২৯
সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘প্রতিটি
হৃদস্পন্দনের যত্ন নিন’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব
সহকারে দিবসটি পালিত হচ্ছে। হার্ট বা হৃদপিণ্ড হচ্ছে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ
অঙ্গ। হৃৎপিণ্ডের অবিরাম সংকোচন এবং প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত
সংবহন পদ্ধতি অব্যাহত থাকে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচনকে বলা হয় সিস্টোল এবং
প্রসারণকে বলা হয় ডায়াস্টোল। হৃৎপিণ্ডের একবার সিস্টোল-ডায়াস্টোলকে একত্রে
হৃৎস্পন্দন (যবধৎঃ নবধঃ) বলে। হৃৎস্পন্দন শোনার জন্য একটি স্টেথোস্কোপ
সরাসরি হৃৎপিণ্ডের অ্য্যাপেক্সের উপর স্থাপন করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ
মানুষের স্বাভাবিক বিশ্রামকালীন হৃদস্পন্দনের হার প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০
বিট (নঢ়স)। একটি অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হল যখন হৃদস্পন্দন হয় খুব দ্রুত বা
খুব ধীর। অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের অন্যতম কারণ ও ঝুঁকি হল: হৃদরোগ বা
হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ, ধূমপান, কিছু ওষুধ যেমন
অ্যামফিটামিন এবং বিটা-ব্লকার। বিশ্বে প্রতি পাঁচটি অকালমৃত্যুর মধ্যে
একটির জন্য দায়ী হৃদরোগ, যার অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ।
বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ২০২২ সালে আনুমানিক ১ কোটি ৯৮ লক্ষ মানুষ
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যা বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২%।
এই মৃত্যুর ৮৫% ছিল হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণে। হৃদরোগের
তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি মৃত্যু ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে। তামাক
ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (অতিরিক্ত লবণ, চিনি এবং চর্বি সহ) এবং
স্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অ্যালকোহলের ক্ষতিকারক ব্যবহার এবং বায়ু
দূষণের মতো আচরণগত এবং পরিবেশগত ঝুঁকির কারণগুলিকে মোকাবেলা করে বেশিরভাগ
হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। কাউন্সেলিং এবং ওষুধের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা
শুরু করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হৃদরোগ সনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
তামাকের
ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ ও
অতিরিক্ত ওজন-সব মিলিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। উচ্চ রক্তচাপ বাংলাদেশে
হৃদরোগের জন্য একটি অন্যতম কারণ। উচ্চ রক্তচাপকে প্রায়শই ‘নীরব ঘাতক’ বলা
হয়, কারণ এটি লক্ষণ ছাড়াই হতে পারে। এটি হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের জন্য একটি
গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের কারণগুলি বোঝা প্রতিরোধ এবং
ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের একটি
প্রধান কারণ হল জীবনধারা। দেশের দ্রুত নগরায়নের ফলে দৈনন্দিন রুটিনে
পরিবর্তন এসেছে। মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমে গেছে, মানুষ দীর্ঘ সময় বসে
থাকার মতো চাকরিতে কাজ করছে এবং দৈনন্দিন কাজে ক্রমশ যান্ত্রিক নির্ভরশীলতা
বাড়ছে। এই পরিবর্তনগুলি শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা হ্রাস করেছে, যা উচ্চ
রক্তচাপের উচ্চ প্রকোপে অবদান রাখছে।
উচ্চ রক্তচাপের সাথে যুক্ত আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল মানসিক চাপ। যান্ত্রিক জীবনের চাপ, যার মধ্যে রয়েছে
কাজের চাপ, আর্থিক উদ্বেগ এবং পারিবারিক দায়িত্ব, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের
দিকে পরিচালিত করতে পারে। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
জিনগত প্রবণতা ও উচ্চ রক্তচাপের পারিবারিক ইতিহাস প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ এবং হৃদরোগ
প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে অকালমৃত্যুর ধারা অব্যাহত থাকবে।
এজন্য ব্যক্তিগত জীবনধারায় পরিবর্তন আনা এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রসার নিশ্চিত
করা এখন সময়ের দাবি। হৃদরোগ প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ একটি কার্যকর
উপায়-এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সচেতনতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শক্তিশালী ও সাহসী পদক্ষেপ।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার,জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা।