
সুরশিল্পী শচীন দেববর্মণ
১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের উত্তর চর্থা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
আমরা তাঁর জন্মভিটায় প্রতিবছর তাঁকে উপলক্ষ্য করে স্মরণোৎসব করে থাকি। বলে
রাখি ১৯৭৫ সালে ৩১ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাই প্রতি বছর অক্টোবর মাস
কুমিল্লায় শুধুমাত্র শচীনকর্তার স্মরণোৎসব মাস। তার পিতার নাম নবদ্বীপ
চন্দ্র দেববর্মণ। মাতা রাণী নিরুপমা দেবী। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে শচীন
দেববর্মণ কনিষ্ঠ।
শচীন দেববর্মণের আদি পরিচয় হলো তিনি ত্রিপুরার
রাজবংশের সন্তান। পারিবারিক কলহে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ স্বেচ্ছায়
প্রায় চল্লিশ বছর কুমিল্লা শহরে নির্বাসনে ছিলেন।
১৯০৯ সালে
ভ্রাতুস্পুত্র রাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্যের সাদর আমন্ত্রণে ত্রিপুরার
রাজমন্ত্রী হিসেবে নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন। চল্লিশ
বছর পর পুনরায় ত্রিপুরায় রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কের অনেকটা উন্নতি হয়।
শচীনকর্তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক
১৯১৫
সালে পঞ্চম শ্রেণিতে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯২০ সালে কুমিল্লা
জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তখন তাঁর বয়স ১৪ বছর। ১৯২১ সালে
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আই,এ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২২ সালে এই কলেজ থেকে
আই,এ পাশ করেন।
১৯২৩ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএ ভর্তি হন। ১৯২৪ এ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
উচ্চ
শিক্ষা গ্রহণর জন্য পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ শচীন দেববর্মণকে কলকাতা
নিয়ে যান। কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরজি বিষয়ে এমএ ভর্তি করে দেন। শচীনকর্তা
আর পড়াশোনা না করে সঙ্গীত জগতে আত্মনিয়োগ করেন।
শচীনকর্তার জীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর। তবে সব মিলিয়ে সঙ্গীতচর্চা ও গানের জগতে রাজপুত্র। এক বিশাল মুগ্ধকর কাহিনি।
এখানে কয়েকজন সমকালীন সঙ্গীতজ্ঞদের মন্তব্য তুলে ধরছি অতি সংক্ষেপে-
১. রাই চাঁদ বড়াল। ১৯০৩ সালে কলকাতায় জন্ম। তাঁর মন্তব্য:
‘শচীনকর্তার
গান প্রথম শুনেছিলেন বোধ হয় কলকাতা বেতার কেন্দ্র। গান শুনে অবাক
হয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি তার গলায় সুরের বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত
হয়েছিলাম। তিনি একটি গানের কথা উল্লেখ করেছেন-
‘ কে যেন কাঁদিছে আকাশ ভুবনময়,
হায় ধরণীর লাঞ্ছিতা মেয়ে, এ কি তোর পরাজয়।’
বলেছেন-
আজ, এতদিন পরেও যখন শুনি তখন তন্ময় হয়ে ভাবি-
‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী
আমি অবাক হয়ে শুনি।’
২. ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ১৯০৯ সালে হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছাকাছি সরাই গ্রামে জন্ম।
