
১৮৭৫
সালের ১৭ নভেম্বর কর্ণেল হেনরি অলকট ও হেলেনা পেট্রোভনা ব্লাভাৎস্কি ও
অন্যান্যরা মিলে আমেরিকার নিউইয়র্কে থিওসোফিকেল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন।যার সভাপতি ছিলেন হেনরি অলকট।মাদাম ব্লাভাৎস্কি ছিলেন
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। তিনি ছিলেন সোসাইটির দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক
পরিচালক। থিওসোফিক্যাল সোসাইটির আদর্শ উদ্দেশ্য ছিল সৃষ্টির রহস্য,মানব
আত্মার অমরত্ব, মিস্টিসিজম, মানবজাতির উন্নয়ন ও কর্মফল সংক্রান্ত গবেষণা
করা এবং এসবের পাশাপাশি প্রেততত্ত্বের চর্চা করা। প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মৃত
ব্যক্তির আত্মা নামিয়ে এনে তার কাছ থেকে কোন বিষয় সম্পর্কে উপদেশ, পরামর্শ
এবং তথ্য জানতে চাওয়াও ছিল এর কর্মসূচির অংশ।
মৃত ব্যক্তির আত্মা যার
উপর ভর করতো তার মাধ্যমে আত্মা সব কিছু লিখে দিতো।বলা হয়ে থাকে মাদাম
ব্লাভাৎস্কি ছিলেন প্রেতাত্মাদের খুব প্রিয় ও বিশ্বস্ত। আত্মাদের কেউ কেউ
আবার মাদাম ব্লাভাৎস্কির সঙ্গে কথাও বলতো।সোসাইটির সদস্যরা আধ্যাত্মিকতায়
বিশ্বাস করতেন অর্থাৎ আত্মা,পরকাল, পূনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ‘আত্মা
অমর’-এই বিশ্বাসের সূত্র ধরে মানুষের মাঝে এসেছে পরমাত্মার অস্তিত্বে
বিশ্বাস।
কেননা পরমাত্মা নামের কোন সত্ত্বার অস্তিত্ব না থাকলে
মানবাত্মার ইহজাগতিক জীবনের ভালো-মন্দ কাজের বিচার করবে কে?
আবার-‘মৃত্যুতেই সব কিছুর শেষ নয়’-আত্মার অমরত্ব সম্পর্কিত এই ভাবনা থেকে
সৃষ্টি হয়েছে পরলোক বা পরকালের কাহিনী এবং স্বর্গ-নরকের কল্পকাহিনী।
এভাবেই
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত নির্ধারিত হয় ‘আত্মার
অমরত্বে বিশ্বাস’, ‘পরমাত্মায় বিশ্বাস’ ও ‘পরলোকে বিশ্বাস’।
ধর্মের এই
তিন আবশ্যিক শর্ত নিয়ে যে মতবাদ, তা-ই হলো অধ্যাত্মবাদ। এটি প্রাতিষ্ঠানিক
ধর্মের ভিত্তিভূমি, যার উপর গড়ে উঠেছে নানা আচারসর্বস্ব ব্যাপার-স্যাপার ও
নানা যুক্তিহীন সংস্কার।
একান্তভাবে বিশ্বাস-নির্ভর যুক্তিহীন এই
অধ্যাত্মবাদ মৃত্যুর পর স্বর্গ সুখের প্রলোভন দেখিয়ে বঞ্চিত মানুষদেরকে
বঞ্চনা সহ্য করার শক্তি যেমন যোগালো, তেমনি তাদেরকে নিয়তি নির্ভরও করে
তুললো। একসময় পরমাত্মা/ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে জন্মনেয় ঈশ্বরকে তুষ্ট করার নানা
পদ্ধতি-প্রকরণ, তন্ত্র-মন্ত্র,ধর্মগ্রন্থ, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি। শাস্ত্র
বিশ্বাস ও ধর্ম বিশ্বাস ধর্মগুরুদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে অটল করলো এবং
ধর্মগুরুরা যে ঈশ্বরের পুত্র,পয়গম্বর, প্রতিনিধি, অবতার বা ঈশ্বরের সঙ্গে
সাধারণ মানুষের যোগসূত্র এমন বিশ্বাসকেও দৃঢ় করলো।এসব বিশ্বাসী মানুষেরা
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর/ পরমব্রহ্ম/আল্লাহ/জিহোবার প্রতিনিধি হিসেবে
ধর্মগুরুদের পরামর্শ নেওয়া অতি আবশ্যক মনে করলো। এভাবে ধর্মগুরুরা একটু
একটু করে মানুষের কাছে হয়ে উঠে ভবিষ্যতদ্রষ্টা ও সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক।এদের
প্রচণ্ড প্রভাবে ও সচেতন প্রচেষ্টায় সমাজের মানুষ প্রচণ্ড রকম ভাগ্যে
