বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০২৫
১৪ কার্তিক ১৪৩২
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আপনি ছিলেন থাকবেন
স্বকৃত নোমান
প্রকাশ: রোববার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম আপডেট: ১২.১০.২০২৫ ১:২৮ এএম |

  সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আপনি ছিলেন থাকবেন
জ্যেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে যাঁদের অপত্য স্নেহ পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন। সেই পনেরো বছর আগে, সাহিত্যের অন্ধিসন্ধি খুঁজে বেড়ানোর দিনগুলোতে একদিন গিয়েছিলাম তাঁর কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অফিসে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা ভাষার উপন্যাসগুলো সম্পর্কে। জিজ্ঞেস করেছিলাম পাঠক হিসেবে কোন উপন্যাসগুলো পড়ব? তিনি প্রথমেই বলেছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ উপন্যাসটির কথা। বলেছিলেন, পড়ে দেখ। পড়ে বুঝবে হক ভাই আমাদের সময়ের কত বড় লেখক।
সেদিন পত্রিকার জন্য মনজুর স্যারের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আজিজ মার্কেট থেকে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ কিনে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলাম। দুদিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফোন দিলাম সৈয়দ শামসুল হককে। উপন্যাসটির পাঠ উপলব্ধি জানালাম তাঁকে। বললাম উপন্যাসটির হদিস যে মনজুর স্যার দিয়েছেন সেকথা। হক ভাই বললেন, তুমি মনজুরুলের আজগুবি রাত পড়েছ? পড়িনি। বললাম আমি। হক ভাই বললেন, দ্রæতই পড়ে নাও। মনজুর সঙ্গে দেখা হলে আমার শুভেচ্ছা জানিও।
পরদিনই কিনে নিলাম ‘আজগুবি রাত’। স্যারের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পর পত্রিকা নিয়ে আবার দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ইংরেজি বিভাগের অফিসে। বললাম ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ পড়ার কথা। বললাম, আপনি না বললেন এই অসাধারণ উপন্যাস পাঠের স্বাদ পেতে হয়তো আরও দেরি হয়ে যেত। বললাম তাঁর ‘আজগুবি রাতে’র পাঠ শুরু করার কথা। বললাম সৈয়দ হক যে তাঁর এই উপন্যাসের হদিস দিয়েছেন, সে কথাও।

সেদিন বললাম, স্যার, আমি আপনার শৈশব-কৈশোর লিখতে চাই। স্যার বললেন, সেটা কীভাবে? বললাম, আপনি বলবেন, আমি টেপরেকর্ড করব। স্যার রাজি হলেন। বলতে লাগলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, আর আমি টেপরেকর্ড করতে লাগলাম। সেটাও পত্রিকায় ছাপা হলো। পরবর্তীকালে আমার ‘খ্যাতিমানদের শৈশব’ বইতেও অন্তর্ভুক্ত হলো।
  সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আপনি ছিলেন থাকবেন
সেই থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। ধীরে ধীরে সম্পর্কটা একটা মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল। স্যারের সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা হতো। কখনো আমার বাসায়, কখনো কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের বাসায়। আড্ডায় আমাদের কথা হতো সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে, সাহিত্যের কলাকৌশল নিয়ে। সর্বশেষ আড্ডাটি হয়েছিল কয়েক মাস আগে। কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামালও ছিলেন সেই আড্ডায়। স্যার সেদিন সাহিত্য বিষয়ে এত গভীরের কথা বলছিলেন যে, আমরা মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, স্যার, আমি যদি আপনার ছাত্র হতাম, আপনার ক্লাসগুলোতে অংশ নিতাম, তবে কত কিছুই না শিখতে পারতাম।
স্যার হাসলেন। সেই বিনয়ের হাসি। হায়! সেদিন কি একবারও ভেবেছিলাম আর কখনো তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হবে না! একবারও কি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আর কখনো শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে তাঁর কোনো গভীরের আলাপ শুনতে পাব না! ভাবতে পারিনি। আন্দাজ করতে পারিনি। আমাদের কল্পনায়ও ছিল না স্যার এত জলদি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রধান গল্পকারদের একজন ছিলেন। তাঁর অগ্রজ গল্পকাররা তাঁর আগেই চলে গেছেন। তিনি ছিলেন। ছিলেন আমাদের দিশারি হয়ে। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কখনো কখনো অগ্রজদের অনুপ্রেরণার দরকার হয়। অনুপ্রেরণা পেলে অনুজরা নতুন নতুন দিগন্ত আবিষ্কারে এগিয়ে যেতে পারে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই অগ্রজ, সর্বদা যিনি অকুণ্ঠচিত্তে অনুজ লেখকদের অনুপ্রাণিত করতেন। স্যারের কোনো সভা-সেমিনারে আমি কিংবা মোজাফ্ফর উপস্থিত থাকলে তাঁর বক্তৃতায় তিনি আমাদের অ্যাড্রেস করতেন। আমাদের নাম উল্লেখ করে প্রশংসা করতেন, আমাদের লেখার প্রশংসা করতেন। এটা তিনি না করলেও পারতেন। করতেন আমাদের উৎসাহিত করার জন্য, অনুপ্রাণিত করার জন্য, পাঠকমহলে পরিচিত করে তোলার জন্য।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটা কথা লোকে খুব পছন্দ করেছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন শুধুই প্রশাসক।’ কথাগুলো পড়ে মনে হয়েছিল আমি একটি আয়না দেখলাম। সেই আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম নিজের মুখ, জাতির মুখ। লেখকরা এভাবেই বুঝি আয়নার কাজ করেন। এভাবেই জাতির বোধের উদয় ঘটিয়ে দেন।
স্যার কদিন আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ হলেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল তিনি সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। আবার আমরা আড্ডায় বসব। অথচ তিনি ফিরলেন না। ‘স্যার আজ প্রয়াত হলেন’- এ কথাটি লিখতে হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে, চোখে অশ্রæক্ষরণ হচ্ছে। কখনো কখনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুও হৃদয় স্পর্শ করে না। আবার কখনো কখনো অনাত্মীয়ের মৃত্যুতে হৃদয় থরথর করে কেঁপে ওঠে। মনজুর স্যার ছিলেন আত্মীয়ের অধিক আত্মীয়। তাঁর প্রয়াণ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, আমাদের নির্বাক করে দিয়েছে।
স্যার, বলব না, বিদায়! বলব না আপনি প্রয়াত হয়েছেন। আপনি আমার সঙ্গে ছিলেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনাগতও দিনেও থাকবেন। থাকবেন মাথার মুকুট হয়ে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
মুলার আগাম ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে
নভেম্বরে নতুন পোশাক পাচ্ছে পুলিশ
নির্বাচন ঘিরে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির নির্দেশ
২৬৬৪ ইয়াবাসহ আটক যুবদল নেতা রহিম
ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদকের ১৯ মামলার আসামী সবুজসহ গ্রেপ্তার ৫
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
অভিযানের পরদিনই দালালের খপ্পরে প্রাণ গেলো প্রসূতির
২৫০ আসনে গ্রিন সিগন্যাল দিতে যাচ্ছে বিএনপি, রয়েছে কঠোর বার্তাও
ডেঙ্গু কেড়ে নিল আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ত্বকীকে
চান্দিনায় ক্রেতা ও বন্ধকির ৪ কোটি টাকার স্বর্ণ নিয়ে উধাও ব্যবসায়ী
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ট্রাকের পিছনে দুই বাসের ধাক্কা আহত ২০
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২