ্টার পরই তাঁদের স্থান বা স্রষ্টার প্রত্যক্ষ
প্রতিনিধিও তাঁরাই। অন্যের কাছ থেকে জানাটা অবশ্যই পোশাকী, নির্মোহভাবে
অন্যেরা মূল্যায়ন করতে দ্বিধান্বিত থাকে। তারপরও কথা থেকে যায়।
হাসান
ইমাম ফটিককে আমি প্রথমত চিনেছি মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদারের
ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে, তখন তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছেন।
স্বনামধন্য ইউসুফ হাই স্কুলের ছাত্র তিনি। ছাত্রাবস্থায় খেলাঘর আসরের কর্মী
ও স্কাউটের সদস্য ছিলেন এবং আজীবন এ দু’সংগঠনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
আছেন। কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যে অনার্স পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশের
পর অধ্যাপনায় যোগদান করেন। স্থিতিটা অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক।
অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, তাঁর সুপারিবাগানের বাড়ি আমার কাছে প্রাণধারণের
আজীবন অনুপম আধার। এ বাসা থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিক ও
বাংলা বিষয়ে অনার্স পাশ করেছি, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর
পড়েছি ও পাশ করেছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়াশোনা করার মূল প্রেরণা অধ্যাপক
অজিতকুমার গুহ। সুপারিবাগানের গুহবাড়িতে অজিতগুহ মহাবিদ্যালয় স্থাপিত
হয়েছে, এ আমার তীর্থক্ষেত্র, এ তীর্থক্ষেত্রের একজন অন্যতম পুরোহিত ফটিক
প্রথমে প্রভাষক, মেধা-যোগ্যতা-কর্মদক্ষতায় বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে
অতিক্রম করে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ। অধ্যাপনায় ও কলেজ প্রশাসনে ৩৫ বছর বিচরণ
করেছেন সুনামের সাথে। তাঁর পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি-অধ্যক্ষ
হাসান ইমাম মজুমদার যখন উপাধ্যক্ষ এবং অধ্যক্ষ ছিলেন- এ কলেজটিকে গৌরবের
শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ভাষা-সংগ্রামী অধ্যাপক অজিতকুমার
গুহ-এর একুশে পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন, জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কয়েকটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করণ, অবকাঠামোগত
উন্নয়ন, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক স্থাপন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও জাতীয়
দিবসগুলো উদ্যাপন ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর সৃজনশীল কর্মপ্রবাহ কলেজের
প্রাণশক্তিকে সবসময় উচ্চকিত করে রেখেছিল। ফটিকের একান্ত আগ্রহে আমাকে
কলেজের পরিচালনা পর্যদের একজন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং কাছ
থেকে সবকিছু দেখার ও উদ্যাপন করার সুযোগ লাভ করি, করছি। শূন্যস্থান পূরণ
হয়, বিকল্প হয় না- কেন জানি এমুহূর্তে এ বিষয়টি মনে উঁকি দিয়েছে। অজিতগুহ
মহাবিদ্যালয় ও ফটিককে নিয়ে লিখলে একটি ছোটখাট বই লেখতে অসুবিধা হবে না হয়ত।
ফটিকের
বহুমাত্রিক পরিচয়ের মধ্যে তিনি শিক্ষক, এটাই আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও
গৌরবের মনে হয়েছে। কারণ, প্রতিটি মানুষের একটি মৌলিক পরিচয় থাকে, এটা তার
ভিত্তি। অন্যান্যগুলো অনুষঙ্গমাত্র। ফটিক রোটারীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত,
সেখানে তাঁর সফল উপস্থিতি এবং কর্মদায়িত্বে উজ্জ্বলতার ছাপ রেখে ক্লাবের
