
১৮৯৯
খ্রিস্টাব্দে শিক্ষানুরাগী আনন্দ মোহন রায় বাহাদুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ আজ শুধু কুমিল্লা নয়, সমগ্র বাংলাদেশসহ
ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে এক উজ্জ্বল নাম। শতাধিক
বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ উন্নয়নে যে অসামান্য
ভূমিকা রাখছে, একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তার গৌরবগাথা স্মরণ করে
নিজের কিছু ভাবনা তুলে ধরছি।
বিশ্ববরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী ও কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজের খ্যাতনামা প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. আকতার হামিদ খানের
‘কুমিল্লা মডেল’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উন্নয়ন কাঠামোর এক সফল উদাহরণ হিসেবে
সমাদৃত। গ্রামীণ সেচব্যবস্থা, খাল খনন, জলাধার নির্মাণ, সড়ক-যোগাযোগ, সমবায়
আন্দোলনসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাঁর অবদান
কুমিল্লাকে বিশ্বপরিচিত করেছে। অথচ এই মহান ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে এখনো
ভিক্টোরিয়া কলেজে কোনো ‘আকতার হামিদ খান চেয়ার’ বা স্মৃতি জাদুঘর
প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কলেজ প্রশাসন চাইলে এই বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে।
এই
কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন,
আধাসামরিক বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্রসহ
বহু খাতে হাজারো প্রাক্তন শিক্ষার্থী উচ্চপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও তারা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। জন
প্রশাসন সচিব এহসান ফারুক, সেতু সচিব আব্দুল রউফ, পূর্ত সচিব নজরুল ইসলাম,
প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. নেয়ামতউল্লাহ, পিএসসি সচিব সানোয়ার হোসেনসহ আরও
অনেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কলেজ উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারেন।
ভৌগোলিক
অবস্থানগত কারণে বৃহত্তর কুমিল্লার পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর,
শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও
নেত্রকোণার বহু মেধাবী শিক্ষার্থী ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তে আগ্রহী। আর্থিক
সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও এখানে পড়াকে অধিক
সুবিধাজনক মনে করেন।
প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীন পরীক্ষাগুলোতে এ কলেজের ফলাফল প্রশংসনীয়। ইঈঝ-এও ভিক্টোরিয়া কলেজের
শিক্ষার্থীদের সাফল্য দিন দিন বাড়ছে, যা এ কলেজের সুনামকে আরও উঁচুতে নিয়ে
যাচ্ছে।
তবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভূগোল, মনোবিজ্ঞান, মৃত্তিকা
বিজ্ঞান, গৃহবিজ্ঞান ও কৃষিশিক্ষা বিভাগ না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী তাদের
পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কলেজের বর্তমান
অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবুল বাশার উল্লেখিত বিভাগসমূহ চালুর প্রয়োজনীয়
কাগজপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন-এ খবর কুমিল্লাবাসীর মধ্যে
আশাব্যঞ্জক সাড়া ফেলেছে।
আরও কিছু প্রয়োজনীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা হলো-
৩০
একরের বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ডিগ্রি ক্যাম্পাসে একটি আধুনিক বোটানিক্যাল
গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করা গেলে ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী প্রকৃতি,
উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং পরিবেশ সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করবে। এতে
ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
১৮ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর
২০২৫ পর্যন্ত ফুটবল ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের পরপর ঐতিহাসিক সাফল্য জাতীয়
ক্রীড়াঙ্গনে নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও এই
আনন্দে সামিল। সেই অনুপ্রেরণা থেকে ডিগ্রি চত্বরে একটি পূর্ণাঙ্গ
আন্তর্জাতিক মানের খেলার মাঠ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।
৩০ হাজারেরও বেশি
শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কলেজে একটি আধুনিক মেডিকেল সেন্টার
স্থাপন করা সময়ের দাবি। বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব
হিসেবে দায়িত্ব পালন করা দুইজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী চাইলে এই উদ্যোগ দ্রুত
বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারেন।
বর্তমানে কলেজে শিক্ষক সংখ্যা ১৭০,
যেখানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজন অন্তত ৩৪০ জন। অধিকাংশ শিক্ষকই মেধাবী,
পরিশ্রমী ও গবেষণামুখী। পিএইচডি ও গবেষণা কার্যক্রমের জন্য যদি বিশেষ
বরাদ্দ দেওয়া হয়, তবে এ কলেজ থেকে বিশ্বমানের মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব।
বাংলাদেশের
অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী কলেজ-ঢাকা কলেজ (১৮৪১), চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ
(১৮৬৯), রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩), খুলনা বজ্রলাল কলেজ (১৮৯৭), বরিশাল বিএম কলেজ
(১৮৯৮) ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের তুলনায় ছাত্রসংখ্যার দিক দিয়ে ভিক্টোরিয়া
কলেজ বহু এগিয়ে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়ও এ কলেজের ছাত্রসংখ্যা
দশ গুণের বেশি।
একটি আধুনিক বিজ্ঞান জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠা
করলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও সৃজনশীলতা আরও বাড়বে। এ লক্ষ্যে
অন্তত ৫০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
২০২৪
সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সফলতার পর নতুন প্রজন্ম নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে
বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করছে।
কুমিল্লার
রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এবং ভবিষ্যতে ১১টি আসনের নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যরা
যৌথভাবে উদ্যোগ নিলে ভিক্টোরিয়া কলেজকে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাকেন্দ্রে
রূপান্তরিত করা কঠিন নয়।
১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এই কলেজে অধ্যয়ন
করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই সময়ের স্মৃতি আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে।
ভিক্টোরিয়া কলেজ নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক, আর সেই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়
আজও আমি আশাবাদী।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ মোহন রায়ের জন্মবার্ষিকী এবং প্রতিষ্ঠার ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম।
লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও চিন্তক
মোবাইল: ০১৩১৪-৬৪৫৯২২