তাঁর মন্তব্য:
‘শচীন
আমার কাছে এবং গুরু বাদল খাঁর কাছে বেশ কিছুদিন তালিম নিয়েছিল। তালিম
নেবার সময় তার নিষ্ঠা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গীত সাধনা করে গেছে।’
‘আমাকে সে চিরদিনই গুরু হিসেবে সম্মান করেছে।....জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত সে আমাকে গুরু বলে স্বীকৃতি দিয়ে গেছে।’
৩. নারায়ণ চৌধুরী-১৯২২ সালে কুমিল্লায় জন্ম।
তাঁর মন্তব্য:
‘শচীনদেব
কিন্তু প্রথম বয়সে গাইয়ে ছিলেন না। বাঁশী বাজিয়ে হিসেবেই তাঁর সমধিক
পরিচিতি ছিল। অবশ্য ‘আর বাঁশী’ নয়, ‘টিপরাই বাঁশী’। যা ত্রিপুরারই নিজস্ব
উদ্ভাবন ও এক বিশিষ্ট সম্পদ। তবলাতে হাত ছিল চমৎকার। পরে কলকাতায় কলেজে
পড়াকালে অনুরাগের ক্ষেত্র বদল করেন- বাঁশী থেকে কন্ঠ সঙ্গীতে চলে আসেন।’
প্রশ্ন ও উত্তর-
‘শচীনদেব
মুখ্যত ত্রিপুরার আকাশে-বাতাসে সঞ্চরমাণ তথা পূর্ববঙ্গের জল-হাওয়ার সঙ্গে
অবিমিশ্রভাবে যুক্ত ভাটিয়ালির ঐতিহ্যের সবচেয়ে বিশ^স্ত প্রতিনিধিস্থানীয়
গায়ক হলেও কেমন করে রাগসঙ্গীতেও প্রায় সমান দরের কুশলতা অর্জন করলেন ?’
উত্তর হলো-
‘ভারতীয়
সঙ্গীতের দুই আসল মৌলিক সুররূপ হলো রাগসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত। বাদবাকী সব
সঙ্গীত হলো মিশ্র সঙ্গীতের দৃষ্টান্ত, সেসব খাঁটি সঙ্গীত নয়। শচীন দেবের
কন্ঠে রাগসঙ্গীত আর লোকসঙ্গীতের সার্থক যুগ্ম মিলন সাধিত হয়েছিল।
একবার
শচীনদেব নারায়ণ চৌধুরীকে বলেছিলেন-‘ ভাই নারান, তোমরা যে শচীন কর্তাকে
জানতে, সেই শচীনকর্তার মৃত্যু ঘটেছে। বম্বের ছবির জগতে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি
টাকা হয়েছে ঠিক, কিন্তু যে কন্ঠশিল্পী শচীনকর্তাকে নিয়ে তোমরা গর্ব করতে
তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।’
শেষজীবনে কলকাতায় আসবার জন্য কতটা আগ্রহী ছিলেন, এ নিয়ে তাঁর আন্তরিক ইচ্ছা-
‘আজ
যদি কেউ আমাকে কলকাতা থেকে প্রস্তাব করে পাঠাতো, ‘তোমাকে পাঁচশো টাকা করে
মাসোহারা দেব, তুমি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসো, আমি তন্মুহূর্তে
বোম্বাইয়ের তল্পীতল্পা গুটিয়ে কলকাতা চলে আসতুম-আবার সেই পুরনো দিনের মত
গানে গানে মেতে উঠতুম। গায়ক শচীনদেবের পাশে সিনেমার মিউজিক ডাইরেক্টর
‘এস,ডি,বর্মন’ কিছু নয়, কেউ নয়।’
মন্তব্য: ‘একেবারে খাঁটি শিল্পীর মত কথা। সরল, অকপট, নিরাভিমান এক শিল্পী।’
৪.
সুরেশ চক্রবর্তী: ১৯১৪ সালে কুমিল্লায় জন্ম, বিশিষ্ট সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও
গায়ক ছিলেন। তিনি শচীনকর্তার অহমিকাহীন সাধারণ জীবনযাপনের বর্ণনা দিয়েছেন
এভাবে-
‘কর্তা (তখন) একটা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছিলেন।
আমি তাঁর সঙ্গ বহুদিন করেছি। কিন্তু রাজপুত্র সুলভ অহমিকা বা
পোশাক-পারিপাট্য কখনো দেখিনি- সাধারণ বাঙালি ভদ্রলোকের বেশেই থাকতেন,
ফরমালিটির বালাই (তখন) ছিল না।’
রাজপুত্র হয়েও বাঙালিয়ানা ছিল তাঁর আচরণে কথাবার্তায়-গানে এবং জীবনযাপনে।
৫. রাজ্যেশ^র মিত্র: ১৯১৭ সালে আগরতলায় জন্ম।
তিনি লিখেছেন-
‘ শচীন দেববর্মণ বলতে গেলে কুমিল্লাতেই মানুষ। সেখানে তিনি সঙ্গীত চর্চা করেছেন।....