অন্যতম প্রাণপুরুষ। কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য, নির্বাচিত সম্পাদক, নির্বাচিত
সহসভাপতি ছিলেন। ক্লাবের উন্নয়নে এবং জাতীয় পর্যায়ে ক্লাবকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে
এখনও তিনি কেন্দ্র-নায়ক। তাঁকে বাদ দিয়ে, তাঁর পরামর্শ ছাড়া তাঁর সহযোগিতা
ব্যতীত নান্দনিক কোনো ব্যবস্থাপনাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে বিবেচনায়
ক্লাব-পরিবার তাঁকে সেই শ্রদ্ধার স্থানে বসিয়ে রেখেছে। ক্লাবের
শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান তাঁর নেতৃত্বে যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে, সমকালে
এমনটি কারও নজরে পড়েনি। এমন কি রোটারিয়ান দিলনাশিঁ মহসিন রোটারির গর্ভনর
হলেন, তাঁকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, আহ্বায়ক হিসেবে ফটিক যে আন্তর্জাতিক
মানসম্মত একটি মনোমুগ্ধকর আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা অন্য কারও পক্ষে
সম্ভব হতো কি? এভাবে বেসরকারি কলেজ-শিক্ষক পরিষদের নেতৃত্ব, কিন্ডার
গার্ডেন স্কুলসমূহের সংগঠনের নেতৃত্ব, যাত্রিক নাট্য গোষ্ঠির সভাপতি,
কুমিল্লা আর্ট স্কুল ও কলেজের পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য, শিল্পকলা
একাডেমির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, আইন কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য, ইউসুফ
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ অসংখ্য সংগঠনের নেতৃত্বে তিনি চলমান
কৃতীপুরুষ।
ফটিক সফল নেতা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠক, কর্মযোগী পুরুষ। তিনি
স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পথ দেখান এবং এ
ক্ষেত্রে আপসহীন প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব। তার যেকোনো উদ্যোগ নিখুঁত-পরিকল্পিত,
বাস্তবায়ন ত্রুটিহীন। ফটিকের অর্থ-বিত্তের পরিমাণ সম্বন্ধে আমার কোনো
ধারণা নেই। কিন্তু তিনি যে একজন নীরব ও গোপনাচারী দাতা তা অনেকেই জানি না।
ছাত্র/ছাত্রীর পড়াশোনার খরচ জোগানো, কন্যাদায়গ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো, অসুস্থ
ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ প্রদান, যে কোনো সংগঠনের কর্মকাণ্ডে
অংশগ্রহণ-এসবকিছুই তাঁর অঘোষিত ও অপ্রচারিত নীরব সেবা। আমরা কিছু জানি,
অনেকটাই জানি না।
আমার ভালো লাগে-শ্রদ্ধাবানদের প্রতি তাঁর বিনম্রতা,
কথা ও কাজের মধ্যে ভণিতাহীন দৃঢ়তা, ভালো না লাগার প্রতি স্পষ্ট উচ্চারণ,
নিজের অবস্থানের প্রতি সচেতনতা। ফটিক যখনই কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এটা
তাঁর কাছে হয়ে যায় অনেকটা চ্যালেঞ্জ এবং তা শেষপর্যন্ত নান্দনিক ও সার্থক
করে কর্মসমাধান সত্যিকার অর্থেই আমরা ‘ফটিক-মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে
পারি। একটি নিখুঁত ও অনুকরণীয় উপস্থাপনা মনে দাগ কেটে যায়। ফলে তাঁর
সামাজিক গণ্ডি বা পরিমণ্ডল অনেকটাই বিস্তৃত। এ অর্থে কোনো কোনো বিষয়ে তিনি
কুমিল্লার মধ্যে সীমিত নেই। যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার জন্যই আজ জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সদস্য, অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের পরিচালিত ইতিহাস
পরিষদের সক্রিয় সদস্য। তিনি খ্যাতিমান জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান,
ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান, ভাষাবিজ্ঞানী ড.