বিশ্বাসী হয়ে পড়লো।এরপর যতই দিন গড়ালো বিশ্বাসবাদের আধিপত্য বিস্তৃত হতে
থাকলো। একসময় বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে পরামনোবিজ্ঞান এসে হাজির হলো।
মন ও আত্মা হয়ে উঠলো এর গবেষণার খোরাক।
মনের
ইন্দ্রিয়াতীত রহস্যের সন্ধান, প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা,পরলোক রহস্যের
গবেষণা ও জন্মান্তরবাদের সূত্র সন্ধানের মধ্যেই পরামনোবিজ্ঞানের কাজ-কর্ম
সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলো। অর্থাৎ পরামনোবিজ্ঞানের কাজ-কর্মও আত্মাবিষয়ক
অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত হয়ে গেলো। সংক্ষেপে বলতে গেলে
অধ্যাত্মবাদ,ভাববাদ ও পরামনোবিজ্ঞান পুরোপুরিভাবে আত্মার অমরত্বের উপর
নির্ভরশীল।
কেননা আত্মা মরণশীল হলে বা আত্মা বলতে কিছু না থাকলে
অধ্যাত্মবাদ,ভাববাদ ও পরামনোবিজ্ঞানের অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আত্মা’ অমর না
হলে পরলোক, স্বর্গ-নরক, পরমাত্মা/ঈশ্বর/আল্লাহ ইত্যাদি ধারণা বাতিল হয়ে
যায়।প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো হয়ে পড়ে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয়।
মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে সৃষ্ট অধ্যাত্মবাদের অঙ্কুরিত বীজটি মানুষের অজ্ঞতা ও
অন্ধ বিশ্বাসের পুষ্টির জোরে আজ বিশাল মহীরুহের আকার নিয়েছে।নানা শ্রেণীর
মগজ ধোলাইয়ের জন্য নানা ভাবে, নানা সাজে,নানা মুখোশের অন্তরালে আজ তার
সর্বনাশা রূপও প্রকট হয়ে উঠেছে।ফলে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যুক্তিবাদের
দ্বন্দ্ব আজ অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে।বলা
বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব অসাম্যের সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টার বিরুদ্ধে
সাম্যের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা চেষ্টার দ্বন্দ্ব। জ্ঞাতসারে হোক কিংবা
অজ্ঞাতসারে হোক, ভোগবাদকে টিকিয়ে রাখতে মানুষ নির্বিকারে অধ্যাত্মবাদের
চর্চা করে চলছে। ভোগবাদ মানুষকে স্বার্থপর করে। স্বার্থপর মানুষ কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে লড়াই করতে জানেনা,সাম্যে বিশ্বাস করেনা, ‘যেন তেন-প্রকারেণ’ নিজের
আখের গোছানোকেই জীবনের লক্ষ্য করে নেয়।অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদীরা নিজেদের
দ্ঃুখ-কষ্ট-বঞ্চনাকে ভক্তি-রসের আবেগে বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদের স্পৃহাকে
ত্যাজ্য করে।এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ছান্দোগ্যতে
পুনর্জন্মের কাল্পনিক ছবি আঁকে এর রচয়িতার।তার হাত ধরে, মানুষের অজ্ঞতার
পিঠে সওয়ার হয়ে, উক্ত কল্পকাহিনীকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রথম কাজে
লাগায় ভারতের ক্ষত্রিয় ও পুরোহিত সম্প্রদায়। তারা পুনর্জন্মের গর্ভে
জন্মদেয় ‘কর্মফল’ তত্ত্ব।কর্মফল তত্ত্ব হতদরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের শোনাল-হে
বৈশ্য,হে রুদ্র,এই যে প্রতিটি বঞ্চনা,এর কারণ হিসেবে তুমি যদি কোন
ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ বা উচ্চকুলের মানুষকে দায়ী করো তবে তুমি ভুল করবে।এইসব
উচ্চকুলের মানুষেরা তো তোমার বঞ্চনার উপলক্ষ মাত্র। তোমার বঞ্চনার মূল
কারণ-পূর্বজন্মের কর্মফল।তাই ভারতে দরিদ্র,বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে জন্মান্তর
ও কর্মফলে বিশ্বাসী বঞ্চিত মানুষ তাদের প্রাপ্য আদায়ের জন্য কখনো বিদ্রোহ
করেনি, বিপ্লবে শামিল হয়নি।জন্মান্তর ও কর্মফলে বিশ্বাসের কারণে
অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টিকারী ও আরোপকারী ভারতীয় ক্ষত্রিয় ও পুরোহিত সম্প্রদায়
সমসাময়িক পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের শাসক ও শোষকদের তুলনায় ছিল অনেক বেশি
বুদ্ধিমান।তারই ফলস্বরূপ আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর বিশাল
সেনাবাহিনীপুষ্ট শক্তিশালী দেশের শাসকদের গদি আন্দোলনের ফলে উল্টে গেলেও
ভারতের অভুক্ত,অর্ধনগ্ন, অত্যাচারিত, বঞ্চিত মানুষগুলো থাকে নিজেদের
ব্যাপারে একেবারে উদাসীন,যেন সবই পূর্বনির্ধারিত।
অদৃশ্যের ও কর্মফলের
দোহাই পেড়ে পড়ে পড়ে মার খাওয়া যেন এদের নিয়তি।এতে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে
অধ্যাত্মবাদ,ভাববাদ,পরামনোবিদ্যা ইত্যাদি স্পষ্টতই ভোগবাদকে সুরক্ষিত করার
‘বাদ’ বা দর্শন।তাই বলতে দ্বিধা নেই থিওসোফিক্যাল সোসাইটি ভারতে তথা সারা
দুনিয়ায় ভোগবাদ ও পুঁজিবাদের প্রসার বৃদ্ধিতে প্রভাবকের(ঈধঃধষুংঃ) কাজ
করেছে।
মাদাম ব্লাভাৎস্কির(১৮৩১-১৮৯৯) জীবনী পর্যালোচনা করলে ও একথা
স্পষ্ট হয় যে,তিনি ছোটবেলা থেকেই অতি প্রাকৃতিক ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।
এছাড়া ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য,ভারত এবং তিব্বতের মতো অনেক দেশ ভ্রমণের ফলে
বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন ও মিস্টিক চর্চার প্রতি তাঁর অনুরাগ আরো প্রবল হয়ে
উঠেছিল। তিনি মনে করতেন হিমালয়ে কিছু উচ্চতর আধ্যাত্মিক সত্তা আছেন, যারা
মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে সাহায্য করেন।বিশ্বব্যাপী ধর্ম ও দর্শনের প্রতি
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে তিনি মানুষকে অধ্যাত্মবাদী করে তুলতে
থিওসোফিক্যাল সোসাইটির মাধ্যমে আজীবন কাজ করে গেছেন।সোসাইটির জন্মলগ্ন থেকে
আরো দুই ব্যক্তি(অলকট ও জাজ)একই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। এই ত্রয়ীর মধ্যে
ব্লাভাৎস্কি থিয়োসফির মূল দর্শন ও ধারণাগুলো (ঐক্যবাদ,কর্ম,
পুনর্জন্ম,আত্মার বিকাশ) সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার কাজে অধিক
তৎপর ছিলেন।যেখানে অলকট কেবল ভারত ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ শিক্ষা পুনর্জাগরণের
জন্য কাজ করেছেন।আর জাজের কাজ ছিল কেবল আমেরিকায় সোসাইটির বিস্তার
ঘটানো।এই ত্রয়ী মিলে কেবল আমেরিকাতেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সোসাইটির ছয়শত
শাখা। যেখানে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনশ' শাখা।একথা আজ বলতে দ্বিধা নেই
যে, মার্কিন পুঁজির স্বার্থে সেখানকার মানুষগুলোকে আন্দোলন বিমুখ করে রাখতে
ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল এই সোসাইটি। সেখানকার গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত বঞ্চিত
