ঢাকার
সাভারে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত রবিবার দিবাগত রাতে দুটি বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা
ঘটেছে। এই সংঘর্ষ পরদিন দুপুর পর্যন্ত চলে। এতে উভয় পক্ষের বেশ কিছু
শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
যে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান, সেই বিশ্ববিদ্যালয়
দুটি হচ্ছে বিরুলিয়ার খাগান এলাকায় অবস্থিত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল
ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটি। জানা গেছে, সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির
শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের সাভারসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে
ভর্তি করা হয়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে অন্তত ১১টি গাড়িসহ ৩০ কোটি টাকার
বেশি সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বলে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ
ধ্বংসযজ্ঞে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটি। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও
লুটপাটে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
জানা
গেছে, গত রবিবার সন্ধ্যায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর থুতু
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর গায়ে লাগে। এ ঘটনার
জেরে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। পরে
রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির ৪০-৫০ শিক্ষার্থী দেশীয় অস্ত্র ও
ইটপাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটা হোস্টেলে হামলা
চালান। পরে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে
গেলে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে তারা সিটি ইউনিভার্সিটির
শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে তাদের ক্যাম্পাসে ঢুকে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ
শুরু করেন। এ সময় তারা সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক ভবন, উপাচার্যের
কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চলান। লুট হয় কম্পিউটারসহ বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ মালপত্র। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সিটি ইউনিভার্সিটির তিনটি বাস ও
একটি প্রাইভেট কারে। ভাঙচুর করা হয় আরও ছয়টি যানবাহন। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের
শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি।
তুচ্ছ
এ ঘটনা থেকে যে ক্ষয়ক্ষতি হলো তা ব্যাপক আর নিঃসন্দেহে অপূরণীয়। এই ক্ষতি
শুধু ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটির নয়, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের ক্ষতি। দুই দিক
থেকে ক্ষতির বিষয়টি দেখা যায়। প্রথমত, বস্তুগত ক্ষতি; দ্বিতীয়ত, মানসিক
ক্ষতি। সেই সঙ্গে সামাজিক একটা প্রবণতাও সামনে নিয়ে এল, যা এই প্রজন্মের
জন্য আশঙ্কাজনক। প্রজন্ম ছাড়িয়ে তা সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস এবং
বিপন্ন করে তুলছে।
চব্বিশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর শিক্ষার্থীদের একটা
প্রবণতা বেশ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘মানসিক
উগ্রতা’। মনোবিজ্ঞানীরা এই চরম উগ্রতা বা আক্রমণাত্মক আচরণকে মানসিক
ব্যাধির একটি লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছেন। সম্মিলিতভাবে যখন এর প্রকাশ ঘটে,
তখন তারা একে চিহ্নিত করেন সম্মিলিতভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পূর্বলক্ষণ
হিসেবে। এই প্রবণতাটি গভীরভাবে গোষ্ঠী পরিচয় আর সেই গোষ্ঠীর সম্মানের সঙ্গে
যুক্ত থাকে বলে তারা গবেষণা করে দেখেছেন। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’- দুই ধারায়
বিভক্ত হয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণ সাধারণ
বাদানুবাদ থেকে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। উল্লিখিত দুটি
বিশ্ববিদ্যালয় যে নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করল, তা ছিল এই মানসিক বৈকল্যের
প্রকাশ।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি
স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে উগ্র আক্রমণাত্মক
আচরণের প্রকাশ ঘটিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা
কলেজ, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিটি কলেজের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে
অনেকবার। কিন্তু এ ধরনের সংঘাত কখনো সুফল বয়ে আনে না। বস্তুগত ক্ষতি ও
জনদুর্ভোগ তো আছেই, সেই সঙ্গে শারীরিক ক্ষতির শিকার হন অনেকেই। ওই ঘটনায়
উল্লিখিত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শর বেশি শিক্ষার্থী এভাবেই আহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা
বলেছেন, এই উগ্রতা শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। জুলাই
গণ-অভ্যুত্থানের পর তা ক্রমশ বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা ধৈর্য ও সহনশীলতা হারিয়ে
সংঘাতে জড়াচ্ছেন। আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। জেন-জি প্রজন্মকে নিয়ে যে
আশাবাদ ছিল, তা ক্রমশ দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা অনতিবিলম্বে বন্ধ
হওয়া দরকার। তা না হলে প্রজন্ম পরম্পরায় সমস্যা বাড়তেই থাকবে।
সংঘাত
নয়, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা উচিত। এখন যা
ঘটেছে তা নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ না করে ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতিকে শান্ত
থাকা আর সম্মানজনক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সংঘাত কাম্য নয়।
সব পক্ষের জন্যই এই চেষ্টাটা অব্যাহত রাখা জরুরি। সবার শুভবুদ্ধির উদয়
হোক।
