শুক্রবার ২৮ নভেম্বর ২০২৫
১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
রাজনীতি, নির্বাচন ও সৎ মানুষের খোঁজে...
শুভ কিবরিয়া
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৩০ এএম আপডেট: ২৮.১১.২০২৫ ১:০৬ এএম |

 রাজনীতি, নির্বাচন ও সৎ মানুষের খোঁজে...
দেশে যে চাঁদাবাজি হয়, দুর্নীতি হয়-এটা কারা করে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটা পুরনো গল্প শুনে নিই। গল্পটা বারবার এমপি নির্বাচিত একজন এমপির। তিনি বারবার নির্বাচিত হন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। সাংবাদিকরা এলাকায় গেছেন ওইসব অভিযোগ নিয়ে সংবাদ করতে।
একজন ভোটারের কাছে গিয়ে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার এলাকার এমপি দুর্নীতিবাজ, এটা কি জানেন?” বললেন, “শুনেছি। পত্রিকায় পড়েছি।”
“সামনের নির্বাচনে কি তাকে ভোট দেবেন?”
বললেন, “অবশ্যই।”
“কেন, একজন দুর্নীতিবাজকেই কেন ভোট দেবেন?”
ভোটারের উত্তর, “উনি দুর্নীতিবাজ এটা ওনার ব্যাপার, কিন্তু আমার এলাকার এমপি হিসাবে তাকে পেয়েছি একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসাবে। উনি প্রচুর কাজ আনতে পারেন সরকারের কছে থেকে। তার দ্বারাই আমার এলাকায় যথেষ্ট উন্নয়ন হয়। ফলে তাকেই ভোট দেব, কেননা তিনি পারঙ্গম ও শক্তিমান মানুষ। এমপি হিসাবে এরকম পারঙ্গম, ক্ষমতাবানকেই চাই।”
এটা একটা গভীর ক্ষমতাকাঠামোর প্রশ্ন। দুর্নীতি কোনো ক্ষমতাহীন মানুষের কাজ নয়। যার যত বেশি ক্ষমতা, তার পক্ষে তত বড় দুর্নীতি করা সম্ভব। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ, সে তত বড় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ভেঙে নিরাপদে বিরাজ করে। সম্পদ পাচার করাও কোনো দুর্বলের কাজ নয়। ফলে দুর্নীতি ও অর্থপাচার সরাসরি ক্ষমতাসীনদের শক্তির পরিচয় দেয়। আবার দুর্নীতি দমনে যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে, তার নিয়ন্ত্রকরাই যদি দুর্নীতিবাজ হন, তাহলে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে ওঠে।
সামনে নির্বাচন। ফলে এসব আলোচনা উঠে আসছে। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মনে যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা জেগেছে, তার মূলে আছে সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত শাসনের চাওয়া। সম্প্রতি এক জেলাশহরে গণশুনানিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, “সৎ লোককে নির্বাচিত করতে হবে। কে কোন দল করে সেটা বড় ব্যাপার না, দেখতে হবে লোকটা সৎ কিনা?”