নিপীড়িত সাধারণ মানুষের মনে স্বান্তনার প্রলেপ দেওয়ার কাজটিও করেছে
আধ্যাত্মিকতার বাতাবরণে এই সোসাইটি। ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ যাতে প্রথাবিরোধী
হয়ে না উঠে, শোষণ বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে এর
জন্য তাদেরকে কর্মফল ও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী হবার দীক্ষা দেওয়ার কাজটি করতো
ব্লাভাৎস্কি ও অলকটের থিওসোফিক্যাল সোসাইটি।১৮৮৮ সালে প্রকাশিত
ব্লাভাৎস্কির বিখ্যাত গ্রন্থ‘ঝবপৎবঃউড়পঃৎরহব’প্রেততত্ত্ব বিষয়ক গুপ্ত
বিদ্যা শিখতে বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল।এতে বহু বিশিষ্টজন ব্লাভাৎস্কির
ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।অবশ্য এর আগেই ১৮৭৯ সালে ব্লাভাৎস্কি ও অলকটের আশীর্বাদে
ভারতের প্রথম শাখা কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘বেঙ্গল থিওসোফিক্যাল
সোসাইটি’নামে।যার সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র এবং সহ-সভাপতি ছিলেন রাজা
শ্যামশঙ্কর রায় এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৮৮২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীকে সভানেত্রী করে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘লেডিস থিওসোফিক্যাল সোসাইটি।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা ছিল বলতে গেলে সোসাইটির
মুখপত্র।সেই সুবাদে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেও ব্লাভাৎস্কি,অলকটের নিয়মিত
যাতায়াত ছিলো।এছাড়া ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শিশিরকুমার
ঘোষ যিনি একসময় নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিলেও একসময় ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ
করে পরবর্তীতে পরম বৈষ্ণব ও ঘোর থিওসোফিস্ট হয়ে উঠেছিলেন।অমৃত বাজার
পত্রিকাও সেই সময় থিওসোফিস্টদের প্রশংসা করে অনেক লিখা প্রকাশ করতো।পরম্পরা
বজায় রেখে কলকাতার বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’ আজও বৈষ্ণব ভাবধারার পাশাপাশি
থিওসোফিস্ট ভাবধারার প্রচার করে চলছে সমানতালে। ব্লাভাৎস্কির মৃত্যুর(১৮৯১)
পরও ভারতে সোসাইটির কাজ পুরোদমে চলছিলো আইরিশ রমণী অ্যানি বেশান্তের(অহহরব
ইবংধহঃ) নেতৃত্বে ,যিনি ভারতে এসেছিলেন ১৮৯৩ সালে। এবং আন্তর্জাতিক
থিওসোফিকেল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে।মাদাম
হেলেনা ব্লাভাৎস্কির ‘ঝবপৎবঃ উড়পঃৎরহব’ গ্রন্থটি পড়ে নারী অধিকার কর্মী,
আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আ্যানি বেশান্ত
থিওসোফিস্ট হয়ে উঠেছিলেন।একসময় তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত
হয়েছিলেন অ্যানি বেশান্তও ব্লাভাৎস্কির ন্যায় প্রেতাত্মাদের বা বিদেহী
আত্মাদের প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর আহ্বানে আলো- আঁধারী ঘরে
প্রেতাত্মারা প্ল্যানচেটের টেবিলে এসে হাজির হতেন বিদেহী ‘মহাত্মা’রা এবং
লিখে যেতেন তাদের নানা লিখিত নির্দেশ উপদেশ।বেশান্ত বলতেন- ‘ঈশ্বর/আল্লাহ
বা সর্বশক্তিমান যে নামেই ডাকা হোক না কেন এক অতিপ্রাকৃতিক শক্তি
মহাত্মাদের সাহায্যে পৃথিবী শাসন ও পরিচালনা করেন।ঈশ্বরের মুখ্য প্রতিনিধি
