
বাংলাদেশের
রাজনীতি এখন এক বিশেষ মুহূর্ত অতিক্রম করছে। রাজনীতির এ সময়টি এমন এক
সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়,
রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো, গণতন্ত্রের রূপ নির্ধারণ এবং জনগণের ক্ষমতার
নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। গত কয়েক সপ্তাহে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে
আয়োজনের সম্ভাবনা উত্থাপিত হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোড়ন সৃষ্টি
হয়েছে, তা স্বাভাবিক উত্তেজনার অনেক বাইরে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের
সীমা অতিক্রম করে এখন হয়ে উঠেছে এক বৃহদাকার রাজনৈতিক বিতর্ক। আর এ বিতর্কে
রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং আন্তর্জাতিক
পর্যবেক্ষকরাও গভীর নজর রাখছে।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিস্থিতি
বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনও এক অভূতপূর্ব চাপের মুখে
রয়েছে। তারা এটিকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে
বর্ণনা করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট, গণভোটের ব্যালট, আলাদা গণনা,
পর্যবেক্ষণ, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ- সব মিলিয়ে এমন দ্বৈত আয়োজন
বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রথম। কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন,
প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, কর্মী প্রশিক্ষণ, ব্যালট পেপার মুদ্রণ, নিরাপত্তা
সমন্বয়- সবকিছুই এখন এক প্রকার যুদ্ধ।
সরকার ও নীতিনির্ধারকরা বলছেন,
এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামো গঠনের অন্যতম রোডম্যাপ। বিএনপি বলছে,
গণভোটকে অজুহাত করে নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় সংকুচিত করা হচ্ছে, যাতে
তারা সংগঠিত কৌশল নিতে না পারে। অন্যদিকে যারা গণভোটের পক্ষে, তারা বলছে,
নতুন রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারটি এতদিন ধরে ঝুলে ছিল। দেশের অবস্থা ও
আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিবেচনায় এখনই জনগণের সামনে প্রশ্নটি উপস্থাপন করার
সময়। এ দুই বিপরীত অবস্থান মাঠে এক ধরনের দ্বৈত উত্তাপ তৈরি করেছে। আমাদের
মনে রাখতে হবে, দেশের আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্বাচন পরিচালনা
কাঠামো- সবকিছুই সীমিত সম্পদে পরিচালিত হয়। একটি বিশাল জাতীয় নির্বাচনই
যেখানে বিশৃঙ্খলা বা জটিলতার আশঙ্কা তৈরি করে, সেখানে একই দিনে দ্বৈত ভোট
আয়োজন করলে ভুল হওয়ার সুযোগও দ্বিগুণ হবে। সেই ভুল যদি ফলাফল, ব্যালট গণনা
বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঘটে, তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেবে,
যার প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। যদি নির্বাচন ও গণভোট আলাদা দিনে
করা হয়, তাহলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায়
না। বাংলাদেশে নির্বাচনি আবহ যখনই সৃষ্টি হয়, তখনই অনিশ্চয়তা, গুজব, দলীয়
ইস্যু এবং সহিংসতা বেড়ে যায়। সে প্রেক্ষাপটে আলাদা দিনে ভোট দুটি আয়োজন
করলে দেশের ওপর চাপও দ্বিগুণ হবে।
গত এক দশকে নানান রাজনৈতিক অস্থিরতা,
আন্দোলন-সংঘর্ষ, আদালতের নানা সিদ্ধান্ত, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক- সব মিলিয়ে
তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক অবসাদও জমেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক
রায় যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেওয়া হলেও তা এ
নির্বাচনে প্রযোজ্য নয়। এমন একটি সিদ্ধান্তও নাগরিকদের মনে নতুন বিভ্রান্তি
তৈরি করেছে। অনেকে বলছেন, আদালতের এ রায় ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক
কাঠামো গঠনের পথ তৈরি করবে। আবার কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল
করবে। বিএনপি দাবি করছে- গণভোটের ফলে নির্বাচনের আসল ইস্যুগুলো আড়ালে পড়ে
যাবে এবং সরকার প্রক্রিয়াটি নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করবে। তাদের
বক্তব্য- ‘এক দিনে নির্বাচন ও গণভোট মানে দুটি বিশাল রাজনৈতিক চাপকে
একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া।’ এতে ভোটারের মনোযোগ বিভক্ত হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ
মন্তব্য করছেন যে, যারা গণভোটকে বিলম্বের কৌশল বলছেন, তারা নিজেরাই
রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে ব্যর্থ। তারা মনে করেন, গণভোটের প্রশ্ন জনগণের ওপর
আস্থা রাখার একটি সুযোগ।
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচলিত মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়া, ইউটিউব
চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাজনৈতিক বয়ান তৈরির মূল ক্ষেত্র।
কিন্তু এখানেও এক ধরনের ‘বিভক্ত গণমাধ্যম বাস্তবতা’ দেখা যাচ্ছে। কেউ
শক্তভাবে নির্বাচন-গণভোট একই দিনে করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, আবার কেউ
এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে আখ্যা দিচ্ছে। এই ভিন্নমুখী কাঠামো জনগণের
রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে
উপেক্ষা করা যায় না। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি
উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক নজরদারির অন্যতম বিষয়।
বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে
আলোচনা হচ্ছে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ প্রসঙ্গে। একই
দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ধরনও বদলে যাবে। অনেক
প্রতিষ্ঠান হয়তো দুটি ইভেন্টেই পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবে না। ফলে
পর্যবেক্ষণের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট
যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে ঢুকেছে, যেখানে নির্বাচন ও গণভোট
একই দিনে আয়োজন করা হবে কি না- এ প্রশ্নটাই রাজনৈতিক রূপরেখা নির্ধারণ
করবে। এ আয়োজন সফল হলে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের
ঐতিহাসিক সূচনা হতে পারে। কিন্তু যদি আয়োজন ব্যর্থ হয়, গণনা ভুল হয়,
প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বা রাজনৈতিক দলগুলো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে,
তাহলে তা দেশে নতুন অস্থিতিশীলতা, নতুন অসন্তোষ এবং নতুন ধরনের সংকটের জন্ম
দিতে পারে। যা নিয়ন্ত্রণ করা নতুন সরকার বা অন্তর্র্বতী ব্যবস্থার জন্য
কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
