
একটি দুর্ঘটনায় আধুনিক মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেট এলাকাতেই বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু গত রবিবার ফার্মগেটে আবার মেট্রোরেলে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকশায় ত্রুটির কারণে এমনটি হতে পারে। এ ছাড়া তদারকি ও গাফিলতির বিষয়টিও রয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালাম আজাদ নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয় গত রবিবার। এ ঘটনায় আরও চারজন আহত হন। এরপর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো দেশ। ভয়াবহ ও অপ্রত্যাশিত এ দুর্ঘটনার ভিডিও, ছবি এবং সংবাদে রীতিমতো তোলপাড় ২য় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এতে দেশবাসীর মধ্যে নেমে আসে শোকের পাশাপাশি আতঙ্ক। কারণ এত বড় একটা আধুনিক যান ঢাকার বুক চিরে চলছে অথচ পথচারী নিরাপদ নয়। মেট্রোরেলের একেকটি স্প্যানের ওজন কয়েক শ টন। পিলার ও ভায়াডাক্টের মতো ভারী বস্তুর চাপের পরও কীভাবে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে যায়, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোরেলের নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু মানুষ যখন মারা যাবে, চলাচল অনিরাপদ হবে, তখন বুঝতে হবে এখানে নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। বাঁক ও উঁচু হওয়া প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের বিষয়। এ জন্য বাড়তি খরচ মেট্রোরেলে করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাঝুঁকি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এত বড় একটা মেগা প্রকল্পে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা আরও বাড়বে এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলে পিলার রয়েছে ৪২০টি। প্রতিটি পিলারে রয়েছে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড। সব মিলিয়ে বিয়ারিং প্যাডের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮০টি। প্রতিটি বিয়ারিং প্যাডের ওজন ৫০ থেকে ৮০ কেজির মধ্যে। বিয়ারিং প্যাড হলো রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার এক ধরনের প্যাড। এটি মেট্রোরেলের খুঁটি বা পিয়ার (পিলার) এবং উড়ালপথের (ভায়াডাক্ট) মাঝখানে বসানো হয়। দুটোই কংক্রিটের তৈরি হওয়ায় একটির ওপর আরেকটি স্থাপন করলে ঘর্ষণজনিত সমস্যা হতে পারে, এমনকি স্থানচ্যুতিও ঘটতে পারে। স্থাপনাটি সুরক্ষার জন্য বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়। অথচ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধানের অভাবে সেটিই নাগরিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, জাপানি পরামর্শক বা ঠিকাদার আমাদের নিম্নমানের সামগ্রী গছিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের নন-টেকনিক্যাল ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালকরা সেসব সামগ্রী বুঝিয়ে নিয়েছেন না বুঝেই। তারা রোলিং স্টক কেনার জন্য না বুঝেই অনেক টাকা ছাড় দিয়েছেন। এখানে কোনো পক্ষের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। দুই পক্ষের কারণেই এখন মেট্রোরেল অনিরাপদ যানবাহন বলে প্রতীয়মান হবে। সামনে আরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই শুধু মেট্রোরেল ভায়াডাক্টের বিয়ারিং প্যাড না, পুরো স্থাপনার রোলিং স্টক, ট্র্যাক- সবকিছুর নিরাপত্তা সনদ অবশ্যই নিতে হবে। এগুলো জাপানি পরামর্শকদের মাধ্যমে আদায় করতে হবে। এমআরটি-৬ প্রকল্পের সেফটি অডিট করে দেখতে হবে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে। তারপর ঠিকাদার ও পরামর্শকের কাছ থেকে সব রোলিং স্টক, অন্যান্য কম্পোনেন্ট এনে স্থাপন করতে হবে মেট্রোরেলের ট্র্যাক বা অন্যান্য অবকাঠামোয়। প্রয়োজন হলে জাপানি পরামর্শককে ডেকে আনতে হবে।
মেট্রোরেলের অন্যান্য অবকাঠামোয় নিরাপত্তাঝুঁকি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝে নিতে হবে। মেট্রোরেল সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি হচ্ছে কি না, সে বিষয়টিও সরকারকে সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এত বড় একটি স্থাপনা ও যানের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সাধারণ পথচারীদের চলাচলে যাতে শঙ্কা না থাকে এবং আর কোনো দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে দিকটা কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে। এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা আর না ঘটুক, সেটিই প্রত্যাশা।
