
চিকিৎসক
হিসেবে দীর্ঘ বছর ধরে রোগীদের কাছ থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাতে এটা
স্পষ্ট যে, কিছু শারীরিক অসুবিধা ও বদভ্যাসকে গুরুত্ব না দেওয়া থেকেই
অধিকাংশ স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষত শীতকালীন রোগগুলো মারাত্মক আকার ধারণ
করে। শীতকাল কেবল উৎসবের নয়, এটি রোগেরও মৌসুম—যদি আমরা সামান্য কিছু বিষয়ে
অসচেতন থাকি।
শারীরিক অসুবিধাগুলো গুরুত্ব না দেওয়া:
রোগীরা প্রায়শই কিছু প্রাথমিক লক্ষণ বা পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেন, যা পরবর্তীতে বড় রোগের জন্ম দেয়।
ক্রমাগত
ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা): গরমে সবাই পানি পান করলেও, শীতে ঠান্ডা
আবহাওয়ার কারণে পানির তৃষ্ণা কমে যায়। কিন্তু শুষ্ক আবহাওয়ায় শরীর ভেতর
থেকে দ্রুত ডিহাইড্রেটেড হয়। এর ফলে শ্লেষ্মা ঘন হয়ে যায়, যা শ্বাসতন্ত্রে
জীবাণুর বাসা বাঁধাকে সহজ করে তোলে।
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি ও ঘুম না
হওয়া: অনেকেই কাজ বা দুশ্চিন্তার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের গুরুত্ব দেন না। কম
ঘুম বা অতিরিক্ত ক্লান্তি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (ওসসঁহব ঝুংঃবস)
দুর্বল করে দেয়, ফলে সাধারণ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার
শক্তি কমে যায়।
বারবার হাত না ধোয়া বা পরিচ্ছন্নতার অভাব: ঠান্ডা লাগার
ভয়ে বা আলস্যে অনেকে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখেন না। ভাইরাস ও
ব্যাকটেরিয়া খুব দ্রুত পরিবেশ থেকে হাতে এবং সেখান থেকে চোখে-মুখে বা
শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে।
পুরনো অ্যালার্জি বা অ্যাজমাকে উপেক্ষা করা:
যাদের আগে থেকেই অ্যালার্জি বা অ্যাজমার প্রবণতা আছে, তারা শীতকালে প্রথম
লক্ষণগুলো (হাঁচি, হালকা কাশি) উপেক্ষা করেন। শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস এসব
উপসর্গকে দ্রুত গুরুতর করে তোলে।
খাদ্যগ্রহণে অসাবধানতা: শীতকালে
রাস্তার খাবার বা ঠান্ডা পানীয় গ্রহণে অসতর্কতা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল
ইনফেকশন বা গলা ব্যথার কারণ হয়।
প্রাথমিক অসুবিধাগুলো উপেক্ষা করার ফলে শীতকালে কিছু সাধারণ রোগ দেখা যায়।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ: সাধারণ সর্দি-কাশি (ঈড়সসড়হ ঈড়ষফ), ইনফ্লুয়েঞ্জা (ঋষঁ), নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস এবং অ্যাজমার তীব্রতা বৃদ্ধি হয়।
ত্বকের সমস্যা: ঠোঁট ফাটা, ত্বক শুষ্ক হয়ে একজিমা (ঊপুবসধ), ছত্রাক সংক্রমণ বা ফাংগাল ইনফেকশন দেখা যায়।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা: রোটাভাইরাস বা নোরোভাইরাসের সংক্রমণ (পেট খারাপ, বমি) ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাড়তে পারে।
এছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বৃদ্ধি এবং সাইনাসের সমস্যাও হতে পারে।
এ
সময়ে শ্বাসকষ্টর রোগী অনেক বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্ট (উুংঢ়হবধ) মূলত হয় ফুসফুসে
বাতাস প্রবেশের পথ সঙ্কুচিত হলে বা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে।
অন্যতম কারণগুলো হলো:
শ্বাসপথের
প্রদাহ: শীতকালে ঠান্ডা বা শুষ্ক বাতাস শ্বাসনালীতে প্রদাহ (ওহভষধসসধঃরড়হ)
সৃষ্টি করে। এর ফলে ব্রঙ্কিয়াল টিউবগুলো (ইৎড়হপযরধষ ঞঁনবং) সরু হয়ে যায়।
শ্লেষ্মার আধিক্য: সংক্রমণের কারণে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে অতিরিক্ত ঘন কফ বা শ্লেষ্মা তৈরি হয়, যা বাতাস চলাচলে বাধা দেয়।
স্প্যাজম:
অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে ঠান্ডা বা অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে শ্বাসনালীর
পেশিতে আকস্মিক সংকোচন বা স্প্যাজম হয়, যা শ্বাসপথকে প্রায় বন্ধ করে দেয়।
শ্বাসকষ্ট মূলত বেশি হয় যাদের:
বৃদ্ধ এবং শিশু: এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে।
অ্যাজমা ও ঈঙচউ (ঈযৎড়হরপ ঙনংঃৎঁপঃরাব চঁষসড়হধৎু উরংবধংব) রোগী: ঠান্ডা এদের উপসর্গকে দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
ধূমপায়ী: এদের ফুসফুস আগে থেকেই দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত থাকে।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি: এই রোগগুলো শরীরের সামগ্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, ফলে সংক্রমণ তীব্র হয়।
প্রতিটি রোগীকে এই রোগগুলোর প্রতিরোধের কৌশলগুলো মেনে চলার পরামর্শ দেই, যা রোগের তীব্রতা কমায় এবং জীবন বাঁচায়।
পানি পানের গুরুত্ব : ঠান্ডা লাগলেও দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে গরমজল বা উষ্ণ তরল (যেমন আদা চা, স্যুপ) পান করুন।
স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত এবং ভালোভাবে হাত ধোয়া (অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে) এবং মাস্ক ব্যবহার করা (ভিড়ের জায়গায়) অভ্যাস করুন।
সঠিক পোশাক: বাইরে বের হওয়ার সময় কান, মাথা ও বুক উষ্ণ পোশাকে ঢেকে রাখুন। সরাসরি ঠান্ডা হাওয়া লাগানো থেকে বিরত থাকুন।
টিকা গ্রহণ: ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা (ঋষঁ ঝযড়ঃ) নিন। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য এটি অপরিহার্য।
অ্যালার্জেন নিয়ন্ত্রণ: বাড়ির ভেতর ধুলো, মাইট এবং অ্যালার্জেনমুক্ত রাখুন। নিয়মিত ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখুন।
সঠিক
চিকিৎসা: সামান্য হাঁচি-কাশি বা গলা ব্যথা হলে নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক
না খেয়ে, ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ভাইরাল সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক
ব্যবহার করা যাবে না।
জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন।
তবে
অসুবিধাগুলো উপেক্ষা করা চলবে না। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং
ছোট অসুস্থতাতেও সতর্ক হয়ে আমরা শীতকালীন ও অন্যান্য গুরুতর রোগ থেকে
নিজেদের এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।
লেখক: এমবিবিএস, এমআরসিপি
(ইউকে), এমসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (বক্ষব্যাধি), মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি
বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারভেনশনাল পালমনোলজিস্ট, কনসালট্যান্ট-রেসপিরেটরি মেডিসিন,
আজগর আলী হাসপাতাল।
