
খাল, নদী আর পলিমাটি নিয়েই আমাদের বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ মাটিতেই ব-দ্বীপ নামক বাংলাদেশের অস্তিত্ব। একসময় দেশে তেরশ নদী ছিল বলে মনে করত। ২০২৩ সালে জাতীয় নদীর রক্ষা কমিশন এক হাজার আটটি নদীর তালিকা প্রকাশ করে। এ বছর ১৪ই এপ্রিল ২০২৫ জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে একহাজার চারশ পনেরটি নদী আছে বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা বাড়ছে, তালিকায় বাড়লেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন ও বিপরীত। আসলে নদী কমছে। ১৫ বছর পেছনে খেয়াল করলে দেখা যায় বাংলাদেশ দূর্যোগ ফোরাম ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কি পরিমাণ নদী কমল তার একটি সমীক্ষা ২০১০ সালে প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে ১৫০ টি নদী শুকিয়ে গেছে। উত্তরণ একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ৪৩ টি নদী শুকিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সারা দেশে এ সংখ্যা যে অনেক বেশি তাতে কোন সন্দেহ নাই।
নদী কমলে কি সমস্যা? অনেক সমস্যা আছে। নদী মরলে একা মরে না। নদী মরলে নদী অববাহিকার জীববৈচিত্র, জনপদ, অর্থনীতি সবটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখনই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নৌপথে পণ্য পরিবহন অনেক সাশ্রয়ী। ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌপথ চলাচল বাড়লে পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় রেলপথের তুলনায় ৫৫% এবং সড়ক পথের তুলনায় প্রায় ৫৯% খরচ কমে, যা অর্থনীতি ও যানযটে ইতিবাচক প্রভাব ঘটায়, নদীর নাব্যতা না হারানোয় ভূমিকা রাখে। উজানের দেশ নেপালে, ভূটান, ভারত, চীন থেকে আসা নদীগুলো বাংলাদেশের প্রাণ। আন্তর্জাতিক সব নীতি লঙ্ঘন করে আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে বাঁধ দিয়েছে ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকে। আবার পানির প্রবাহ কম থাকলে নদীর তলদেশ সহজে ভরাট হয়ে যায়। ফলে শুধু নৌ যোগাযোগই ব্যাহত হচ্ছে না একই সাথে কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ, মৎস্য, পর্যটন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এর বাইরেও খনন, দূষণ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদির জন্য বাংলাদেশের নদীগুলো দিনের পর দিন মরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নদী সুরক্ষায় আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সংগঠনেরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের উৎসমুখ থেকে পাথরঘাটা পৌর এলাকার ভেতর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিষখালী জুড়ে এখন অসংখ্য অবৈধ খোঁটাজাল। দুপারের প্রভাবশালী অন্ততঃ ২০০ ব্যক্তি এ বিষখালীর বিভিন্ন অংশের মালিকানা দাবী করেন। এসব অংশের দাবিদার ব্যক্তিরা বছর জুড়ে জাল পেতে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি করে আর নৌ চলাচলের পথ বন্ধ করে রাখে বলে অভিযোগ স্থানীয় জেলেদের। জানা যায় প্রতিমাসে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জেলা, উপজেলায় প্রশাসনিক কমিটি রয়েছে। তারা সভা করে রিজুলেশন নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।
কুমিল্লায় নতুন গোমতীর পালপাড়া থেকে আমবাগান ও ময়নামতি অববাহিকায় অবাধে মাটি কেটে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে একসময়ের খর¯্রােতা গোমতী নদী। দু’পাশের বাঁধ লগ্ন ও চরের মাটি কেটে উঠানামা করছে অসংখ্য ট্রাক্টর। রাতদিন মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচলে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নদীর দুপাড়ের বাসিন্দারা। ধুলায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, নদীর ভেতরের মাটি কাটার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে প্রতিরক্ষা বাঁধ, সড়ক ও সেতু। শহর রক্ষার জন্য গোমতীর প্রবাহ বদলিয়ে নেয়ার কারণে টিক্কারচর থেকে কাপ্তানবাজার পর্যন্ত পুরাতন গোমাতী হয়ে আছে একটি হৃদ। এ হৃদের দু’পাড়ের প্রায় ২শ একর জমি ৫২২ জন অবৈধ দখলদার দখল করে আছে। বাড়ীর সেনিটারি পাইপ হৃদে খুলে দিয়ে বিষাক্ত করে ফেলেছে হৃদের পানি। ময়লা, আবর্জনা ও বাড়ীর উচ্ছিষ্ট পদার্থসমূহ ফেলে হৃদের জলারাশিও দখল করে ফেলছে। আস্ত হৃদটি গিলে ফেলার আশংকা আছে। পরিবেশবাদীরা মনে করেন পুরাতন গোমতী নামক হৃদটির দুপাড় দখলমুক্ত করে বৃক্ষরাজি ও ফুলবাগান সাজিয়ে দুপাড়ে দুটি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা যেতে পারে। সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে এ হৃদটি পরিচ্ছন্ন করা অতীব জরুরী এবং তাতেই পুরাতন গোমতী হয়ে উঠবে নগরীর ফুসফুস।
