
গত অর্ধশতাব্দী আমাদের
কাছ থেকে একটা সান্ত¡না কেড়ে নিয়েছে। ব্যক্তিমানুষ যদিও অমর নয়, তবু
মনুষ্যজাতি অমর, এই আশ্বাস রক্ষা করা আজ আর সহজ নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে
অথবা মাহকাশ থেকে কোনো অতর্কিত আক্রমণে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে, এই
দুঃস্বপ্ন তো আগেও ছিল। কিন্তু আজ দেখা দিয়েছে অন্য এক ভয়ংকর সম্ভাবনা,
অতীতে যা ছিল না। মানুষ নিজেই প্রলয় ডেকে আনতে পারে, মানুষের গড়া সভ্যতাকে
সে নিজেই সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারে, এই সম্ভাবনা হঠাৎ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে
উঠেছে, হিরোশিমার ওপর বোমা বর্ষণের দিন থেকে।
দুই মহাশক্তির ভিতর
শান্তিচুক্তি সত্তে¡ও সার্বিক বিনষ্টির বিপদ কাটেনি। পৃথিবীময়
সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপের প্রসার গত কয়েক দশকের একটি প্রধান ঘটনা।
সন্ত্রাসবাদ নতুন নয়। কিন্তু মারাত্মক ধ্বংসের অস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের হাতে
আজ যে পরিমাণে পৌঁছে গেছে এমন কখনো আগে ছিল না। এ ব্যাপরটাকে নিয়ন্ত্রণের
মধ্যে আনা যাচ্ছে না। মানুষ মারার ভয়ংকর যন্ত্রগুলো যদিও প্রধানত বেড়ে
উঠেছে রাষ্ট্রের উদ্যোগে, তবু আজ সেগুলো কোনো কেন্দ্রীয় নির্ভরযোগ্য
নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই নেই, ছড়িয়ে পড়েছে নানা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন গুপ্ত
উন্মত্ত গোষ্ঠীর হাতে। এই ঝোঁকটাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। এর শেষ কোথায়?
জীবনের ছোটোখাটো বিপদগুলো তো থাকবেই। তার সম্পর্কে প্রতিবিধানের চেষ্টাও
চলবে। কিন্তু যে সর্বনাশের কথা এই মাত্র বলা হলো সেটা সম্পূর্ণ অন্য মাপের
বিপদ। আমরা কী করে এই অবস্থায় এসে পৌঁছলাম, এথেকে বেরোবার পথ কোথায়? বিশ
শতকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলি আমাদের চেতনাকে আঘাত করছে হিংস্র
হুংকারের মতো।
আধিুনিক সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার ভিতর একটা অদ্ভুত
আত্মখÐন আছে। একদিকে সে বিজয়ী, সে প্রবল ও আপাত দৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য।
অন্যদিকে সে আত্মহন্তারক। এই বিপরীত চরিত্র একটু তলিয়ে দেখার যোগ্য। আধুনিক
সভ্যতার বিজয়ী ভ‚মিকার কথাটা প্রথমে বলা যাক। এই সভ্যতার মূলে আছে
শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তির নিত্য নবায়ন, বৃহৎ শিল্পের প্রসার ও প্রাধান্য।
একসময়ে এই বৃহৎ শিল্পায়নকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন এই বলে যে, এর ভিতর দিয়ে
পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর হবে, মানুষের আয়ু বাড়বে, সুখ বৃদ্ধি ঘটবে,
আরাধ্য প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু গত দুশো
বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুখের আশা মানুষ
করেছে বটে, তবু শিল্পবিপ্লবকে সে বেছে নেয়নি শুধু সুখের সন্ধানে। একের পর
এক নানা দেশ যে বৃহৎ শিল্প ও আধুনিক প্রযুক্তির পথে এগিয়ে গেছে তার একটা
অন্য বড়ো কারণ ছিল। দুয়েকটি উদাহরণ দিলে কথাটা স্পষ্ট হবে। গত শতকের
মাঝামাঝি সময়ে জাপানের মনে আশঙ্কা জাগল যে শিল্পে শক্তিশালী পশ্চিমী
দেশগুলো তার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে এগিয়ে আসছে। এইরকম আশঙ্কা করার কারণও
ছিল। সভ্যতার বিচারে পশ্চিমী দেশকে জাপান সেদিন বড়ো মনে করেনি, বরং
জাপানিদের চোখে ওরা ছিল বর্বর। জাপান ঠিক করে ফেলল, বর্বরদের অস্ত্র দিয়েই
ওদের ঠেকাতে হবে, অন্য উপায় নেই। এই চিন্তার ফলেই গত শতকের শেষদিকে জাপান
দৃঢ়সংকল্প নিয়ে শিল্পোন্নয়নের পথে এগিয়ে গেল। সুখ নয়, উচ্চতর সভ্যতা নয়,
সামরিক শক্তির বিচার থেকেই আধুনিক শিল্পায়নের পথ সেদিন বেছে নেওয়া হয়েছিল।
এশিয়া ও বিশ্বের ইতিহাসে এটা তাৎপর্যময় এক ঘটনা।
জাপান উদাহরণ মাত্র।
এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে এ যুগের ইতিহাসটাকেই বোঝা হয় না।
স্তালিন যে রুশদেশকে বৃহৎ শিল্পের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন
তার পিছনেও ওইরকম একটা মানসিক উদ্বেগ কাজ করছিল। শিল্পায়নের দৌড়ে পশ্চিমকে
ধরে ফেলতে হবে, টপকে যেতে হবে, নয়তো পশ্চিমের পদানত হতে হবে। স্তালিনের
আগে সম্রাট পীটার দা গ্রেটও রুশদেশের আধুনিকীকরণের জন্য ব্যস্ত হয়ে
উঠেছিলেন। না, এঁরা কেউই মানুষের সুখ বৃদ্ধির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েননি,
ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতাটাই ছিল আসল ব্যাপার। পৃথিবীর নানা অংশে
আঞ্চলিক কিছু বৈশিষ্ট্যসহ ইতিহাসের সেই ধারা আজও চলছে।
শিল্পায়নের পথে
যে দেশ সেদিন এগিয়ে যাবে সে হবে শক্তিশালী, যে দেশ পিছিয়ে পড়বে সে দুর্বল
অতএব স্বাধীনতা রক্ষায় অক্ষম। এই যুক্তিটাকে অত্যন্ত জোরালো করেই তুলেছে।
শিল্পোন্নয়নই মানুষের সুখ বৃদ্ধির পথ এই তর্কে জেতা কঠিন। কিন্তু
শিল্পোন্নয়ন দেশ রক্ষার জন্য আবশ্যক, এই যুক্তিকে ঠেকানো কঠিন। দেশের
স্বাধীনতা রক্ষার অন্য পথের কথা গান্ধীজী ভেবেছেন। চীনের নেতা মাও এ বিষয়ে
কিছু নতুন চিন্তা করেছেন। কিন্তু তাঁদের চিন্তা নিজ নিজ দেশেও শেষ পর্যন্ত
গ্রাহ্য হয়নি। বৃহৎ শিল্পের বিজয় যাত্রা তাই অব্যাহত। আধুনিক অস্ত্র
প্রধানত কুটিরশিল্পে তৈরি হয় না, সেজন্য ভারী শিল্পের গুরুত্ব স্বীকার করে
নিতে হয়, অথবা অন্যদেশের ভারী শিল্পের ওপর নির্ভর করতে হয়। বৃতৎ শিল্পের
পাশে পাশে অবশ্য ক্ষুদ্র শিল্পেরও স্থান হতে পারে। তবে এই ক্ষুদ্র শিল্পও
বৃহৎ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এইসব নিয়েই আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তির
জয়যাত্রা অব্যাহত আছে। শিল্পায়নের আকর্ষণের আরও একটি কারণ উপেক্ষা করা যায়
না। আধুনিক প্রযুক্তি একদিকে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে অভ‚তপূর্ব ধ্বংসের
শক্তি, অন্যদিকে নবনব ভোগ্যব¯ুÍ। পুরানো যুগে ভোগবাদ ছিল ছোটো এক অভিজাত
শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ। এই অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে বাকি সমাজের দূরত্ব ছিল
দুস্তর। সমাজের অধিকাংশ মানুষ সেদিন বিনা প্রশ্নে দারিদ্র্যকে মেনে
নিয়েছিল। আধুনিজ সমাজের এক বৈশিষ্ট্য হলো নব মধ্যবিত্তের দ্রæত সংখ্যা ও
প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। শুধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত নয় এই নতুন মধ্যবিত্ত। আরও
আছেন বৃহৎ শিল্পে নিযুক্ত পরিচালক ও যন্ত্রবিদেরা, প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত
বহুসংখ্যক আমলা, সেনাবাহিনীর অফিসারবৃন্দ, বিভিন্ন পেশায় অধিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ
ও পরামর্শদাতা, দালালি ও মধ্যস্থতায় অভিজ্ঞ নানারকমের মানুষ, আইনজীবী,
রাজনীতিবিদ এবং এঁদের আশ্রিত আরও অনেকে। এই মধ্যবিত্ত আবার উচ্চ-নীচ নানা
স্তরে বিভক্ত। অর্থাৎ, অভিজাত শ্রেণি ও সাধারণের অনতিক্রম্য ব্যবধান আজ
অপসৃয়মাণ। ফলে ভোগবাদী আশা-আকাক্সক্ষা অপেক্ষাকৃত দ্রæত উপর থেকে নিচে
ছড়িয়ে পড়েছে। দূরদর্শন ও বিজ্ঞাপনের গুণে এটা আরও বেশি প্রকট। দারিদ্র দূর
করা না গেলেও তাকে মৌনভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে না। ধনী দেশের ভোগী অভ্যাস আজ
গরিব দেশেও বহুদূর ছড়িয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মাওয়ের চীনে,
স্তালিনের রুশ দেশে নতুন প্রজন্ম ভোগবাদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট। নতুন
শিল্প ও প্রযুক্তির বিজয় অভিযান এক্ষেত্রেও আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য।
একদিকে
আছে শিল্পবিপ্লব ও আধুনিক প্রযুক্তির এই বিজয়ী ভ‚মিকা। অন্যদিকে তার
হন্তারক চরিত্র। জঙ্গি রাষ্ট্রীয়তাবাদের সঙ্গে শিল্পবিপ্লবের সম্পর্ক
ঘনিষ্ঠ। আধুনিক রাষ্ট্র ক্ষমতার এক পুঞ্জীভ‚ত রূপ। দেশের ভিতর যেমন সে
ক্ষমতায় সমকক্ষহীন, দেশের বাইরেও সে চায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী ক্ষমতা। সমকক্ষ অপর
রাষ্ট্র তার চোখে সম্ভাব্য শত্রæ। সীমান্তরক্ষার নামে প্রবিবেশী দেশের
স্বাধীনতা হরণে সে নিঃসংেকাচ। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে অপর জাতির ওপর
নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সে অক্লান্ত। এইভাবে শুরু হয়ে যায় বৃহৎ
শক্তিগুলোর ভিতর ক্ষমতার লড়াই। প্রতিরক্ষা অর্থাৎ সামরিক শক্তি বৃদ্ধির
জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যয় করেছে প্রত্যক্ষভাবে ও
গোপনীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, অন্য কিছুর জন্য তত নয়। গত অর্ধশতকে শিল্প ও
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে নতুন বিপ্লব ঘটে গেছে তার পিছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ এই
সামরিক গবেষণা এবং তার প্রত্যক্ষ ফলাফল। আর এরই ফলে মানুষের হাতে পৌঁছে
গেছে অপরিমিত বিনাশের শক্তি। শত্রæর বিনাশ নয়, শত্রæমিত্র নির্বিশেষে একই
সঙ্গে সকলের বিনাশের পথ এইভাবে খুলে গেছে। জাতীয় সুরক্ষার নামে আধুনিক
রাষ্ট্র ও প্রাগ্রসর প্রযুক্তি মানবজাতিকে আজ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সার্বিক
ধ্বংসের ভয়াবহ সম্ভাবনার মুখোমুখি। যেটা হওয়ার কথা ছিল শত্রæ সংহারের উপায়
সেটা হয়ে উঠেছে আত্মহত্যার পথ। ভোগবাদও আবার অন্য একভাবে এই পরিণামের দিকেই
আমাদের ঠেলে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে ভোগতৃষ্ণা যত ছড়িয়ে গেছে ততই অতৃপ্ত
তৃষ্ণার ফলে ঈর্ষা ও ব্যর্থতাবোধ বেড়েছে। ঈর্ষাকাতরতায় সামাজিক বন্ধন শিথিল
ও সুস্থ সহানুভ‚তি বিনষ্ট হচ্ছে। আমরা যাকে উন্নতির উপায় বলে মেনে নিচ্ছি
সেটাই আমাদের মনের শান্তি হরণ করছে। আর সেই অপহারক শক্তিকে তারপরও আমরা আরও
বেশি করে জড়িয়ে ধরি। ভোগ্যবস্তুর বাজারে প্রতিদ্ব›িদ্বতা বাড়ছে। যুদ্ধ ও
ভোগ্যবস্তুর একই সঙ্গে আয়োজন করতে গিয়ে জাতীয় ও জাগতিক অর্থনীতিতে গভীর
সংকট দেখা দিয়েছে। আরও একটা কঠিন মানসিক ও সামাজিক সমস্যা তীব্র হয়ে উঠেছে
যার সংক্ষিপ্ত উল্লেখমাত্র এখানে করা যাবে। ভোগ জিনিসটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক,
বিচ্ছিন্নতামুখী। পারস্পরিক যোগ নয় বরং ভোগই সুখের সিংহদ্বার, এই রকমের
চিন্তা যতই মানুষের মনকে অধিকার করছে ততই মানুষ ভিতরে ভিতরে এক অর্থহীন
একাকিত্বে আটকে যাচ্ছে, যন্ত্রজাত বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক অদ্ভুত ও
অনতিক্রম্য একঘেয়েমি ও অসহায়তায় অস্থির হয়ে উঠেছে। জীবনের এই অর্থহীন ও
অসহায়তা থেকে সে উদ্ধার খুঁজছে কখনো নেশাগ্রস্ততায়, কখনো উত্তেজক অসহিষ্ণু
সংঘবদ্ধ কোনো আন্দোলনে। এই সবের ভিতর দিয়ে হিংসার বাতাবরণ বেড়ে চলে।
দক্ষিণপন্থি ‘মৌলবাদী’ আন্দোলন, বামপন্থি, ‘বিপ্লবী’ আন্দোলন, কিছুই এই
হিংসার হাত থেকে মুক্ত নয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত হিংসা ও বিভেদগামী
প্রবৃত্তির আঘাতে মানুষের সমাজ আজ গভীরভাবে বিপন্ন।
এইখানে দাঁড়িয়েই
আজকের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অন্য এক সমাজের সন্ধান করছে। সেই মানুষ খুঁজে
নিতে চাইছে এক বিকল্প জীবনদর্শন ও ইতিহাসবোধ, যা তাকে আকর্ষণ করবে
গৃহযুদ্ধের সর্বনাশের আবর্তে নয়, নেশা ও উত্তেজনার প্রবঞ্চনার মধ্যে নয়,
বরং অন্য এক সমবায়ী সৃজনশীল কর্মের পথে।
বর্তমানে জানালাটি দিয়েই
দিগন্তবিস্তৃত অতীতকে আমরা দেখি। সময়ের যে বিশেষ খÐটিতে আমাদের বাস, যেসব
সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবিত, যে অভিজ্ঞতায় আমাদের জীবন রচিত, তার সঙ্গে সম্পর্ক
রেখেই অতীতকে আমরা ব্যাখ্যা করি, বুঝতে চেষ্টা করি, ইতিহাস থেকে শিক্ষা
গ্রহণ করি। এই রকমই বারবার হয়েছে। তার অনেক উদাহরণই দেওয়া সম্ভব। তবে একটির
উল্লেখই এখানে যথেষ্ট। উনিশ শতকে পশ্চিমী ধনতন্ত্রের উত্থানের একটি বিশেষ
পর্যায়ের চিন্তানায়ক কার্ল মার্কস/সেসমেয় পশ্চিমী ইউরোপে শিল্পের দ্রæত
প্রসার ঘটছিল আর এই শিল্পকে আশ্রয় করে গঠিত হচ্ছিল, ক্রমে সংঘবদ্ধ হয়ে
উঠছিল, এক নতুন শ্রমিক শ্রেণি। এই শ্রমিকদের সঙ্গে শিল্পতি শ্রেণির আর্থিক
স্বার্থের দ্ব›দ্ব যুগচেতনায় একটা বড়ো স্থান দখল করেছিল। দুই শ্রেণির মধ্যে
এই দ্ব›দ্বমূলক সম্পর্ক, শ্রমিকের জীবনধারণে ও রাষ্ট্রের নীতিতে তার
প্রতিফলন, তৎকালীন অর্তনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে তার প্রকাশ, মার্কসের
চিন্তাভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে যখন তিনি
ইতিহাসের দিকে তাকালেন তখন তাঁর মনে হলো যে, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস মূলত
শ্রেণিদ্ব›েদ্বর ইতিহাস।
সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে মার্কসের এই দৃষ্টিভঙ্গি
তৎকালের বিচারে স্বাভাবিক এবং আংশিকভাবে সত্য। তবু ভ্রান্ত, একাধিকভাবেই
ভ্রান্ত। একদিকে সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব বস্তুত শ্রেণিদ্ব›েদ্বর চেয়ে
আরও জটিল ও গভীর। অন্যদিকে স্বার্থের দ্ব›দ্বই একমাত্র কথা নয়, মানুষের মূল
ঐক্যটাও কিন্তু কম সত্য নয়। বিশ শতকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই কথাগুলো আবারও
মিলিয়ে দেখা দরকার।
প্রাচীন সমাজে রাজার স্বেচ্ছাচারিতাকে বাঁধবার
চেষ্টা হয়েছে রাজধর্মেরই কিছু অনুশাসনের ভিতর দিয়ে। ক্ষমতাকে সহনীয় করা
হয়েছে দয়াধর্ম ও ন্যায়পরায়ণতার কিছু বিধান দিয়ে। স্বেচ্ছাচারী রাজা আর
ধর্মনিষ্ঠ রাজার ভিতরে আদতে কোনোই প্রভেদ ছিল না একথা বললে ভুল বলা হবে।
প্রজারা নিজেরাই কোনো কোনো শাসককে অত্যাচারী বলে চিহ্নিত করেছেন, কোনো কোনো
রাজাকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রেখেছেন। তবে বর্তমান যুগের
কাছাকাছি এসে হিংসা ও অহিংসার অমীমাংসিত দ্ব›েদ্বর স্মরণযোগ্য প্রকাশ ঘটেছে
অন্য এক রূপে।
এ যুগে গণতান্ত্রিক আদর্শের স্বীকৃতি অহিংসার দিশায় এক
উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের ক্ষয়ের মুখে ঘটেছে নতুন আদর্শের
প্রচার ও প্রসার। সমাজ পরির্তনের শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির সন্ধান গণতন্ত্রের
একটা মূল কথা। গণতান্ত্রিক মানুষ বিশ্বাস করেন পরমতসহিঞ্চুতায়। তোমার মতামত
যদি-বা আমি না মানি, তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীন আমি অবশ্যই মানব, এই
চিন্তাধারায় শান্তি ও সহিষ্ণুতার আদর্শকেই শ্রেয় বলে স্বীকার করে নেওয়া
হচ্ছে।
বলা বাহুল্য, অহিংসাকে বাস্তবজীবনে তার বিশুদ্ধরূপে পাওয়া যায়
না। মধ্যযুগে ধর্মের আচারে হিংসা ও অহিংসা মিলেমিশে ছিল। আধুনিক যুগের
নাস্তিক্য ও ইহসর্বস্ববাদেও হিংসা ও অহিংসা মিশ্ররূপই চোখে পড়ে। তবু মাত্রা
ও গুণের পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। আধুনিক মন ধর্মান্ধতার বিপরীতে।
সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তুলনায় গণতান্ত্রিক কর্মধারা অহিংসাপন্থি, এই
তারতম্য উপেক্ষা করা ভুল।
হিংসা থেকে অহিংসার দিকে সমাজের অগ্রগতির
আরেকটি বড়ো উদাহরণ হচ্ছে বিচারব্যবস্থার প্রসার। প্রাচীন সমাজে ব্যক্তিগত ও
পারিবারিক প্রতিহংিসার ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেই প্রাচীন প্রতিহিংসাপরায়ণতা
মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য কোনো
মধ্যস্থ বা বিচারকের কাছে যাওয়াই আজ সভ্য পদ্ধতি বলে স্বীকৃত।
কলহনিষ্পত্তির অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পথ হিসেবেই বিচারশালা ও আইনের শাসন
সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্বীকার করা যাক, সংসদীয় গণতন্ত্র ও আইনের
শাসন অহিংস সমাজব্যবস্থার আদর্শ ও পরিপূর্ণ রূপ নয়। কিন্তু সমাজের ঐতিহাসিক
বিবর্তনে এসব উপেক্ষা করার মতো বস্তুও নয়। হিংসা ও অহিংসার শক্তির মধ্যে
যে একটা দ্ব›দ্ব চলছে, অহিংসার শক্তি যে হিংসাকে একটা সীমার মধ্যে বাঁধার
জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার উদাহরণ হিসেবে এদেরকে অগ্রাহ্য করা
যায় না। আমরা অনেক সময় এসবের মূল্য স্বীকার করতে বাধ্য হই। এসবের পিছনে
সমাজে যে একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, বহুলোকের চিন্তা ও আত্মত্যাগ আছে, সেকথা
মনে রেখে তবেই গণতন্ত্রকে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কিছু
পুরানো বিপ্লববাদীর একটা মিথ্যা স্বপ্ন ছিল, এখনও যার ছায়া ইতস্তত ঘুরে
বেড়ায়। এঁরা বিশ্বাস করতেন যে, সর্বহারার দল গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল
করে নেওয়াটাই বিপ্লবীর পক্ষে সবচেয়ে জরুরি কাজ, ওই পথেই আদর্শ সমাজে
পৌঁছনো যাবে। অন্তত শেষ বয়সে মার্কস ও এঙ্গেলস কিন্তু এরকম বিশ্বাস করতেন
বলে মনে হয় না। গত শতাব্দীর শেষ দিকে এঙ্গেলস পরিষ্কারভাবেই বলেছিলেন যে
ওটা আর পথ নয়, অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তবু যে ওই স্বপ্নটা টিকে গেল তার
একটা বড়ো কারণ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবী ইতিহাস থেকেই
কিন্তু দুয়েকটি কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিপ্লবী দলের পক্ষে হিংসাত্মক সংগ্রামে
এ যুগে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব একটা বিশেষ অবস্থায়, যখন একটা দেশ দীর্ঘ
যুদ্ধ অথবা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, সাময়িকভাবে একটা নৈরাজ্যের অবস্থা
এসেছে। বিপ্লবকে যদি ওইরকম একটা অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে হয় তবে সেটা
আশাপ্রদ ব্যাপার নয় বরং দুঃখজনক। বাংলাদেশে ওই অবস্থা নেই। আর ওই অবস্থার
ভিতর থেকে বামপন্থি ‘মৌলবাদী’ বা প্রতিক্রিয়াশীল দলের পক্ষেও ওটা সুবর্ণ
সুযোগ, অথবা চরম অস্থিরতার ভিতর দিয়ে দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে।
আরও
একটা কথা আছে। বিপ্লবী দলের পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা এক জিনিস,
আদর্শ সমাজের লক্ষ্যে পৌঁছানো একেবারেই অন্য জিনিস। রুশবিপ্লবের উদাহরণ
থেকে এ কথাটাই স্পষ্ট। হিংসার পথে যে দল ক্ষমতায় আসে, হিংসার পথেই তাকে
ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে হয়। এই সন্দেহ দলের মন থেকে কিছুতেই দূর
হতে চায় না যে, যেভাবে সে ক্ষমতায় এসেছে সেভাবেই অন্য কোনো “প্রতিক্রিয়াশীল
চক্র” তাকে একদিন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এই সন্দেহের বশে ক্ষমতাসীন
বিপ্লবী নেতা ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, আর গুপ্ত পুলিশ,
সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের নিষ্পেষক যন্ত্রকে আত্মরক্ষার জন্য আঁকড়ে ধরে
থাকেন। আবারও স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত ধরে গড়ে ওঠে লুণ্ঠনধর্মী
অর্থনীতি। আদর্শ সমাজ স্থাপনের পথ ওটা নয়। আগামী কালের জন্য এটাই
রুশবিপ্লবের বড়ো শিক্ষা।
আসলে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে এক
বৈপ্লবিক উল্লম্ফনে আদর্শ সমাজের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কল্পনাটাই
প্রতারক। আজাকের বিপ্লবীকে ওই প্রতারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।
বর্তমান ব্যবস্থাকে হঠাৎ ভেঙেচুরে আদর্শ সমাজের ভিত্তি তৈরি করা যাবে না।
বর্তমান ব্যবস্থার ভিতর থেকেই বিকল্প সমাজ গঠনের কাজ শুরু করে দিতে হবে।
এটা অনেকের কাছে তেমন আকর্ষণীয় কাজ বলে মনে হয় না। কিন্তু অন্য পথ নেই।
রাষ্ট্রকে
সামরিকতার পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য জনমত গঠন করা একটা বড়ো কাজ। কোনো দেশের
পক্ষে এককভাবে এই পথে বেশিদূর এগোনো কঠিন। কাজেই শান্তি আন্দোলনের কোনো
জাতীয় সীমারেখা নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভিতর শান্তির জন্য সমঝোতা চাই।
ইউরোপ আজ চাইছে একটা শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর বিভিন্ন সদস্য
রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ভারতীয় উপমহাদেশেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য
এটাই হবে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা। এটাকে অনেকে আজ অবাস্তব কল্পনা বলে মনে
করেন। কিন্তু এছাড়া আমাদের সমস্যার কোনো বাস্তব সমাধান নেই। ভারত ও
পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ক্রমাগত পাঁয়তারা কষে শুধু সর্বনাশের
দিকেই এগিয়ে যেতে পারবে। এই উপমহাদেশে ধ্বংসের বিকল্প ঐক্য, অর্থাৎ একাধিক
স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের শিথিল সমাবেশ, যেটা সম্ভব হতে পারে শুধু গণতান্ত্রিক
সহিষ্ণু শান্তি আন্দোলনের পথে।
শান্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে সময় লাগবে।
আর্থিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনও হঠাৎ ঘটবে না। ইতোমধ্যে এদেশে বিরাজ করবে
পাশাপাশি দুই অর্থনীতি। এক অর্থনীতির যোগ থাকবে সামরিক অস্ত্রসম্ভার, বৃহৎ
শিল্প ও সেইসব বিলাসদ্রব্যের সঙ্গে আধুনিক জীবনে যেসব সভ্যতার অপরিহার্য
অঙ্গ হিসেবে সমাদর পাচ্ছে। দেশ যতদিন ভোগবাদকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত হচ্ছে
না ততদিন বিশ্বের বাজারের সঙ্গে যোগ রাখার নীতিও ত্যাগ করা যাবে না।
এরই
পাশাপাশি অন্য এক অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করে যেতে হবে। একটা কথা আমাদের
পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জন্য
কর্মসংস্থান করা যাবে না বৃহৎ শিল্পে। আধুনিক প্রযুক্তিতে শ্রমের চাহিদা
কম, মূলধনের প্রয়োজন বেশি। শিল্পে অনুন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা দ্রæত বেড়ে
চলেছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। তৃতীয় বিশ্বের উদবৃত্ত মানুষ
শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশে ঢুকে পড়তে চাইছে, সেখানে বেড়ে উঠছে ‘দক্ষিণপন্থি’
প্রতিরোধ। তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। এটা উদ্ধারের পথ নয়। অতএব চাই বৃহৎ
শিল্পের আশেপাশেই অন্য এক অর্থনীতি। একে কেউ বলেছেন গ্রামীণ অর্থনীতি। কেউ
বলেছে সামবায়িক অর্থনীতির কথা। আমরা বলব সাবেকি ভাষায় স্বদেশি অর্থনীতি
কিংবা সামন্য ‘বৈজ্ঞানিক’ ভাষায় পরিবেশমুখী বা প্রতিবেশ নির্ভর অর্থনীতি।
এখানে প্রতিবেশ বলতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবিক প্রতিবেশ দুয়ের কথাই ভাবা
হচ্ছে। আসলে এইসব ভিন্ন ভিন্ন নামকরণের ভিতর দিয়ে বিকল্প অর্থনীতির বিভিন্ন
দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই উদ্দেশ্য।
গ্রামীণ অথবা
প্রতিবেশনির্ভর অর্থনীতিতে উৎপাদন হবে যথাসম্ভব স্থানীয় উপকরণ নিয়ে স্থানীয়
মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। প্রধানত নিকট প্রতিবেশকে ভিত্তি করে পরিবার
ও প্রতিবেশীর জণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা, এই অর্থে এটাকে বলা যাচ্ছে
প্রতিবেশনির্ভর ও স্বনির্ভর অর্থনীতি। এখানে জোর পড়ছে স্বয়ম্ভরতার ওপর।
ইদানীং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলে চলেছেন বাজার বর্জনের কথা। ‘আধুনিক’
অর্থনীতিতে এটা মোটেই সম্ভব নয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও পুরোপুরি সম্ভব নয়,
কিন্তু অনেকটা সম্ভব।
এটা যে সেখানে অনেকটাই সম্ভব একথা আমরা ভুলে যাই
কারণ আমাদের মন পড়ে থাকে শহরের দিকে। গ্রামে, আদর্শ গ্রামেও সাধারণ মানুষের
প্রয়োজনের ভিতর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি এইসবই
প্রধান। গ্রামীণ বাসস্থান স্থানীয় শ্রম ও উপকরণ দিয়েই তৈরি হয়, বাজারে
বেচাকেনার জন্য হয় না হওয়া প্রয়োজনও নয়। স্বদেশি বস্ত্র অথবা খাদি নিয়ে
অনেক আলোচনা হয়েছে। প্রশ্নটা প্রধানত রুচি নিয়ে। শুধু আইন আর ভরতুকির ওপর
নির্ভর করলে চলবে না। পল্লিসংগঠনের সামগ্রিক চিন্তার মধ্যেই ওটাকে স্থান
করে নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বা কৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা পুরোপুরি না
হলেও অনেকটা সম্ভব। গত কয়েক দশকে রাসায়নিক সার কীটনাশক ওষুধ এই সবের ওপর
জোর পড়েছে, সেসবের জন্য বাজারে যেতে হয়। কিন্তু এখন বিকল্প প্রাকৃতিক চাষের
কথা অনেকেই বলছেন। রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভর করে যে আধুনিক চাষ আমরা
গ্রহণ করেছি তার নানা দোষ আছে, তা থেকে অনেকটাই সরে আসা সম্ভব ও আবশ্যক।
