
দুই
বছর ধরে লাগাতার হামলার পর প্রায় ৬৮ হাজার মানুষকে হত্যা ও দুই লাখের
কাছাকাছি মানুষকে পঙ্গু করে যে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তার
সঠিক নাম হওয়া উচিত ‘গাজায় গণহত্যা বিরতি’। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যে হামাস
সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এই সংঘাতের স‚ত্রপাত ঘটায়, সেই হামাস এখনও গাজায়
যথেষ্ট প্রভাবশালী। অথচ তাদের নির্ম‚ল করার নামেই এই গণহত্যা পরিচালনা
করেছে নেতানিয়াহুর ইসরায়েল।
হামাসের আটক করা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত
করার নামে এই অভিযান পরিচালিত হলেও জিম্মিদের মুক্তি কখনোই নেতানিয়াহুর
লক্ষ্য ছিল না-জিম্মিরা ছিল গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত গণহত্যা চালানোর একটা
ভালো অজুহাত, যে অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের হামলাতেই হামাসের
কাছে জিম্মি ইসরায়েলিরা প্রাণ হারিয়েছেন।
গত দুই বছরে গাজায় কোনো যুদ্ধ
হয়নি; যা হয়েছে তা পরিকল্পিত গণহত্যা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঘোষিত লক্ষ্যই
ছিল গাজাকে পাথরযুগে ফিরিয়ে নেওয়া।
অথচ সেই প্রক্রিয়ার শেষে একে বলা
হচ্ছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি, প্রকৃতপক্ষে যেটি গণগহত্যাবিরতি চুক্তি এবং
গণহত্যাকে বৈধকরণের জন্য সম্পাদিত।
পাথর ছাড়া গাজায় এখন আর কিছুই
অবশিষ্ট নেই। গাজার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া
হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ ভবন। ইসরায়েলের হামলায় উদ্বাস্তু হওয়া
গাজার যেসব মানুষ ফিরে আসছে নিজের বাড়িতে, তারা তাদের ঘর আর খুঁজে পাচ্ছে
না-কোথায় ছিল, সেটাও বোঝা বুঝতে পারছে না, কারণ চারপাশ এখন শুধু
ধ্বংসস্ত‚প। নিজেদের বাসভ‚মিতেই এখন শরণার্থীর জীবন যাপন করছে তাদের জন্য।
তবু এই বিপর্যয়ের মধ্যেও গাজার মানুষ কিছুটা স্বস্তি খুঁজে নিচ্ছে, কারণ
অন্তত প্রতিদিন বোমায় ও ক্ষুধায় মারা যাওয়ার ভয় থেকে একটু হলেও রেহাই
মিলেছে।
কিন্তু যুদ্ধবিরতি চুক্তিটা করল কে? গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক
যুদ্ধাপরাধী-যার মাথার ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে,
সেই নেতানিয়াহু। আর কৃতিত্ব নিতে এগিয়ে এসেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প, যিনি বছরের
শুরুতেই চাইলে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পারতেন। পারতেন তার প‚র্বস‚রি
বাইডেনও, কিন্তু করেননি।
ইউরোপীয় নেতারাও কেবল মুখে গণহত্যার সমালোচনা
করেছেন এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতায় সমর্থন জানানোর নাটকীয় প্রদর্শনী
করেছেন, অথচ ইসরায়েলকে দেওয়া সব সামরিক ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন।
গাজার শিশুদের জীবন নিয়ে নয়, পৃথিবীর সামরিক পরাশক্তি ইসরায়েলের নিরাপত্তা
নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন তারা!