আগরতলায়
এলে তিনি কথা বলতেন খুব কম, স্বভাবতই খুব গম্ভীর ছিলেন। দেখতে ছিলেন ঠিক
তাঁর পিতা নবদ্বীপচন্দ্র বাহাদুরের মত। আগরতলায় স্বয়ং মহারাজের পরেই ছিল
তাঁর মর্যাদা।....
কুমার শচীন দেববর্মণ ক্রীড়াজগতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি
প্রথম জীবনে খুব ভাল টেনিস খেলতেন, কিন্তু শারীরিক কারণে এই খেলাটি ছেড়ে
দিতে হয়। তিনি ফুটবল খেলার উত্তম রেফারী ছিলেন।’
৬. সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়: ১৯৩১ সালে কলকাতায় জন্ম।
তিনি একটি স্মৃতির কথা লিখেছেন।-
‘আমি
‘দৃষ্টি’ ছবির ‘বলে কুহু কুহু কোয়েলা’ গানটা করলাম, শুরুতে পাপিয়ার ডাকের
মতো ক্রমেটিক নোটসের একটা ব্যাপার ছিল। কোমল ও শুদ্ধ স্বরে যাব। ওটা মাত্র
কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তারপরেই মূল গানটা শুরু। পরে নচিদাই (নচিকেতা ঘোষ,
সুরকার) আমাকে বলেছিলেন, যেই না পাপিয়ার ডাক ধরেছি শচীনদা ‘গেল গিয়া’ ‘গেল
গিয়া’ বলে হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ...আসলে ওটা ভীষণ শক্ত। শচীনদার শঙ্কিত
হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ ছিল। নচিদা হাসতে হাসতে বললেন, সন্ধ্যা তুমি তো ওই
নোটস ধরলে, ওদিকে শচীনদা ‘গেল গিয়া’ ‘গেল গিয়া’ করতে লাগলেন। তুমি জায়গটা
নিখুঁত করতে পেরেছ দেখে শচীনদার মুখ আবার প্রশান্ত হয়ে ওঠে।’
৭. পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৯৩১ সালে কলকাতায় জন্ম।
তিনি লিখেছেন-
‘জ্ঞান
হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেইে তখন কলের গানে ঘরে ঘরেই একটি গান বাজতে শুনতাম।
ব্যতিক্রমী কন্ঠস্বরে একটি পল্লীগীতি ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহনে-’ যতদূর জানি
এটাই কুমার শচীন দেববর্মণের প্রথম রেকর্ড এবং প্রথম রেকর্ডটিই সুপারহিট।’
শচীনকর্তা,
শচীনদেব দেববর্মণ যে কত বড় সুরশিল্পী ছিলেন, আজও কুমিল্লাবাসী সেভাবে ধারণ
করতে পারিনি। এটা আমাদের দীনতা। আমরা অর্থাৎ কুমিল্লাবাসী প্রশাসনের উপর
নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তাঁরা আসেন স্বল্পদিনের জন্য। উদ্যোগ নিতে হবে
কুমিল্লাবাসীকে, প্রশাসন সহযোগিতা করবে সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশনায়।
আমাদের আবেগটি অবশ্যই সরকার-প্রশাসন মূল্য দিতে হবে। কবিতায় আছে-
‘আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে।’
আমাদের
নিজের অবস্থান থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে জাগতে হবে। বলি-আসুন, এগিয়ে আসুন দলমত
নির্বিশেষে সর্বপ্রকার অঙ্গীকার নিয়ে, অহমিকা ত্যাগ করে। ‘দশে মিলি করি
কাজ’- আমরা পারব। পারতে যে হবে।