‘প্রাকৃতিক চাষ’ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা’ আশা করা যায় ভবিষ্যতে বাড়বে।
এইসবের
সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকল্প কথা। গ্রামীণ অর্থনীতি মানে বিজ্ঞানের সঙ্গে
সম্পর্কচ্ছেদ নয়। বিকল্প প্রযুক্তির জন্যও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন আছে।
ধরা যাক পায়খানা বা শৌচালয়ের কথা। এখন বিজ্ঞানসম্মত সুলভ শৌচালয় নিয়ে অনেকে
চিন্তা করছেন। এর ফলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়বে, পল্লির পরিবেশ আরও
স্বাস্থ্যকর হবে, মানুষের বর্জ্যপদার্থ মাটির উর্বরতা বাড়ানোর কাজে নিযুক্ত
হবে নিয়মিতভাবে, গ্রামের যে মানুষগুলোকে আমরা নোংরা কাজের সঙ্গে যুক্ত করে
অস্পৃশ্য বানিয়ে রেখেছি তরা ক্রমে ক্রমে মানুষের অধিকার পাবে। শৌচালয়
উদাহরণ মাত্র। রন্ধনশালা অথবা তেজঃশক্তির বিকল্প উৎসবের ব্যবস্থাকেও উদাহরণ
হিসেবে ধরা সম্ভব। অথবা ধরা যাক স্বাস্থ্যের কথা। আমরা বড়ো বেশি বিদেশি
বাজারের ওষুধের ওপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। স্বাস্থ্যের জন্য প্রথম ও
প্রধান প্রয়োজন পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও বিষমুক্ত রাখা। গ্রামের প্রধান
প্রধান রোগে স্থানীয় গাছগাছড়া থেকে নিরাময়ের সহজলভ্য উপায়ের দিকে আরও বেশি
মনোযোগ দেওয়া উচিত। অকেন ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিকিৎসাতেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
এইসবের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অর্থাৎ বিজ্ঞানমনস্কতা
প্রয়োজন।
নাগরিক রাজনীতি রাষ্ট্রমুখী। গ্রামীণ অর্তনীতির পরিপূরক হবে
গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন। এদেশে পঞ্চায়েতীরাজ নিয়ে সম্প্রতি অনেক কথা হয়েছে।
সেই আলোচনায় বেশি দূর প্রবেশ করব না। তবু দুয়েকটি কথা বলা দরকার। সংসদীয়
গণতন্ত্রের এক প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে দলীয় রাজনীতি। দলের ভিতর দিয়েই
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে, ক্ষমতা কেন্দ্রীভ‚ত হয়। আমরা যে বিকল্প
সমাজের কথা ভাবছি সেখানে গ্রামই হবে ক্ষমতার স্থম্ভ। দলীয় রাজনীতিকে সেখানে
প্রধান্য দিলে সেই দলের ভিতর দিয়ে ফিরে আসবে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়তা। গ্রামের
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, সেখানে সেই নগরের নামহীন মানুষের ভিড়, আছে এক
প্রতিবেশী সমাজ। এখানেও উচ্চ নীচ ভেদ আছে, স্বার্থের দ্ব›দ্ব আছে। আর এইসব
দূর করতে না পারলে আদর্শ সমাজ গঠন করাও যাবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যাকে
বলেছেন পল্লিসংগঠন, সেই কাজের জন্য যদি আমরা দলীয় রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল
হয়ে যাই তবে একরকমের ভেদ ও দ্ব›দ্ব দূর করতে গিয়ে আমরা অন্য একরকমের ভেদ ও
দ্ব›েদ্বর ভিত্তি তৈরি করব। এই বিপদটাকে পরিষ্কারভাবে মনে রাখা দরকার।
রাষ্ট্রপ্রধান
সমাজে জোর পড়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতির’র ওপর। এটাকে সঠিক নীতি বলে মেনে নেওয়া
যায় না। নগরে ছড়াচ্ছে অন্য এক শিক্ষা, বিদেশি চালটাই সেখানে প্রধান। এটাও
সমর্থযোগ্য নয়। শিক্ষার জন্য চাই একদিকে একটা স্থানীয় ভিত্তি, অন্যদিকে
বিশ্বমুখিতা। স্থানীয় বলতে প্রতিবেশী পরিবেশকে বুঝতে হবে। সুস্থ-স্বাভাবিক
শিক্ষা এইখানেই শুরু হওয়া দরকার। আবার এইখানে দাঁড়িয়ে তাকে বিশ্বমুখী হতে
হবে, নয়তো সে অসম্পূর্ণ।
শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতির প্রশ্ন। নতুন
সমাজের জন্য নতুন সংস্কৃতি চাই। তা নইলে সবই ব্যর্থ। এই শতাব্দীতে নতুন
সমাজ নিয়ে ‘বৈপ্লবিক’ পরীক্ষানিরীক্ষার এটাই বোধকরি মূল শিক্ষা। চীনের নেতা
মাও শেষ বয়সে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে হয় তো মানুষ
বড়ো বেশি অধীর হয়ে ওঠে। ধৈর্যহীনতায় চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব পথভ্রষ্ট হলো।