তিনি আরও বলেছেন, “সামনে নির্বাচন। নির্বাচনে যারা সংসদে যাবেন, আমরা যাদেরকে নির্বাচিত করব, তাদেরকে দেখে শুনে করব। আমরা খারাপ লোক নির্বাচিত করলে, খারাপই প্রত্যাশা আমাদের। তাই আমরা ভালো লোক নির্বাচিত করব। তাহলে ভালো ভালো প্রশাসক আসবে।”
কাকতালীয় কিনা জানি না, দুদক চেয়ারম্যান যখন একটি জেলাশহরে গিয়ে নির্বাচনে সৎ লোককে খুঁজতে বলছেন তখন খোদ ঢাকা শহরেই এক সেমিনারে আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে। রাজনীতিতে অর্থের আগমন নিয়ে। রাজনীতি যারা করেন তাদের আয় রোজগারের হদিস নিয়ে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকস (দায়রা) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়ন সংস্কৃতি ও ব্যবসা সুরক্ষা: বাস্তবতা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর আয়–ব্যয়ে স্বচ্ছতা নেই। এ ব্যাপারে দলগুলো ‘হাইড অ্যান্ড সিকের’ (লুকোচুরি) আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার জন্য অনেকের কাছে রাজনীতি হয়ে উঠেছে ‘জাদুর কাঠি’।
অনেকের অভিযোগ, ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ (সুবিধাদাতা-সুবিধাভোগী) সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এ কারণেই রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়টিতে পরিবর্তনের জন্য দলের খরচের আইনি সীমাকে বাস্তবসম্মত করা, দলসংশ্লিষ্ট এনটিটিকে (প্রতিষ্ঠান বা সত্তা) তদারকিতে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এই আলোচনায় খুব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, রাজনীতি ও নির্বাচনি সংস্কৃতি দুর্বৃত্তায়িত। রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন করতে হলে দুর্বৃত্তদের দূরে রাখতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে মতামত আসে, গত ১৬ বছরে দেশে ব্যবসা ও রাজনীতির ‘নেক্সাস’ (সম্পর্ক) বেড়েছে। এর ফলে সৎ ব্যবসায়ীরাও রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারছেন না। যারা সরকারে আসবে, তাদের ‘দালালি’ করলে পলিসি (নীতি) পাস করানো যাবে, এমন চিন্তা থেকেও অনেকে ‘দালালি’ করে থাকে। রাজনীতিতে অসৎ হবার প্রক্রিয়ায় সামিল হয়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় আকাক্সক্ষা ছিল, রাজনীতি দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি থেকে মুক্ত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ওই আশা পূরণ হয়নি। বর্ষা বিপ্লবের অনেক যোদ্ধার আয়-ব্যয়ের ফারাক দেখে মানুষের আশা ভঙ্গ হয়েছে। নতুন নায়কদের অনেকের বিলাসী জীবন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুরনো নেতাদের বিলাসিতার উৎস নিয়েও একই প্রশ্ন। যারা বছরের পর বছর আন্দোলন করে ঘরছাড়া ছিলেন, তাদের আয়ের হদিসও এখন মানুষ জানতে চায়। নতুন তুর্কীদের মত তাদের নিয়েও জল্পনা চলবে। এখন না হলেও ভবিষ্যতে সে প্রশ্ন উঠবে।
তাই রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এখন জরুরি। রাজনৈতিক দল চালাতে যে পয়সা লাগে তা আসবে কীভাবে? রাজনৈতিক কর্মী যারা বছরের পর বছর রাজনীতিই করেন তাদের জীবন-জীবিকা, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা চলবেইবা কীভাবে? এটা কোনো একটি দলের সমস্যা নয়, এটা পুরো সমাজের আর্থ-সামাজিক সমস্যা। রাজনৈতিক দলের খরচে স্বচ্ছতা আনতে হলে পরিষ্কার আইন ও নীতিমালা দরকার। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলকে সরকারিভাবে বা জনগণের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুদানের সংস্কৃতি চালু করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবা দরকার। শুধু দলগুলোকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে হবে না, পদ্ধতিগত সংস্কার করতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিড়ালে গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এই হতাশাকে দার্শনিকভাবে প্রকাশ করে বলেছেন, “এত মুসলমানের দেশ, এত মাদ্রাসা-মসজিদ, এত ইমাম-আলেম-ওলামা, এত বিদ্বান-পণ্ডিত থাকার পরও এদেশে এত অন্যায় কেন? এত পাপ কেন? মানুষ এত চুরি-দুর্নীতি করে, সম্পদ বিদেশে পাচার করে কেন, তা আমি বুঝতে পারি না।”
