
১. আমি যখন প্রথম প্রবাসী হবার সিদ্ধান্ত নেই-অর্থাৎ ২০০০ এর দিকে—তখন আমাদের পরিবার মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। আব্বার অকাল প্রয়াণ এবং যাকে বলে যুদ্ধরত সময় তা আমরা ভালোই কাটিয়ে উঠেছি। ততদিনে আমার বড় বোন অলকার একটা ভালো বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ছোট ভাই শিমুল চাকুরী করছে, মেঝ বোন কাকলি এমবিবিএস শেষ করেছে আর ছোটবোন শিউলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ও হ্যাঁ, সেই সময় কুমিল্লাতে আমাদের বাসার সামনের জায়গায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে আম্মার জন্য একটা স্থায়ী উপার্জিনেরও ব্যবস্থা করে এসেছিলাম। দিন শেষে আম্মার কাছে একটা নিদ্দিষ্ট টাকা পৌঁছে যেত। মানে আমার প্রথম প্রবাস জীবনে আমার জীবনটা অনেকটাই অনিশ্চিত যাত্রা হলেও পরিবারের জন্য মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থাই ছিল বলা যাবে।আরো বলা যায়-আমি পরিবারের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ কিছু ব্যবস্থা করেই দেশ ছেড়েছিলাম।
২. আমার প্রথম প্রবাস জীবনকালে অর্থাৎ ২০০০-২০১০ পর্যন্ত দেশে অর্থাৎ কুমিল্লায় কাকলি পেশাগতভাবে বেশ বিকশিত হয়। প্রথম সংসার জীবনের ব্যর্থতার ভার পেছনে ফেলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল কাকলি। আমরাও উৎসাহিত করেছি সকল ব্যর্থতা ছুঁড়ে ফেলে দিতে। সিঙ্গেল মাদার তখন কাকলি। কাকলির মেয়ে তূর্ণাকে আম্মা দেখভাল করছেন। তখন থেকেই পেশাগতভাবে খুব সক্রিয় আর পরিশ্রমী হয়ে উঠেছিল সে। সক্রিয়তা আর বৈষয়িক সফলতায় আমাদের ভাই বোনদের থেকে অনেকটাই আলাদা ও অগ্রণী ছিল কাকলি। কাজ করতো দিনরাত। একইসাথে অনেকগুলো চাকুরী বা কর্মকাণ্ড করতে পারতো। গাইনি ডাক্তার হিসেবে তাঁর হাতের যশ-খ্যাতি হয়ে গিয়েছিল। কোন আলস্য ছিলনা। আম্মা আমাদের বলতেন যে কাকলি আগে থেকেই ডিটারমাইন্ড ছিল তাঁর পেশার ব্যাপারে। ডাক্তার হবে। হবেই। হয়েছিল সেই ইচ্ছা অনুযায়ী। মানুষতো আসলে তার ইচ্ছাশক্তিরই প্রতিভূ। কাকলি অনুসরণ করতে পেরেছিল তাঁর সেই ইচ্ছা। পেশাগত জীবনে যাবতীয় সফলতা স্পর্শ করবার কারণ হয়তো ছিল তাঁর সেই ইচ্ছা-পরিশ্রম-স্বপ্নেরই ধারাবাহিকতা।
৩. ১৯৭৬-এ আব্বার প্রয়ানের পর আমাদের সংসারের হাল ধরা যাকে বলে তা ধরেছিলেন আমাদের প্রয়াত মা। তারপর যৌথভাবে আমি আর আম্মা। কিন্তু তারপর বিশেষ করে ২০০০ এর পর থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্ব থেকে সেই হাল ধরার কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় সেটা কাকলি। আম্মা ছিলেন সবসময় সবার সাথেই। আমার প্রবাসকালীন কুমিল্লায় আমাদের সম্মিলিত সংসারের হাল ধরে থাকে মূলত কাকলিই। মানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে। আমি বলতাম সংসার দৌড়ের রীলে রেইসে রীলে কাঠিটা আমি কাকলির হাতেই দিয়ে এসেছি। কাকলিও গর্ব করে বলতো ভাইয়ার কাঠিটা আমিই সফল ও শক্ত করে ধরতে পেরেছি একই গতি বজায় রেখে। সেই সময়ে আমার ছোটবোন শিউলিও প্রবাসী হয়ে যায়। বড় বোন অলকা সবসময় ঢাকাতেই তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেছে। আম্মা শিমুল আর কাকলি