তুরাগ ও ধনেশ^রী নদী প্রতিদিন মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। এ দূষণে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রং হারিয়ে ফেলেছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাত হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নিজস্ব ইটিপি থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে নাই। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক নদীর পানিতে মিশ্রিত তরল বর্জ্যরে পরিমাণ ৮০ হাজার কিউবিক মিটার। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর ২৫৮ টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালী পয়ঃবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। তুরাগ নদের ২৬৯ টি, বালু নদের ১০৪ টি ও টঙ্গী খালের ৬২ টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য নিঃসরণ হচ্ছে। এছাড়া লোকলয় থেকে প্রতিদিন সৃষ্ট আবর্জনার পরিমান ৪৫ হাজার টন, যার ৮০ শতাংশ মিশছে নদীর পানিতে। বুড়িগঙ্গায় গড়ে দৈনিক পাঁচ হাজার নৌযান চলাচল করে। এসব যানবাহনের সব ধরনের বর্জ্যরে শেষ ঠিকানা বুড়িগঙ্গা। জাহাজ মেরামতের কারখানার বর্জ্যও এ নদীতে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করে নদী তীরে বনায়ন, সৌন্দর্য্য বর্ধন, সীমানা পিলার, পার্ক নির্মানের নামে বিপুল অর্থ লুটপাটের গল্প কথিত আছে। নদী বাঁচাতে অভিযান চালিয়েও আটকানো যাচ্ছে না দখলদারদের। নদীর জায়গায় কেউ বসতঘর, কেউ কারখানা, কেউ ধর্মীয় স্থাপনা বানিয়ে চালাচ্ছে দখলদারি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান ২০১৯ সালে এক রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন মাননীয় হাইকোর্ট। পুরো কর্মকান্ড সমন্বয়ের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলেছেন নদীরক্ষা কমিশন কার্যত অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।
স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে নদী সুরক্ষা কমিটি গঠনের মাধ্যমে নদীর পরিচর্যা করা যেতে পারে। নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নৌকাবাইচ, নদীকেন্দ্রিক নাটক, কবিতা, গান ইত্যাদি বিকাশের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে নদী সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। গবেষণা নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো নদীকে নিয়ে গবেষণা বাড়াতে পারে। এতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদীর সংকটগুলো উঠে আসতে পারে। নদীতে কোন রকম ময়লা না ফেলার অভ্যাস ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে Ñলিফলেট প্রচার, সংবাদ সম্মেলন, মিছিল, মিটিং প্রয়োজনে মানববন্ধন করা যেতে পারে। রাজনীতিবিদদেরও সচেতন হতে হবে প্রাণ-প্রকৃতি তথা নদী সুরক্ষায়। বিট্রিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি ১৯৮০সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ^ নদী দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে। পরবর্তীতে নদীর গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন দিবসটি পালন করতে শুরু করে। বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি, অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে নদী পরিচর্যার কোন বিকল্প নাই। আর নদীর প্রতি অবহেলা ও বিপর্যয় চলতেই থাকলে আমরা সব হারাব। ধূসর মরুপ্রান্তর নয় সবুজ-শ্যামলীমা, পরিশুদ্ধ বায়ুমন্ডল আর রূপালী মাছভর্তি সুনীল জলরাশির গতিশীল নদীই আমাদের কাম্য।