এই হতাশা শুধু নৈতিক নয়, দার্শনিক এবং রাজনৈতিকও। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন আর রাজনৈতিক অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশ এখনো হোঁচট খাচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট-রাজনীতি এদেশে অর্থ উপার্জনের সবচেয়ে লাভজনক আলাদিনের চেরাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল না থাকায়, নিয়মমাফিক নির্বাচন না হওয়ায় অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার জন্য রাজনীতি অনেকের কাছে ‘আকর্ষণীয় জাদুর কাঠি’ হয়ে উঠেছে।
রাজনীতিতে অর্থ, পেশিশক্তি, ধর্ম যুক্ত হয়েছে পরস্পরের স্বার্থ সুরক্ষা দিতে। তার ফলে রাজনীতি, ব্যবসা ও আমলাতন্ত্র মিলে যে শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করেছে তা ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক দলের আয়ের উৎস জনসম্মুখে পরিষ্কার নয়। নির্বাচনি আইনে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা নেই। বৈধ আয়ের উৎস কীভাবে রাজনীতিতে ন্যায়ানুগ হতে পারে, তা বিধিবদ্ধ নেই। প্রতিপালনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত নয়। ফলে গণতন্ত্র আবারও হুমকির মধ্যে পড়লে তা ঠেকানোর উপায় নেই।
রাজনীতির প্রভাবে ‘কালো ব্যবসা’-এর বিপুল প্রসার বন্ধ করা প্রয়োজন। নইলে এমপি-মন্ত্রী হতে পয়সা দেয়া ঠেকানো যাবে না। ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করে রাজনৈতিক অর্থায়ন ন্যায়ানুগ ও নৈতিক করতে না পারলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের যে মর্যাদাময় সুশাসনের আকাক্সক্ষা তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখাটা শেষ করি খুশবন্ত সিংয়ের একটা পুরনো জোকস দিয়ে। কেরালা বিধানসভার এক সদস্য চন্ডীগড়ে এসে তার বন্ধু পাঞ্জাবের এক মন্ত্রীর বাসভবনে ওঠেন। তার বিলাসবহুল বাড়ি ও প্রাচুর্য দেখে জানতে চান, “তুমি কীভাবে এত বিত্তের মালিক হলে?”
মন্ত্রী তার বন্ধুকে বলেন, “আগামীকাল তোমাকে দেখাব।”
পরদিন মন্ত্রী মহোদয় বন্ধুকে গাড়িতে এক জায়গায় নিয়ে আঙুল তুলে দূরে এক ব্রিজ দেখান, “তুমি কী ওখানে একটি ব্রিজ দেখতে পাচ্ছ। ওই ব্রিজের নির্মাণ ব্যয়ের অর্ধেক আমার পকেটে এসেছে।”
চার বছর পর পাঞ্জাবি তার মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তিনি কেরালায় যান তার বন্ধুর বাড়িতে, যিনি তখন রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছেন। পাঞ্জাবি বিস্ময় প্রকাশ করেন, “তুমি আমাকেও হার মানিয়ে দিয়েছ। ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, ইতালিয়ান মার্বেল, মার্সিডিজ গাড়ি। কী করে সম্ভব হলো?”
পরদিন মন্ত্রী তার বন্ধুকে এক জায়গায় নিয়ে দূর উপত্যকার দিকে দেখিয়ে বললেন, “তুমি কি ওখানে একটা ব্রিজ দেখতে পাচ্ছ?’
পাঞ্জাবি উত্তর দিলেন, “না, আমি তো ওখানে কোনো ব্রিজ দেখতে পাচ্ছি না।”
মন্ত্রী বলেন, “ঠিক বলেছ, ওখানে কোনো ব্রিজ নেই। কারণ, ব্রিজের পুরো অর্থ আমার পকেটে এসেছে।”
লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সোশ্যাল মুভমেন্ট অ্যাকটিভিস্ট













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
প্লট দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনা ও দুই সন্তানের সাজা
বিশিষ্ট গাইনি চিকিৎসক ফাহমিদা আজিম কাকলির জানাজা সম্পন্ন
খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চেয়ে কাঁদলেন হাজী ইয়াছিন
আদালত ও কালিয়াজুরি এলাকায় মনিরুল হক চৌধুরীর গণসংযোগ
নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্তে অনুপ্রবেশে রোধে কঠোর থাকবে প্রশাসন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় অস্ত্রশস্ত্রসহ ডাকাত দলের ৫ সদস্য আটক
কুমিল্লায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ
তারেক-ইউনুস ঐতিহাসিক বৈঠকই নির্বাচনের রোডম্যাপ নিশ্চিত করছে
কুমিল্লার নতুন পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান
কুমিল্লায় ইসলামী মহাসম্মেলন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২