মিলে কুমিল্লায় আমাদের পারবারিক স্থায়ী একটা ভিত্তি-কাঠামো গড়ে তোলে যাতে কাকলিই মূলত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই আমি আমার প্রবাস ফেরত পর্বে পারিবারিক প্রকল্প গড়ে তুলি কাকলি ছিল যার উন্নয়ন অংশীদার। সেই বিনির্মাণে আম্মাসহ পরিবারের সবার সহযোগিতা ছিল অভূতপূর্ব। দাদার রেখে যাওয়া জায়গায় নির্মাণ হয় আমাদের সবার স্থায়ী ঠিকানা। আমাদের উপার্জন ও বাসস্থানের স্বপ্নভবন-অজন্তা। আমাদের তিন পুরুষের ভিটা রূপ পায় স্থায়ী এক অবকাঠামোতে কাকলি ছিল যার অন্যতম নির্ধারক অংশীদার।
৪. প্রতিটি সংসারেই এইরকম কিছু নীলকণ্ঠী থাকে। স্বপ্ন দেখে। যারা পরিকল্পনা করে। যারা প্রয়োগ-নির্মাণ করতে পারে। যারা সবকিছু হজম করে। যারা বৈরিতা জয় করে। যারা ধারণ করতে পারে অনেককিছু। যারা ত্যাগও করে।। যারা অন্যকে দিতে পারে। যারা ভাগিদার হয়। আমাদের সংসারে কাকলিও ছিল তার একজন। সবসময় হাসিমুখ। পারিবারিক সদস্যদের সব আবদার ছিল কাকলিকে ঘিরে। সবার সব অসুস্থতার দায় দায়িত্বযেন তাঁর। কাকলির মেয়ে তূর্ণা আর শিমুলের মেয়ে অরণির অভিভাবকও কাকলি। আমাদের ঘরোয়া আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া কাকলির বাসায়। সবার জন্মদিন পালন কাকলির বাসাতেই। কুমিল্লায় কাকলির বাসাটাই ছিল আমাদের বাসা। দুহাতে উপার্জন করছে মানুষটা আর বিলিয়েও দিচ্ছে নিজেকে নানাভাবে। আপাত কঠিন মনোভাবের আড়ালে একটা নরম মন ছিল কাকলির। খুব সহেজেই কাঁদতে পারতো। হাসতে পারতো। খুব সহজেই প্রভাবিত করা যেত কাকলিকে। চাইলেই যে কেউ মুহূর্তে ঠকিয়ে ফেলতে পারতো কাকলিকে। অন্যের একটু প্রশংসায় নিজের সবটা বিলিয়ে দিতো কাকলি। খুব অল্প চেষ্টায় জয় করা যেত কাকলির মন। মানুষের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল আমার বোনটি। আমাদের বৃহত্তর পরিবার এবং দূর দূরান্তের আত্মীয়স্বজন কাকলির চিকিৎসা সেবায় ধন্য হয়েছে। আত্বীয়স্বজনদের আশ্রয় হয়েছে কাকলির বাসা। কাকলি হয়ে উঠেছিল “জনমানুষের চিকিৎসক” হিসেবে। তাঁর প্রস্থানের পর সামাজিক মাধ্যম এবং স্থানীয় সমাজের যে প্রতিক্রিয়া তা বিস্ময়কর। কাকলি ঠাঁই পেয়েছিল মানুষের মনে।
৫. কাকলির তবু একটা শূন্য অতৃপ্ত মন ছিল। তা ভুলতেই বা প্রশমিত করতেই হয়তো খুব ঘুরে বেড়াতো নিজেই। নিজেই নিজেকে উদযাপন করেছে। নিজেই সবকিছু থেকে পালিয়েছে মাঝে মাঝে। নিজের অনেকগুলো ছবি তুলে ভুলে থেকেছে নিজেরই একরাশ শূন্যতা। যখন তখন এখানে সেখানে চলে গিয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে হারিয়েছে নিজেকে। একটা অপূর্ব সহজিয়া ভ্রমণসত্তা লালন করেছে নিজের মধ্যে। এক অনিঃশেষ ভ্রমণপথে এঁকে গেছে নিজের অস্তিত্বরেখা। ভালোবেসেছে নিজেকে খুব। আবার অস্বীকারও করেছে নিজের প্রয়োজন। আরো একটু যত্ন নিতে পারতো নিজের। প্রস্থানের ঠিক আগে আগে কাউকে না জানিয়েই ভ্রমণ করতে করতে চলে গিয়েছিল গ্রামে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে। কিভাবে মেয়েটা বুঝতে পারলো আর কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক এখানেই যে তাঁর জীবন ভ্রমণের চিরশয্যা রচিত হবে। কাকলি কি তবে জানতে পেরেছিল তাঁর অন্তিম জীবনের কথা?