তবে ইসরায়েল সীমা লঙ্ঘন করতে করতে যখন
ট্রাম্পের বন্ধু রাষ্ট্র কাতারে হামলা করে বসল, তা আর কেউ মেনে নিতে পারল
না। নেতানিয়াহুকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল-এবার থামতে হবে। তবে বেশি কিছু
না, কেবল বোমা ফেলাটা বন্ধ করলেই হবে; তাছাড়া ট্রাম্পের নোবেল শান্তি
পুরস্কারের আশাটাও ভেস্তে দেওয়া যাবে না।
এবার ট্রাম্প নিজে পুরস্কার
পাননি-তাতে কী; ভেনেজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদো নিজের পাওয়া শান্তি
পুরস্কারটি ট্রাম্পকে উৎসর্গ করেছেন, যার অর্ধেক নেতানিয়াহুরও প্রাপ্য।
কারণ এই ‘শান্তিবাদী’ মহিলা এ দুজনকেই আহ্বান করেছিলেন তার মাতৃভ‚মি
ভেনেজুয়েলা আক্রমণ করতে; তিনি গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যারও সমর্থক।
অর্থাৎ
নোবেল কমিটি দিল না দিল-মহাউদার মাচাদো নিজের শান্তি পুরস্কারটি ট্রাম্পকে
দিয়ে দিয়েছেন। গাজায় এই যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখতে পারলে ভবিষ্যতে
ট্রাম্পেরও নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অসম্ভব নয়। মাচাদোর দেওয়া
পুরস্কারসহ তখন ট্রাম্প হবেন পরপর দুটি নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী।
২৯
সেপ্টেম্বর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে তার যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা উপস্থাপন করলেন
এবং নেতানিয়াহু তা সমর্থন করলেন। ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের বিচারের
কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। সুতরাং গত দুই বছরে গাজায় যেন কিছুই ঘটেনি—গণহত্যা,
ধ্বংস, বলির মিশ্রমাত্রাই চলেছে। গণহত্যাকে সমর্থনকারী একটি দেশের
প্রেসিডেন্ট যে শান্তির প্রস্তাব রাখল, গণহত্যার কারিগর তা গ্রহণ করল,
হামাস মেনে নিল-তাহলে কি চিরশান্তি নেমে আসবে গাজায়!
আর গাজা শাসনের
দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ট্রাম্পের ছত্রছায়ায় ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
টনি বেøয়ার, যে কুখ্যাত বেøয়ার আফগানিস্তান ও ইরাক হামলায় বুশের অন্যতম
সহযোগী। আফগানিস্তান ও ইরাক ধ্বংসের পর তার এবারকার মিশন ফিলিস্তিন।
গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনীতি বিশ্লেষক
ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস এ বিষয়ে ইনস্টাগ্রামে মন্তব্য করেছেন, “একদল
যুদ্ধাপরাধী আরেক যুদ্ধাপরাধীকে গাজার প্রধান হতে প্রস্তাব করছে। এ হবে
গুরুত্বপ‚র্ণ প্রহসন, বিয়োগান্তক না হলেও।”
দশ লাখ ইরাকি মানুষের রক্তের
দায় যার হাতে, সেই টনি বেøয়ারকে গাজা শাসনের দায়িত্বদেওয়ার প্রস্তাবে বহু
খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ এরকম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ট্রাম্পের
২০ দফা ফিলিস্তিন প্রস্তাবের সবই ইসরায়েলের অনুক‚লে। হামাস যদি তাদের হাতে
থাকা ইসরায়েলিদের মুক্ত করে, তাহলে ইসরায়েল তাদের কারাগার থেকে প্রথমে ২৫০
জন ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করবে এবং পরে আরও ১,৭০০ জনকে মুক্ত করবে যারা ৭
অক্টোবরের পর আটক হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ওই ২৫০ জনের মধ্যে যে ফিলিস্তিনি
নেতাকে ‘ফিলিস্তিনের নেলসন ম্যান্ডেলা’ বলা হয়-সেই মারওয়ান বারঘুতির
নামটিকে ইসরায়েল কেটে দিয়েছে। আর পরে মুক্তি পাওয়ার তালিকায় যে ১,৭০০ জন
রয়েছেন, তারা হলেন গাজায় কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক প্রমুখ।
ফিলিস্তিনি-কানাডিয়ান
আইনজীবী ও ইতিপ‚র্বে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের শান্তি চুক্তি আলোচনাকারী দলের
একজন সদস্য ডিয়ানা বুত্তু এই ৫ অক্টোবর গার্ডিয়ানে একটি লেখা প্রকাশ করেন
যার শিরোনাম: অ‘সধমরপ ঢ়রষষ’ সধফব ওংৎধবষরারড়ষবহপব রহারংরনষব. ডব হববফ ঃড়
ংঃড়ঢ় ংধিষষড়রিহম রঃ (একটা জাদুর বড়ি ইসরায়েলি সন্ত্রাসকে অদৃশ্য করে
রেখেছে, আমাদের এটা গেলা বন্ধ করতে হবে)। তিনি এখানে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক
পরিকল্পনাটিতে ন্য‚নতম নিশ্চয়তা নেই যে গাজায় কোনো সাহায্য পৌঁছাবে,
ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ শেষ হবে, ইসরায়েল চলে যাবে কিংবা গাজা পুনগর্ঠন হবে।
তার বদলে, যদি ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী না করে, তবে
আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের ও রাষ্ট্রগঠনের একটা উপায় অর্জন করতে পারি। কোনো
রাষ্ট্র নয়, একটা উপায় মাত্র। কী উদারতা!”