মনিরুজ্জামান সহ অনেকের প্রত্যক্ষ স্নেহের পাত্র।
ফটিক দীর্ঘদিন
কুমিল্লায় জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীতে প্রকাশিত স্মরণিকার
সম্পাদক ছিলেন। অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মরহুম আবদুর
রউফ- এর উপর লেখা স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক, স্থানীয় পত্রিকায় অনিয়মিত
কলামিস্ট।
হাসান ইমাম ফটিকের মানস-কন্যা হলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নজরুল
মেমোরিয়াল একাডেমি’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কুমিল্লা শহরে শিশু-শিক্ষার এক
নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমান্বয়ে তার পরিসর ও ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা
বেড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের সুনামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুমিল্লার লেখকদের বই
প্রকাশনার বিষয়টি। এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস। লেখকদের উৎসাহিত করার এক
অভিনব অভিযাত্রা। ফটিকের পরিকল্পনার নবতর উদ্যোগের কারিশমা বলা যায়।
আমরা
অনেকেই মনে করি, চাকরি জীবন শেষ হয়ে গেলে ধর্মকর্ম করা ছাড়া আর কোনো কাজ
থাকে না। এটা আমি বিশ্বাস করি না। ফটিক ৩৫ বছরের শিক্ষকতার চাকরি-জীবন শেষ
করেছে ঠিকই, এতদিন ছিল এক গণ্ডীবদ্ধ অবস্থানে, নিয়মের বেড়াজালে। এখন তিনি
মুক্ত মানুষ। অবসর অর্থ কর্মহীন নয়। বিশেষত ফটিকের মতো করিৎকর্মার জন্য তো
নয়ই। আমি মনে করি কুমিল্লার জন্য, বিশেষত কুমিল্লার
ইতিহাস-ঐহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-জনসেবার জন্য ফটিকের অনেক কিছু করার ও দেয়ার
সুযোগ এসেছে। আমাদের দায়িত্ব হলো-এই
কর্মযোগী-উদ্যোগী-করিৎকর্মা-নিরলস-সৃজনশীল ব্যক্তিটিকে মূল্যায়ন করে চলার
পথ সুগম করে দেয়া। যদিও আমরা এতটা উদার নই, নিজস্ব হিসাবের খাতায়
লাভ-ক্ষতির বিষয়টি ঠিক না করে কাউকে সুযোগ দেয়ার মতো মানসিকতা নেই, তারপরও
বিবেকের একটু তাড়না তো থাকে। সামান্য
শুভবুদ্ধি-শুভচেতনা-শুভপরিকল্পনা-শুভচিন্তার তাগিদে উপযুক্ত উপকারী লোকের
জন্য একটু পথ ছেড়ে দিলে তো সামষ্টিক লাভই হবে। এটাই তো মানুষের
স্বভাব-ধর্ম। আমার বিশ্বাস, আমি যতটুকু জানি-ফটিক আমাদের প্রত্যাশা পূরণের
জন্য নিশ্চয়ই প্রস্তুত। অনেকে বলতে পারেন-এ ব্যাপারে আমার বিশ্লেষণ এরূপ
হওয়ার কারণ কি? দ্বিধা নেই-মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদার আমাকে পুত্রাধিক
স্নেহ করতেন, পরিবারের অঘোষিত সদস্য নির্বাচন করে গেছেন, আমি যতটা না, তার
চেয়েও বেশি মজুমদার-পরিবার আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শুভাকাক্সক্ষী
পরিবারের প্রতি কি কোনো দায় নেই? আসলে ফটিক আছে ফটিকের মতো, নিজের
স্বভাব-আলোর সঙ্গে প্রকৃতির আলো মিশে গেলে যে আলোটা আরও উজ্জ্বলতর
হয়-একথাটা কতজনই বা বুঝি। আমার প্রত্যাশা-ফটিকের এ পথ যেন শেষ না হয়।
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথিক-চিত্তে তোমার তরী বাওয়া।
দুয়ার খুলে সমুখ-পানে যে চাহে
তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া।
বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
যাবার লাগি মন তারি উদাসে
যাওয়া সে যে তোমার পানে চাওয়া।
পথে চলাই সেই তো তোমার পাওয়া।।
(পথের গান-রবীন্দ্রনাথ)
