
আলী হোসেন, অধ্যাপক আলী হোসেন চৌধুরী, ড. আলী হোসেন চৌধুরী। একই ব্যক্তির তিনটি নাম। প্রায় এক ও অভিন্ন। আলী হোসেনের গুরুজন যাঁরা, তাঁরা প্রথম নামটি ব্যবহার করেন বা এ নামে সম্বোধন করেন। বন্ধু-বান্ধবগণ অধ্যাপক আলী হোসেন চৌধুরী নামটি উল্লেখ করেন। আর মান্যতার ক্ষেত্রে ব্যক্তি আলী হোসেন যাঁদের কাছে ড. আলী হোসেন চৌধুরী হিসেবে সম্মানীয় ও শ্রদ্ধাস্থানটি অধিকৃত, তাঁরা এভাবেই সম্বোধন করেন।
আমি তাকে আলী হোসেন হিসেবেই সম্বোধন করি। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট, ছাত্র নয়, ছাত্র প্রতিম, আমি যখন কুমিল্লা মহিলা কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষক, আলী হোসেন তখন ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। আমার শিক্ষকদেরও ছাত্র। এ হিসেবে সতীর্থও বলা যায়। এগুলো বাহ্যিক পোশাকী পরিচয়। আদর্শগত বিষয়টি যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করি তখন কোথায় যেন একটি যোগসূত্র দৃঢ়বন্ধন অভিধায় একবিন্দুতে মিশে গেছে।

আলী হোসেনের সাথে আমার মিল হলো- আমরা একই বিষয়ে (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) পড়াশোনা করেছি। সারাজীবন কলেজে শিক্ষকতা করেছি। কবি নজরুল বিষয়ে গবেষণা করেছি। এক্ষেত্রে তাঁর স্বীকৃতি আছে তাঁর গবেষণা (অভিসন্দর্ভ) প্রজ্ঞায় পিএইচডি উপাধিতে ভূষিত। এছাড়া আলী হোসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একসময় সাংবাদিকতা করেছে, আবৃত্তিকার, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সংগঠক, ভালো বক্তা, গীতিকার ও গায়ক এবং কবি। এ গুণগুলো আমার মধ্যে নেই। উচ্চারণে আমি কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষা, আলী হোসেন প্রমিত ভাষায় কথাবার্তা ও বক্তৃতা করে দর্শক-শ্রোতাকে সম্মোহনী শক্তিতে মুগ্ধ করার কারিশমায় সমৃদ্ধ। হিসেব করে দেখেছি একমাত্র বয়স গণনায় আমি অগ্রগামী, অন্যান্য ক্ষেত্রে পেছন সারিরযাত্রী। বলতে দ্বিধা নেই আলী হোসেনকে নিয়ে আমি মুগ্ধ। লেখক আলী হোসেন প্রথমত কবি। একসময় কবিতাচর্চায় নিবেদিত ছিল এবং এখনও। তার সমবয়সের কবিদের একটি গোষ্ঠী ছিল। নিজের কবিতা ছাড়াও কবিতা আবৃত্তি যে শিল্পসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ তা নিষ্ঠার সঙ্গে যাপন করত। ফলে একসময় ভাবতাম আলী হোসেনসহ তার বন্ধুরা শুধু কবিতাই জানে-বুঝে। গবেষণার ক্ষেত্রে তার আগমন অনেক পরে। প্রবন্ধ রচনা করত, সাংবাদিকতা করার কারণে গদ্য সাহিত্যের ধারাটা রপ্ত করেছিল, কিন্তু গবেষণার যে মৌলিকধারা, তা তখনও তার আয়ত্তে আসেনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা বিভাগে ড. সৈকত আজগর যোগদান করার পর তাঁর সান্নিধ্যলাভে আলী হোসেন ও আনোয়ারুল হক নতুন পথের সন্ধান পেয়ে যায়। আমি তখন থেকে নিবিড়িভাবে তা অবলোকন করেছি। নিজেও সংশ্লিষ্ট হয়েছি। যদিও আমার গবেষণা কর্ম ছিল না, কিন্তু একাডেমিক বিষয়ে বই লিখতাম জীবিকার প্রয়োজনে। সেজন্য পড়াশুনা করতে হতো প্রচুর। ড. সৈকত আজগর আমার একাডেমিক বই পড়েছে ছাত্রজীবনে, তাই নাম চিনতেন চাকরিসূত্রে যখন একই বিভাগে মিলিত হলেন- তখন আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়ে যায় দ্বৈত। সহকর্মী অর্থাৎ বিভাগীয় প্রধান তিনি, কিন্তু সরকারি সূক্ষ্মচালে অর্থাৎ তিনি ডক্টরেট হওয়ায় পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় ১০% সুবিধায় প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে যান। সুতরাং নিয়মানুযায়ী সিনিয়র হলেও তিনি আমাকে কোনোদিন সে দৃষ্টিতে দেখতেন না, আমার স্থানটি তাঁর কাছে