তবু মাওয়ের উপলব্ধিতে কিছু সত্য বস্তু ছিল, সেটা উপেক্ষণীয় নয়। শেষ করার
আগে নতুন সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুধু দুটি কথা সংক্ষেপে বলব। অর্তনীতি ও
রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে কথাগুলো বুঝতে হবে। আমাদের পুরানো সংস্কৃতিতে,
সংস্কারে, অভ্যাসে লুণ্ঠনধর্মী অর্থনীতির ছাপ থেকে গেছে সুস্পষ্ট। সেই সব
মুছে ফেলা সহজ নয়, আমরা সবসময় সচেতনও নই। প্রথমে সচেতন হওয়া দরকার। পুরানো
সংস্কৃতিতে প্রভুত্ব আর মালিকানার বোধ প্রবল। পুরুষ প্রভু, নারী তার অধীন।
মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্কটাও ওইভাবেই ভাব হয়েছে এক নির্দয় পৌরুষের
দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব স্থাপনেই মানুষের গৌরব।
লুণ্ঠনধর্মী অর্থনীতিতে মানুষ লুণ্ঠন করেছে শুধু অপর মানুষকেই নয়, লুণ্ঠিত
হয়েছে প্রকৃতিও। যে প্রকৃতিকে মানুষ আদিমকালে ভয় করত, আধুনিক যুগের দ্বারে
দাঁড়িয়ে তাকে সে দাসে পরিণত করতে উৎসাহী হয়ে উঠল বিজ্ঞানের জোরে। দাসের
কাছে থেকে যেমন আমরা সখ্য চাই না, আত্মার প্রসার চাই, চাই শুধু অধীনতা আর
দৈহিক সেবা, নতুন প্রযুক্তির অহংকারে লুণ্ঠিত প্রকৃতির কাছ থেকেও আমরা সেই
রকমই চাইতে লাগলাম একান্ত দাসত্ব, ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি। তৈরি হলো ‘জড়’
প্রকৃতিতে পীড়ন করে আধুনিক ভোগবাদের ভিত্তি। এতে অবশেষে মানুষের ক্ষতিই
হয়েছে। দরিদ্র হয়েছে মানুষের চেতনা ও অনুভ‚তির জগৎ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
মানুষের পরিবেশ। নতুন সংস্কৃতিতে এদিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চাই।
এবার
আসছি শেষ কথায়। পুরানো রাজনীতিতে স্বার্থের দ্ব›েদ্বর ধারণাটা প্রাধান্য
পেয়েছে। দ্ব›দ্ব শ্রেণিতে শ্রেণিতে, জাতিতে জাতিতে। বিষয়টা পুনরায় বিচার
করে দেখা দরকার। দ্ব›দ্ব আছে ঠিকই। কিন্তু মানুষের স্বার্থের ঐক্যের কথাটা
কি কম গুরুত্বপূর্ণ? সভ্যতার সার্বিক সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে কী বলা যাবে?
যুদ্ধের অস্ত্র বিক্রি করে কিছু ব্যবসায়ী লাভবান হন বটে। কিন্তু এইরকম
লাভের নেশায় ছুটে, সন্তানের কাছ থেকে সুস্থ বিবেকের অধিকার কেড়ে নিয়ে, শেষ
পর্যন্ত কারও খুব একটা সুখবৃদ্ধি ঘটে একথা বলা কঠিন। যে কথাটা তুলনায় অনেক
স্পষ্ট তা হচ্ছে, মানুষের সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো প্রয়োজন, সব
মানুষেরই স্বার্থে। পরিবেশ দূষণের সমস্যাটাও এই রকমেরই। বায়ুমনÐল দূষিত হলে
তাতে বিপন্ন হবে সমগ্র মনুষ্যজাতি। পরিবেশ রক্ষার জন্য ছোটো বড়ো এমন অনেক
কাজ আছে, নগরে ও পল্লিতে, দেশে দেশে, যাতে উপকৃত হবে জাতি-সম্প্রদায়
নির্বিশেষে সব মানুষই। নতুন সংস্কৃতিতে, সমাজসংগঠনের কাজেকর্মে ও ভবিষ্যতের
রাজনীতিতে মানুষের স্বার্থের ঐক্যবোধ স্বীকৃতি না পেলে বিকল্প সমাজ গড়ে
তোলা যাবে না।
ঐক্য আছে দ্ব›দ্বকে ধারণ করেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে
সংগ্রাম চলবে, যথাসম্ভব অহিংস উপায়ে। সেইসঙ্গে পল্লি থেকে বিশ্ব অবধি
সর্বত্র মানুষের ঐক্যর সত্যের সপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া আগামী দিতে প্রত্যেক
বিবেকবান মানুষেরই কর্তব্য।
সংকটকে অস্বীকার না করেও মানুষ নিশ্চেষ্ট
থাকতে পারে। বিকল্প নেই এই রকম এটা বোধে সে আচ্ছন্ন হতে পারে। বন্ধনকে
আঁকড়ে ধরেই সে বন্ধনের যন্ত্রণাকে সহনীয় এমনকি রমণীয় ভাবতে পারে। এই
সর্বাত্মক নৈরাশ্যের দর্শনকে অতিক্রম করার জন্যই চাই বিকল্প জীবনের ভাবনা ও
সাধনা। ক্ষমতায় মত্ত মানুষ-আর ধ্বংসের সাধনায় উন্মত্ত সন্ত্রাসবাদী উভয়েই
মুক্তি খুঁজছে ভ্রান্তপথে। ক্ষমতা মানুষকে মুক্তির স্বাদ এনে দেয় না,
সন্ত্রাস মুক্তির দুয়ার খুলে দেয় না। মুক্তি আসে বিদ্বেষহীন প্রতিবাদের
সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাম্য ও মিলনের পথে। মানুষকে সেই পথই খুঁজে নিতে হবে। এই
সাধনা মানুষের সাধ্যাতীত নয়। আশা রক্ষা করে চলতে হবে সমাজ ও সংস্কৃতির
সন্ধানে।
