
সরকার প্রধানের ঘোষিত সময় অনুসারে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মাঝে গত পরশু প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আইনানুগভাবে আয়োজনের লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। তিনি এও বলেন, এবারের জাতীয় নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে তারা কোনো ধরনের চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। সিইসি এই কথাগুলো বলেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে। আগামী নির্বাচনে এই ইউএনওরাই মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবেন। প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অন্য চার নির্বাচন কমিশনার এবং ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন।
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আইন মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, আমরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করব না, আপনাদেরও তা করতে দেব না। শুধু সিইসি নন, অন্য নির্বাচন কমিশনারদের কণ্ঠেও এই দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, এবার ভালো নির্বাচন করতে না পারলে জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে লজ্জার মুখে পড়তে হবে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাই এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। এ জন্যে ইএনওদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যেন পক্ষপাতমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেক নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, এখন নির্বাচন নিয়ে কর্মকর্তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অবৈধ আদেশ মানা যাবে না। নির্বাচন হতে হবে পক্ষপাতিত্বহীন ও আয়নার মতো স্বচ্ছ। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্বাচন আচরণবিধি মেনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশে দিয়েছেন।
শুরু থেকেই আমরা লক্ষ করছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা, এমনকি নির্বাচন কমিশনের উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলে আসছেন। তাদের সেই অঙ্গীকার সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভোটাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে। তবে এর মাঝেও নির্বাচন কমিশনারদের সম্পর্কে কারো কারো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য গণমাধ্যমের সূত্রে আমাদের নজরে এসেছে।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে সেই জুন মাস থেকে টানাপোড়েন চলছে। ইসি এই প্রতীক না দেওয়া প্রসঙ্গে আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছে কিন্তু প্রতীকটি না পেলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে এনসিপি। দু পক্ষের মধ্যে অবস্থা এমন তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গত ১৯ অক্টোবর এনসিপির একজন নেতা নির্বাচন কমিশনকে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। এই ধরনের অভিযোগ বিবেচনাপ্রসূত নয়।
অন্যদিকে গত মাসের শেষদিকে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে পরামর্শ দিয়েছে, কোনো চিহ্নিত ব্যাংক ও সমমনা প্রতিষ্ঠান থেকে কাউকে যেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া না হয়। বিএনপির ওই একই প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে দেখা করে বলেছে, ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকতাদের’ আগামী নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে দেখতে চায় না বিএনপি।
বোঝা যায়, প্রায় সব পক্ষই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তারা বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশন কোনো বাঁকা পথে যাবে না। কারো পক্ষে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কাজ করবে না। এটা নির্বাচন কমিশিনের ‘কমিটমেন্ট’ বা ওয়াদা। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের এই দৃঢ় ভূমিকাকে আমরা যথাযথ ও প্রয়োজনীয় মনে করি। বিগত কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে যেসব কাণ্ড ঘটেছে তাতে জাতীয় নির্বাচন সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। নির্বাচনের সেই চর্চা থেকে নির্বাচন কমিশন এবার বেরিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা এবার দেশের ইতিহাসের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ নির্বাচন করতে চায়। দেশের সাধারণ মানুষও সেটাই প্রত্যাশা করে। এর কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের জন্যই এটা জরুরি। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষপাতমূলক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডে জড়াবে না। গত বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভবনে এই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তারা কোনো চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। নির্বাচন কমিশন তার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে বলে আমরাও আশাবাদী। জাতি আসলে এরকম একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে।