ভিন্নতর ছিল। আমিও তখন গবেষণার বিষয়ে যে প্রথাগত ধারা এবং বিষয়বস্তু নির্ধারণ করার পদ্ধতি, এগুলো তাঁর কাছ থেকে জানতে পেরেছি। যে কথাটি বলতে চাই- আজ আলী হোসেন একজন গবেষক ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, নজরুল বিশেষজ্ঞ। ড. সৈকত আজগর অবশ্যই উৎসাহদানের দাবিদার। আমি ছিলাম আলী হোসেনদের সহযোগী। আলী হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তিগত পথ পরিক্রমার একটি হিসাব দিচ্ছি। তার চাকরি বেসরকারি হলেও পদমর্যাদা ছিল স্বাধীন ও গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক (দেবিদ্বার ও লালমাই কলেজ), বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ (বুড়িচং এরশাদ কলেজ) এবং বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক-কোষাধ্যক্ষ, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য (সিসিএন বিশ^বিদ্যালয়), এ ছাড়া মাঝে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছিল।
আলী হোসেন চৌধুরীর কর্মধারা কুমিল্লা কেন্দ্রিক। অনেক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। একসময় এবং এখনও কচিকাঁচার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কমলাঙ্ক সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, যাত্রী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ইত্যাকার বিশ্লেষণে দেখতে পাই সমকালে প্রতিটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি যেন অবধারিত ও প্রাণবন্ত সম্পূরক। তার গ্রহণযোগ্যতা এ ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয়।আমি মুগ্ধচিত্তে অবলোকন করি। এই যে নীরব কর্মধারায় নিজেকে উৎসর্গ আমেজে বিলিয়ে দেবার উদার মানসিকতা যাপন, তা অবশ্যই ভষ্যিতের নোটখাতায় লিখা থাকবে। রাজনীতি করতেন কীনা জানি না, তবে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় নিবেদিত। অনেকটা বাম ঘরণায় যাপিত বিশ^াসে সর্বজনীন।
আলী হোসেন চৌধুরীর গবেষণা নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। তার অনুসন্ধান বহুমাত্রিক হলেও কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপর তার অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন উচ্চ মার্গে বিভাসিত। ‘কুমিল্লায় নজরুল’ বিষয়টি নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যাত হলেও তার গবেষণার অভিসন্দর্ভ ‘নজরুলের সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি’ ভিন্নমাত্রায় উজ্জ্বল ও অনুসন্ধানধর্মী।
কবিরা তো সমাজ ও সমকালের প্রতিনিধি। নজরুলের কাব্যালোকে আবির্ভাব প্রথম মহাযুদ্ধের পর। নিজেও এ যুদ্ধে সশরীরে জড়িত ছিলেন, ছিলেন হাবিলদার পদবীপ্রাপ্ত সৈনিক। তখন লিখতেন ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’ নামেই। সৈনিকজীবনের পর তাঁর জীবন হয়ে যায় বর্ণিল ও সমাজ-মানুষ-সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল। জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতায় সৃষ্টি প্রবাহ এক নতুন ধরায় এগিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথ তখন একচ্ছত্র কবিতায় সম্রাট। নজরুল তখন নিজের পতাকাটি উড্ডীন করে কবিগুরুর সামনে দাঁড়ালেন, আশীর্বাদ শিরে ধারণ করে নিজের রাজ্যটি স্থাপন করলেন। এ বিষয়টি ছিল মনিকাঞ্চন যুগল মিলন। অভিধায় এক অসাধারণ যুগসন্ধিক্ষণ। আমরা পরবর্তীতে জেনে গেলাম- রবীন্দ্র-নজরুল বাংলা সাহিত্য জগতে সম্পূরক শক্তিধর বৈশি^ক ঠিকানা।