৬.গত কয়েকবছর আগে কুমিল্লা ঝাউতলা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো কাকলির নিজস্ব ক্লিনিক আমাদের পারিবারিক নিজস্ব ভবনেই। উপরে আমাদের সবার আবাসিক ফ্ল্যাট। বলা যায়, এটাই কাকলির জীবনের সুখীতম অধ্যায়। তাঁর জীবনসঙ্গীর ভূমিকাও এখানে কম নয়। কাকলি গাইনি ডাক্তার হিসেবে চাইতো সবার নরমাল ডেলিভারি হোক। কত কত দুঃস্থ রোগীদের সেবা যে সে করেছে। নবজাতক শিশুদের কোলে নিয়ে ছবি তুলতে খুব পছন্দ করতো। প্রায় সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় জমেছে বন্ধুদের আড্ডা। খুব পছন্দ করতো হোস্ট হতে। অফুরান আনন্দের উৎস ছিল নিজেই যা বিলিয়ে দিয়েছে অন্যদের। পৃষ্ঠপোষকতা করেছে অনেক অনুষ্ঠান আর উদ্যোগের। ওঁর কাছে এসে কেউ কখনো খালি হাতে ফেরেনি। “আপুমনি” বললেই বিগলিত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষকে। সবার প্রতি অতি মনোযোগী ব্যক্তিটি শুধু নিজের প্রতি একটু মনোযোগী হতে পারলোনা। শুধু নিজের চিকিৎসা বাকি রয়ে গেলো। আহারে আমাদের বোনটা।
৭. কাকলির এই প্রয়াণ অকাল। আমরা সবাই অপ্রস্তুত। আমরা কাকলিকে বিদায় দেইনি কোনভাবেই। তাঁর মেয়ে তূর্ণা এখনো বিশ্বাস করে কাকলিকে সে জাগিয়ে তুলবে।মেয়ে থেকে মা আনুষ্ঠানিক বিদায়তো নেয়নি। কাকলি তূর্ণার কাছে বেঁচে আছে। কাকলি আমাদের মাঝেও তাই বেঁচে থাকবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিককে আরো জনবান্ধব কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কাকলির নামে ফাউন্ডেশন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুস্থ রোগীদের সেবা দেয়া হবে। কাকলির কর্ম আর বৈশিষ্ট আর হাসিমাখা অবয়বের ধারাবাহিকতা থাকবে নানা কর্মকাণ্ডে।
অজন্তা ভবনের করিডোরে হাসিমাখা এগিয়ে যাওয়ায়, রেইনবো ক্লিনিকের রোগীদের ভিড়ে, এপ্রোন পরা কর্মচারী পরিবেষ্টিত হয়ে, বন্ধুদের হট্টগোলে, পারিবারিক উষ্ণ সমাবেশে, ডাক্তারদের আন্তর্জাতিক সেমিনারে, তাঁর বাসার মার্বেল পাথরের মসৃণতায়, সেগুনকাঠের অপূর্ব দোলনায়, গোমতী নদীর পাড়ে, সবুজ নির্জন কোন প্রান্তরে আর আমাদের আব্বা আম্মার সাথে একই জমিনে কাকলি মিশে থাকবে। কাকলির দিকে তাঁর আদরের মেয়ে তূর্ণা যে এগিয়ে আসছে সেই চিরস্থায়ী স্বর্গীয় দৃশ্যে কাকলি বেঁচে আছে। কাকলি পাখির কল কাকলি হয়ে আছে। আমাদের প্রিয় বোনটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে লেপ্টে আছে। কাকলি আছে ‘ভাইয়া’ বলা আদরে, বোনদের সাথে খুঁনসুটিতে। যাঁকে বিদায়ই দেইনি তাঁকে কিভাবে আমরা হারাতে পারবো!?
এত অল্প বয়সে বিদায় নিতে হয়নারে বোনটি। এভাবে ফাঁকি দিতে হয়না। দেখবি না তোকে কিভাবে আমরা জড়িয়ে আছি? দেখবি না মানুষ যে কতভাবে তোকে ভালোবাসে