ব্রহ্মার মানসপুত্র সনৎকুমার,যিনি বাস করেন গোবি মরুভূমিতে। জগৎ সংসার
চালাচ্ছেন মনু।তাকে সাহায্য করেন
অগস্ত্য,কুথুমি,মোরিয়া,বুদ্ধ,খ্রিস্ট,জড়থুস্ত্র প্রমুখ মহাত্মারা।’বেশান্ত
তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতায়,প্রচারযন্ত্র ও বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগানোর সফলতায়
দেশ-বিদেশে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন।তিনি প্রেতচক্রের আসর বসাতেন।
আত্মাদের দিয়ে ঘণ্টা বাজাতেন,বাজনা বাজানো,ফুল নিয়ে আসা-এমনি অদ্ভুত সব
কাণ্ড দেখাতেন। সাংবাদিকদের কাছে আত্মাদের ঘটানো অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার গল্প
বলে চমক লাগিয়ে দিতেন।যেমন ১০জুন,১৮৯৪ ‘মাদুরা মেল’ পত্রিকায় এক
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন বিদেহী আত্মার সাহায্যে শূন্য থেকে কতইনা জিনিস
আনা যায়।টেবিল,বই, বা অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে সেগুলোর কাছে না গিয়ে
সেগুলোকে নিজের কাছে আনা যায় আত্মার সাহায্য নিয়ে। মাদাম ব্লাভাৎস্কিকে
দেখেছি তাস খেলার সময় তাসগুলোকে তার কাছে চলে আসতে।অ্যানি বেশান্ত আত্মার
অমরত্বের পাশাপাশি জন্মান্তর ও কর্মফলের পক্ষেও প্রচার চালিয়েছিলেন।নীচবংশে
জন্ম হওয়া ও গরীবির জন্য তিনি কর্মফলকে দায়ী করতেন।তিনি বলতেন পূর্বজন্মে
তিনি হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন, এই জন্মে পাশ্চাত্যে জন্মে সেখান থেকে বস্তুবাদ
বা জড়বাদের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন বস্তুবাদের অসারতা প্রমাণের
উদ্দেশ্যে।এখন তিনি জড়বাদ বা বস্তুবাদকে নস্যাৎ করে দেওয়ার শক্তি অর্জন করে
ফিরে এসেছেন আপন বাসভূমিতে।নিজের নাম রেখেছেন অ্যানি থেকে আন্নাবাঈ।
হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন হিন্দু ধর্ম
রাজভক্তি আনুগত্য বজায় রাখার অতি সহায়ক। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ও
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি অমানবিক ও ভয়াবহ মনে করতেন। ১ এপ্রিল ১৮৯৯
তারিখের ‘মাদ্রাজ মেল’পত্রিকায়-‘ঐরহফঁরংস ধহফ খড়ুধষঃু’ নামে প্রকাশিত
প্রবন্ধে লিখেছিলেন-
“গণতন্ত্র ভারতীয় মানসিকতার পক্ষে অনেক
বেমানান।কারণ এর ফলে অশিক্ষিত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় শিক্ষিত সংখ্যালঘুদের
গিলে ফেলবে।অথচ তাকেই ১৯২০ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করেছিল
কংগ্রেস সদস্যরা।”
কুমিল্লায় থিওসোফিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ১৮৮১
সালে। যার প্রথম সভাপতি ছিলেন ত্রিপুরার রাজা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ।
সোসাইটির ভবন নির্মিত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে,যা আজও টিকে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়
কুমিল্লা টাউন হল মাঠের পশ্চিম পাশে, তদানীন্তন কুমিল্লার মানুষের
চিন্তা-চেতনার স্মারক হিসেবে।১৪৪ বছর আগের মানুষের চিন্তা ও ভাবনার জগৎ
থেকে বর্তমানে আমাদের চৈতন্যের মুক্তি কতটা ঘটেছে এবং আমরা চিন্তা ও কর্মের
স্বাধীনতা কতটা উপভোগ করছি কুমিল্লায় থিওসোফিক্যাল সোসাইটির সার্ধশত
বার্ষিকী উদযাপন সে কথারই জানান দিয়ে গেছে।