আলী হোসেন কবি নজরুলকে অনুসন্ধান করেছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। নজরুলের সামগ্রিক রচনায় বিষয়বৈচিত্র্য বহুমাত্রিকায় সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল। এ ক্ষেত্রে কবির সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি কতটা প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থিত, কতটা কবি-হৃদয় বন্দরে লালিত ও উজ্জীবিত, তা ব্যতিক্রমী দৃষ্টিতে একটি শাশ^ত বিমূর্ত প্রতিভাস আমাদের কাছে কবিকে গবেষণার মাধ্যমে আলী হোসেন তুলে ধরেছেন। আমরা তখন বুঝতে পারলাম- কবির দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর সৃষ্টিতে মানুষ ও প্রকৃতি সত্যিকার অবয়বে মূর্ত হয়ে উঠেছে, আমরা প্রথাগত নজরুল বিষয়ে নতুন অনুসন্ধানে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখলাম। এখানেই গবেষণার ক্ষেত্রে আলী হোসেন চৌধুরী নতুন ধারার স্রষ্টা।
আমি আলী হোসেনের অভিসন্দর্ভটি নিয়ে দু’টি কথা বলতে চাই। কারণ, এটি তার মাস্টারপিস রচনা, উপস্থাপনা, বিষয়-বিন্যাস, গদ্যশৈলী ও নজরুলের সামাগ্রিক জীবন-বেদ প্রকাশ ঘটেছে এ গ্রন্থে। চারটি অধ্যায়ের বিভক্ত গবেষণা পর্বটি।
১. বাংলাদেশ নজরুল
২. নজরুলের সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ।
৩. নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি।
৪. নজরুলের জীবনদর্শন নির্মাণে বাংলাদেশ।
অধ্যায়গুলোর নামকরণের মধ্যেই বিষয়বস্তু বিশ্লেষিত হয়েছে। নজরুল বাংলাদেশের কবি। এ বাংলাদেশের অখণ্ড বঙ্গভূমি। ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গদেশ। তবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের জনপদের অধিবাসী হলেও পূর্ববঙ্গ তাঁর মসন চেতনায় স্বাপ্নিক স্বদেশ। বাল্যকালে স্বল্পসময়ের জন্য পূর্ববঙ্গে ছাত্রাবস্থায় অবস্থান করলেও ১৯২১ সালের পর থেকে তাঁর সার্বিক বিচরণ ক্ষেত্র ছিল পূর্ববঙ্গ। ময়মনসিংহ-কুমিল্লা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-নোয়াখালী হয়ে প্রায় সমগ্র পূর্ববঙ্গ চষে বেড়িয়েছেন নানা উছিলায়। ফলে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে এ বঙ্গের মানুষ ও তাদের জীবন-প্রবাহ কবি স্পর্শ করেছেন বিভিন্ন প্রতিভাসে। আর প্রকৃতির ছোঁয়ায় কবির পশ্চিমবঙ্গীয় রূঢ়তাকে অতিক্রম করে স্নেহশীল প্রেমিক ও হৃদয়বান সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতায় আপন-পর দূরত্ব গুছিয়ে আমাদের হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এই যে সূক্ষ্ম অভিযাত্রা, যা একজন কবি-মানসকে চিরকালীন করে তুলেছে, আলী হোসেন চৌধুরী গবেষণার কঠিন অনুসন্ধান এ সত্যটি পাঠকের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।
বহুল পঠিত নজরুল, তার একধরনের জীবন সঙ্গীর মতো আত্মীয়। কিন্তু হৃদয় কন্দরে যাপিত স্বরূপ উদ্ধার করা কঠিন বৈকি। গবেষণার মূল রহস্য হয়ত সেখানে। আমরাও নজরুল পড়েছি, নজরুলকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি, গভীরতা অনুসন্ধানে ততটুকু হয়ত স্পর্শ করতে পারিনি। এজন্য মনে হয় আরও ব্যাপকভাবে নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। বিশেষত, সঙ্গীতের কথাই বলতে চাই।
পরিশেষে বলতে চাই, আলী হোসেন চৌধুরীর বহুমাত্রিক সাধনায় নিজেকে কুমিল্লা নয়, বাংলাদেশে বিশেষ আসনে সমাসীন করেছে। তার অব্যাহত কর্মপ্রবাহ আমাদের অনুপ্রেরণার দিক-নিদর্শন। বহু প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় হলো অধ্যাপক ড. আলী হোসেন চৌধুরী। তার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং সাফল্য কামনা করি। আমি তার গুণমুগ্ধ-আদর্শিক আপনজন হিসেবেই জানি। কারণ, তার সান্নিধ্য আমাকে ঋদ্ধ করে।