মঙ্গলবার ২ ডিসেম্বর ২০২৫
১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
কপ ৩০ থেকে কি পেলাম
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৪১ এএম আপডেট: ০১.১২.২০২৫ ১:৫২ এএম |



কপ ৩০ থেকে কি পেলাম
কপ হচ্ছে কনফারেন্স অব দ্যা পার্টিস। এর সদস্য দেশগুলো ১৯৯২ সনে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করেছিল। চুক্তিটি হচ্ছে দ্য ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসি সি সি)। বিশ^ জলবায়ু ব্যবস্থাকে মানুষের বিপদজনক তৎপরতা থেকে রক্ষা করাই এর লক্ষ্য। কপের প্রথম সম্মেলন হয় জার্মানির বার্লিনে ১৯৯৫ সনে। ব্রাজিলের বেলেম শহরে আমাজন বনের অংশ রয়েছে। এবারের সম্মেলনের জন্য এ শহর বেছে নেয়ার পেছনেও কারণ রয়েছে। তা হল বিশে^ বনভূমির গুরুত্ব তুলে ধরা। নানাহ পদক্ষেপ নেয়ার পরও বিশ^জুড়ে এখনও বনভূমি উজাড় হচ্ছে। একই সঙ্গে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন, কৃষিকাজ ও জীবাশ্ম জ¦ালানি উত্তোলনের মত শিল্পায়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন খাতের হুমকির মুখে পড়ছে বনাঞ্চল। ১৯৪ দেশের প্রতিনিধিরা এবারের সম্মেলনে যোগদান করেছেন। প্যারিস চুক্তিতে বৈশি^ক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে যে চুক্তি হয়েছিল সে বিষয়ও আলোচ্যসূচীতে ছিল। এ সংকট নিরসনের লড়াইয়ের দায়ী ধনী দেশগুলো আগ্রহ হারিয়েছে। তবে ভাল করেছে চীন। দেশটি সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্মগন করলেও পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জ¦ালানির বড় উৎপাদনকারী। অন্য দেশগুলো এটি অনুসরণ করতে হবে।
আমাজন বিশে^র বৃহত্তম বন হলেও এটা পৃথিবীর মোট আয়তনের একভাগ। জাগুয়ার, ডলফিন, ম্যাকাউ-পাখি, আর্মাডিলো, পিরানহা আর অ্যানাকোন্ডার আবাসস্থল এ বন। ১৫ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি টন কার্বন শোষন করে রাখা এ বনটি প্রতিদিন ২ হাজার কোটি টন পানি ছাড়ে বাতাসে। ৩০০ ভাষাভাষি প্রায় ২২ লাখ অধিবাসী জাতির ঠিকানা এ বন। প্রায় ৩৭টি বাংলাদেশের সামান এ বন ছড়িয়ে আছে ব্রাজিলসহ ৯টি দেশে। “আধুনিক ঔষুধের” প্রায় ২৫ ভাগ আসছে এ বন থেকে। কিন্তু মানুষ এ বনের অবদান মনে রাখেনি। কাঠ বা ঔষধি গাছ ডাকাতি, তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলন, সোনা-তামার খনির নামে প্রতিদিন ঝাঁঝরা হচ্ছে আমাজন। আমাজন বন বিষয়ক এক অধিবেশনে ব্রাজিলের কারিপুনা আদিবাসী নেতা লুয়েনে কারিপুনা বলেন, “৬০ বছর ধরে খনিজ উত্তোলনের নামে আমাজন বন এবং আদিবাসীদের জীবন ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। কোন বন্যপ্রাণী, গাছপালা, মানুষ কেউ থাকতে পারছে না। এত জীবাশ্ম জ¦ালানি আর খনিজ না তুললে কি আমাদের চলবে না।”
আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় ১৯৫টি দেশের আলোচকরা আগের চুক্তিগুলো বিস্তারিত করার কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে চরম আবহাওয়া ও অন্যান্য জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন পরিমাপ ও সহায়তার উপায় এগিয়ে নেয়া। অনেকে ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্বাগতিক ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ চাইছে, কপÑ২৮ এর প্রতিশ্রুতি বহাল রেখে জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার আহ্বানকে জোরদার করতে। দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে আসছেন ট্রাম্প। বিশে^র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তি থেকেও সরিয়ে নিয়েছেন। এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিনিধি দল ও তিনি পাঠাননি। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র টেইলর রজার্স বলেন, ‘অন্য দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে এমন অস্পষ্ট জলবায়ু লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না’। এবারের কপের সভাপতি আন্দ্রো কোরেয়া দো লাগো এবং প্রধান নির্বাহী আনা দে টনি উভয়েই পরিচ্ছন্ন জ¦ালানির প্রযুক্তিতে চীনের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। দে টনি বলেন, ‘চীন শুধু নিজেদের জ¦ালানি বিপ্লবই ঘটায় নি, চীনের বিশাল উৎপাদন ক্ষমতার কারণে আমরা এখন প্রতিযোগীতামূলক দামে কম কার্বন প্রযুক্তিও কিনতে পারছি।’
তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের পুরানো অবস্থান ধরে রেখেছে। তাদের ভাষ্য, অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার করতে দেয়া দরকার। এমন সময় এ সম্মেলন হল, বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ব্যর্থ হতে চলেছে বলে জাতিসংঘ আশঙ্কা প্রকাশ করছে। সম্মেলনের চূড়ান্ত বৈঠক হয় ২২.১১.২৫ইং। সেখানে দেশগুলোকে বিরোধিতার সুযোগ না দেয়ায় এ আয়োজনের সভাপতিত্ব নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন কলম্বিয়ার একজন প্রতিনিধি। দেশটির প্রতিনিধি ড্যানিয়েল দুরান গণজালেস বিবিসিকে বলেন, ‘বিশে^ যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, তার ৭৫ শতাংশের বেশি জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে আসে বলে আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক প্রমান রয়েছে। সে কারণে আমরা মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে এখন সে বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা শুরু করার সময় এসেছে।’ সম্মেলনের চূড়ান্ত পর্বে ‘সেচ্ছাসেবার’ ভিত্তিতে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমাতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। চূড়ান্ত বৈঠকে সৌদি আরবের একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘নিজস্ব বাস্তবতা ও অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক দেশেরই নিজেদের মত পথ তৈরির সুযোগ রাখা উচিত’। অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো অতীতে যেমন জীবাশ্মজ¦ালানির মজুদ ব্যবহার করেছে সে সুযোগ সৌদি আরবের থাকা উচিত বলে দেশটি সম্মেলনে তুলে ধরে। বিশৃঙ্খলা আর তিক্ততার পর ব্রাজিলের বেলেমে এমন এক চুক্তির মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপÑ৩০) পর্দা নামাল, যেখানে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য জ¦ালানী ও গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত কমানোর প্রতিশ্রুতি চাওয়া যুক্তরাজ্য, ইইউসহ ৮০টির বেশি দেশকে হতাশায় ফেলে শেষ হলো এ সম্মেলন।
কপÑ৩০ এর লক্ষ্য ছিল বৈশি^ক উষ্ণতারোধে চিরহরিৎ বনাঞ্চলকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা। তবে প্রায় সবদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে টান টান আলোচনা শেষে চিরহরিৎ বনের ভেতরে বসে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হল, তা অভূতপূর্ব হলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক আদিবাসী প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, সম্মেলন থেকে এসেছে বন রক্ষায় কয়েকশ ডলারের নতুন তহবিলের ঘোষণা। কিন্তু আগের সম্মেলনগুলোর মত এবারও বনাঞ্চল নির্ভর করতে হয়েছে এক স্বেচ্ছা পথরেখার উপর। এতে আমাজন ও গোটা বিশে^র প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
বেলেমে এবার বন রক্ষায় অন্য যেকোন জলবায়ু সম্মেলনের তুলনায় বেশি তহবিলের ঘোষণা এসেছে। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি দেখা গেছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় তিন হাজার আদিবাসী নেতা এবারের সম্মেলনে অংশ নেন, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আমাজনের ব্রাজিল অংশের আদিবাসী সংগঠনগুলোর জোট সিওআইএবি’র প্রধান তোয়া মানশিনেরি বলেন, ‘আদিবাসী ভূমি চিহ্নিতকরণকে জলবায়ু নীতিহিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দাবি আলোচ্যসূচিতে না ওঠাটা হতাশার। কিন্তু আমাজনের আদিবাসী আন্দোলন হিসেবে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরছি।’
মহাসাগর ও খাদ্যব্যবস্থাকে জলবায়ু আলোচনার মূলধারায় আনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। ব্রাজিল ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে নতুন ‘ওশান টাস্কফোর্স’ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য হলো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, সমুদ্রভিত্তিক সমাধান ও নীল অর্থনীতিকে জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে আরো সুসংহতভাবে যুক্ত করা। একই সঙ্গে কৃষি খাতের নির্গমন হ্রাস ও পুষ্টি দক্ষতা বাড়াতে ‘বেলেম ডিক্লারেশন অন ফার্টিলাইজার্স’ গৃহীত হয়েছে। এর ফলে বৈশি^ক সার উৎপাদন ও ব্যবহারে নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কপÑ৩০ শুধু শক্তি খাত নয় বরং সমুদ্র, কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থাকেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কৌশলগত অংশ হিসেবে বিবেচনায় এনেছে। সংঘটিত এ চুক্তি ও অন্যান্য বিষয়গুলো বিবেচনা করে বলা যায় যে কপÑ৩০ আশা হতাশার সংমিশ্রণ। তৃতীয় বিশে^র দেশগুলো আর আমাদের বাংলাদেশ এ বাস্তবতা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে সমুখ পানে। 
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
সরকারি মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে সংশয়
চুরির ঘটনা রূপ নিলো বিএনপি এলডিপির রাজনৈতিক সংঘর্ষে পরিস্থিতি
কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ শিক্ষক পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন
ভাষা সৈনিক অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হাসান ইমাম মজুমদার বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান
দেবিদ্বারে গ্যাস সংকটের প্রতিবাদে গ্রাহকদের অফিস ঘেরাও
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
উচ্চ আদালতে রীট করার ঘোষণা আসিফ আকবরের
চুরির ঘটনা রূপ নিলো বিএনপি এলডিপির রাজনৈতিক সংঘর্ষে পরিস্থিতি
নির্বাচন নিয়ে জিলা স্কুলে প্রাক্তনদের মিলন মেলা
সরকারি মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে সংশয়
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শেখ হাসিনার শেষ নির্বাচনের মতোই অশুভ পরিণতি ডেকে আনতে পারে- আবদুল্লাহ আল মামুন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২