৩০ সেপ্টেম্বর, ডেমোক্রেসি
নাও-র এমি গুডম্যানের সঙ্গে আলোচনায় ডিয়ানা এই ট্রাম্প পরিকল্পনাটিকে
‘গণহত্যার নতুন প্যাকেটজাতকরণ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই
পরিকল্পনা কোনো আন্তর্জাতিক নজরদারির অনুপস্থিতিতে ইসরায়েল কর্তৃক
ফিলিস্তিনিদের হত্যা, নিয়ন্ত্রণ ও দখল-কোনো কিছুই বন্ধ করবে না। তিনি একে
বলেছেন, ‘একটি প্রহসন’, এমনকি ‘যারা শান্তিতে বিশ্বাস করে তাদের অপমান’
বলেও উল্লেখ করেন।
১০ অক্টোবর ডিয়ানা ডেমোক্রেসি নাও-এর সঙ্গে আলোচনায়
আবারও বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে ফিলিস্তিনিদের তাদের গণহত্যাকারীর
সঙ্গে চুক্তি করতে হচ্ছে। দুঃখজনক যে, তাদের দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটাতে
চুক্তি করতে হচ্ছে তাদেরই সঙ্গে-যারা এই দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছে। আরও দুঃখজনক
যে, ফিলিস্তিনিরা বাধ্য হচ্ছে এই চুক্তি স্বীকার করতে, যেখানে আন্তর্জাতিক
মহলের উদ্যোগে ইসরায়েলকে বাধ্য করা উচিত ছিল গণহত্যা বন্ধ করতে।”
তবু
তারা খুশি-কারণ অন্তত তাদের মাথার ওপর বোমা পড়া বন্ধ হয়েছে, ইসরায়েলি
সেনারা ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ বলছে না সেই ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির
কথা, যারা নির্যাতিত হয়ে, ক্ষুধায় ও ধর্ষিত হয়ে ইসরায়েলি কারাগারে ধুঁকে
ধুঁকে মরছে।
এমি গুডম্যানের পরের প্রশ্নের উত্তরে ডিয়ানা বলেন, “এটি
আসলে একটি ইসরায়েলি পরিকল্পনা, যা ট্রাম্প পরিকল্পনা নামে প্যাকেটজাত করা
হয়েছে। এই পরিকল্পনায় ট্রাম্প সবার সঙ্গে আলোচনা করেছেন-কেবল ফিলিস্তিনিদের
বাদ দিয়ে। এই পরিকল্পনায় সবাই ফিলিস্তিনিদের ‘সম্পর্কে’ কথা বলছে, কিন্তু
তাদের ‘সঙ্গে’ নয়।”
ডিয়ানার কথাগুলো অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশেষ করে
যখন ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি হাতে না দিয়ে টনি বেøয়ারের মতো
ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করা হচ্ছে তাদের ভাগ্য। তবু গাজায় মানুষের মাথার ওপর
যে কয়দিন বোমা বর্ষণ বন্ধ থাকবে ততদিনই তা পরম কাম্য; যেভাবেই হোক, তাই
হওয়া উচিত। কিন্তু জানা দরকার এই জাদুর বড়িতে যা আছে, তা দীর্ঘমেয়াদে
পশ্চিমা দখলদারিত্বম‚লক ঔপনিবেশিকতারই নতুন জায়নবাদী উপাদান।
লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ)।
