
রাজধানীর
সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা আর চোখে পড়ে না। বিশৃঙ্খলার ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে
দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা। সড়কের অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত
রিকশাসহ অবৈধ যানবাহন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই বীরদর্পে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অবৈধ যান। তারা ইচ্ছেমতো লেন পরিবর্তন করছে, হঠাৎ
ব্রেক কষছে, কখনোবা উল্টোপথে চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়ত
ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই
চালকরা এসব রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমে বেপরোয়া আচরণ করছেন। কোথাও কোথাও
চালকদের অতিমাত্রায় দৌরাত্ম্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সচেতন নাগরিকদের। সড়ক
নিরাপত্তা টাস্কফোর্স, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলসহ যারা সড়কের শৃঙ্খলা
নিশ্চিত করার দায়িত্বে রয়েছেন, তারাও এ ক্ষেত্রেবেশ রহস্যজনক ভূমিকা পালন
করছেন। যেন পুরো সড়ক রিকশাচালকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন তারা। অনেক স্থানে
ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে বাধা দেওয়ায় মব সৃষ্টি করে পুলিশের ওপর সংঘবদ্ধ
হামলার ঘটনাও ঘটেছে। প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে ব্যাটারিচালিত রিকশার
লাগামহীন দৌরাত্ম্য শুরু হয় দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একাধিকবার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের চেষ্টা করে
ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। উল্টো রিকশাচালকদের সমিতিগুলো রাস্তা অবরোধ করে
বিক্ষোভ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও
অটোরিকশাচালকের সংখ্যা অর্ধকোটির বেশি। ঢাকা শহরে এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
কিন্তু এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। ব্যাটারিচালিত
রিকশা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যে আন্দোলন হবে বা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, তা নিয়ে
আতঙ্কে রয়েছে প্রশাসন।
গত বুধবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়েছে।
এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও
সম্পদের ক্ষতি’। কিন্তু দেশের বর্তমান সড়কগুলোতে অবৈধ যানবাহনের যে গতি
তাতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক যুগে দেশে ৬৭
হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত হয়েছেন। এসব
দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন। গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ
হারাচ্ছেন ২৭ জন এবং আহত হচ্ছেন ৩৮ জন। শুধু ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭
হাজার ৯ জন মারা যান। ২০২৪ সালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৫৪৩-এ।
অর্থাৎ এক বছরে মৃত্যু বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে সারা
দেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত ও ৯৬৪ জন আহত হয়েছেন। সরকারি সংস্থা
বিআরটিএর তথ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ২০২৩ সালে সড়ক
দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জন নিহত হন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ৫ হাজার ৩৮০-তে
দাঁড়ায়। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৪৩৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪০৯ জনের এবং আহত
হয়েছেন ৪৫৫ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ঈদের সময় (গত ২৪
মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত) ঢাকায় ঘটে যাওয়া ৩১৫টি সড়ক দুর্ঘটনার প্রায়
১৫ শতাংশ ঘটেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব
প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,
‘‘রিকশা চলাচলের এ বিশৃঙ্খল অবস্থা পৃথিবীর আর কোনো মেগাসিটিতে রয়েছে কি না
আমার জানা নেই। এসব যদি রাজধানীতে চলে তার নির্দিষ্ট একটা গাইডলাইন
রাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া উচিত। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা যেভাবে
চলছে সেটি একটি ভয়ংকর প্রবণতা। এখনই তা থামানো না গেলে ভবিষ্যতে তা আরও
বাড়বে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ‘ট্রাফিক সিস্টেম’ যেভাবে অকার্যকর
হয়ে যাচ্ছে তা আর ঠিক করা যাবে না।’’
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা ও নগর
পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এগুলোর সমাধান না হলে বিপর্যয় অনিবার্য।
ব্যাটারিচালিত রিকশার রাজত্ব সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে
দেখা হচ্ছে। প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন
ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক
অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূল কারণ।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষের
প্রাণহানির পরও দেশে অবৈধ যান দিন দিন বাড়ছে। এটি রীতিমতো শঙ্কার বিষয়।
দেশে নিরাপদ সড়ক প্রকল্পেও গতি আসছে না। স্থানীয় অর্থায়ন ও বিশ্বব্যাংকের
ঋণে দুই বছর আগে এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেই উদ্যোগে
অগ্রগতি মাত্র দশমিক ১৯ শতাংশ। কাজে ধীর গতির জন্য গত অর্থবছরে এ প্রকল্পের
বরাদ্দ থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঋণ ফেরত নিয়ে গেছে বিশ্বব্যাংক। আমরা
সবাই চাই নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, এ জন্য দরকার সরকারের সমন্বিত ও কার্যকর
পদক্ষেপ। ব্যাটারিচালিত যানের ক্ষেত্রে চালকরা অবশ্যই কর্তৃপক্ষের নীতিমালা
অনুসরণ করবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদদের
পরামর্শ কাজে লাগাতে পারে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে শৃঙ্খলা ফেরানো
খুবই জরুরি। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার অচিরেই সে কাজটি করতে সক্ষম হবে।
