
ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মৌসুম পরিবর্তন ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দীর্ঘায়িত হয়েছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হলেও সংশ্লিষ্টরা এর গুরুত্ব দিচ্ছে না। বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক কম থাকলেও জুন থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। তখন জনস্বাস্থ্যবিদরা সতর্ক করেছিলেন- প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার কেউই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। উপরন্তু অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত ব্যবস্থাও দুর্বল করা হয়েছে। যার ফল এখন ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মশা নিধনের বড় কাজটি করতে হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার বিষয়টি দেখবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ববেশি। একটি মন্ত্রণালয়ের কাজ ডেঙ্গু রোধ করা। যদি তারা রোধ করতে না পারে, তাহলে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে। আক্রান্ত হলে পরের কাজটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, তারা রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া জনসচেতনতার জন্যস্ব স্ব জায়গা থেকে সব মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকছে কি না তা সরকারের সব দপ্তর, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গু মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৭৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় ১৬৪ জনের। ২০২০ সালে করোনার কারণে ডেঙ্গুর দিকে নজর ছিল না। ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর আগে কখনোই এত মানুষ আক্রান্ত হননি বা মৃত্যু হয়নি। সে বছর আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২০২৪ সালে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন আক্রান্ত হলে মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৬৪ হাজার ৩৯৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা গত জুলাই মাস থেকে বাড়তে থাকে। আগস্টের চিত্র ছিল জুলাই মাসের মতো। সেপ্টেম্বরে আবার তা বাড়তে শুরু করে। চলতি অক্টোবরে গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় আরও বেড়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু নির্মূল করা খুব কঠিন। যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ তা করতে পেরেছে। আমরা পারছি না। আমাদের দেশের মূল সমস্যা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ব্যবস্থা নেই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ কার্যক্রমগুলো সঠিকভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা দরকার। আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি কিন্তু সেটা কতটা বাস্তবসম্মত, কতটা কার্যকর, সেই হিসাব করছি না। কোথায় সমস্যা তা যদি ধরতে না পারি, তাহলে সমাধান করব কীভাবে? সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়ন আমাদের দেশে হয় না। দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করার ফলেও মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমগুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মশক কর্মীদের প্রণোদনা এবং শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায় আছে। আশা করছি, সরকারের প্রচেষ্টা এবং সবার সম্মিলিত সহযোগিতার মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
