শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫
৪ শ্রাবণ ১৪৩২
২০২৫ সালের এসএসসি ফলাফল বিপর্যয়
একাদশ শ্রেণিতে শূন্য আসন থাকবে অর্ধেকের চেয়ে বেশি
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন
প্রকাশ: শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫, ১:০৫ এএম |

একাদশ শ্রেণিতে শূন্য আসন থাকবে অর্ধেকের চেয়ে বেশি
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকেই গোটা দেশে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়। পাশের হার কমে যাওয়া, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়া এবং কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া সমাজের সর্বস্তরে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এটি আসলে ফলাফল বিপর্যয় নয়, এটি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। 
পাশের হারের মতো জিপিএ-৫ এবং শতভাগ পাশ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। সকল শিক্ষা র্বোডের গড় পাশের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা গতবার ছিল সকল শিক্ষা র্বোডের গড় পাশের হার ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এবার গতবারের চেয়ে জিপিএ-৫ কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭। এই ফলাফলের পেছনে দায়ী কে ? শিক্ষার্থী নাকি শিক্ষক ? নাকি গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ? এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার এখনো সময় হয়নি ?
এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছেন ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী। তবে শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, সারাদেশে ৯ হাজার ১৮১টি কলেজ ও আলিম মাদরাসায় একাদশ শ্রেণিতে পাঠদানের অনুমতি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে প্রায় ২২ লাখের মতো। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিকে আসন আছে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার। এছাড়াও কারিগরি বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পর্যায়ে প্রায় ৯ লাখ আসন রয়েছে। 
সবমিলিয়ে আসন রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৩ লাখ। বিপরীতে এবার পাস করেছে ১৩ লাখের ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীও যদি ভর্তি হয়, তারপরও আসন শূন্য থাকবে প্রায় সাড়ে ২০ লাখ। এ ছাড়া ও প্রতি বছর এসএসসি ও তার সমমান পাশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ১০ শতাংশ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় না।
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, যা তাদের মনোযোগ ও পরীক্ষার প্রস্তুতি প্রভাব ফেলছে। কেউ কেউ বলছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রভাব, করোনা মহামারি প্রভাব। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব পড়েছে বেশি। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা ছিল এই নতুন কারিকুলামের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাচ। অথচ তাদের জন্য পর্যাপ্ত গাইডলাইন, অনুশীলন প্রশ্ন, মডেল টেস্ট বা মূল্যায়নের নমুনা সময়মতো পায়নি। অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ক্লাস নিতে ব্যর্থ হয়েছে বা সময়মতো সিলেবাস শেষ করতে পারেনি। অন্যদিকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার কড়াকড়ি ও বোর্ডভিত্তিক বৈষম্য রয়ে গেছে। বিভিন্ন বোর্ডে নম্বর দেওয়ার ধরনে বড় ধরনের পার্থক্য ছিল। 
আবার প্রশ্নপত্র কঠিন ছিল কি সহজ-এই নিয়েও একাধিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সব বোর্ডে একই রকম প্রশ্ন হওয়ার দরকার, না হলে একেক বোর্ডের ফলাফল একেক রকমের হবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে শিক্ষক সংকট, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের চেয়ে প্রাইভেট কোচিংয়ের প্রতি বেশি মনোযোগী এমন অভিযোগ ও রয়েছে।
পাশের হার বাড়ানোর চেয়ে বাস্তবে শিক্ষার মান বাড়ানো বেশি জরুরি। দিনদিন এসব প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনের পার্টটাইম শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। যোগ্যতা ও পেশাদারিত্বের বদলে কম খরচে শিক্ষক নিয়োগই হয়ে উঠেছে পরিচালনা পরিষদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তারা শিক্ষার মানের চেয়ে বরং ‘কীভাবে কম খরচে প্রতিষ্ঠান চালানো যায়’-সেই হিসাবেই বেশি মনোযোগী।
এর ফলে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না; বরং কোচিং বাণিজ্যই হয়ে উঠছে তাদের আয়ের প্রধান উৎস ও মূল আগ্রহের জায়গা। এর কুপ্রভাব সরাসরি পড়ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ওপর, যা ফলাফলে প্রতিফলিত হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা শুধু ব্যক্তি নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও কাঠামোগতভাবে দুর্বল। পাঠ্যপুস্তকের মান, পরীক্ষার প্রশ্নে সৃজনশীলতার অভাব, মূল্যায়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের ঘাটতি-এসবই প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সুতরাং, এ কথা বলতে হয়-এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়ার দায় শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না, বাস্তবতার ভিত্তিতে দেখলে অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রশাসন-সবার কাঁধেই এই দায়ভার বর্তায়। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। এখনই সময়, দায় নির্ধারণের পাশাপাশি দায়িত্ব গ্রহণের।
এবারের এসএসসির ফলাফল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে-এটা কেবল পরীক্ষায় পাশ বা ফেল নয়, বরং গোটা শিক্ষাব্যবস্থার এক গভীর সংকট। এর অন্যতম কারণ দেশে শিক্ষক সংকট আকার কমছেই না। বর্তমানে সারা দেশে ৩৩ হাজারের বেশি বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ লাখ ৮২২টি সহকারী শিক্ষক শূন্য পদে নিয়োগ দিতে ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, এর মধ্যে স্কুল ও কলেজে ৪৬ হাজার ২১১টি, মাদ্রাসায় ৫৩ হাজার ৫০১টি এবং কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ১১০টি পদ রয়েছে। 
কিন্তু এর বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন জমা পড়েছে ৫৮ হাজার ৭০০ জনের। ফলে যদি সব প্রার্থীর আবেদন বৈধও হয়, তবু ও প্রায় ৪১ হাজার ৩০০ শিক্ষক পদ শূন্য থেকে যাবে। শিক্ষকসংকট কাটাতে বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এক থেকে ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়োগ সময়ের দাবি।
দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 
চাহিদার চেয়ে আবেদন কম জমা পড়েছে, এর মধ্যে অনেকের অন্য জায়গায় চাকরী হয়ে যেতে পারে। তাই অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাবে না। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
এদিকে, ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের যোগ্যতায় বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এতে অনেক প্রার্থী বাদ পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবেদনের যোগ্যতার শর্তে বলা হয়, প্রার্থীর বয়সসীমা ৪ জুন ২০২৫ তারিখে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর হতে হবে, ইতিমধ্যে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ফল প্রকাশের তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে থাকতে হবে। বয়স ও সনদের মেয়াদের শর্ত পূরণ না করলে প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন না। যত দ্রুত পারা যায় প্রয়েজনে শর্ত শীতিল করে হলেও সকল বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট দূর করা দরকার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।   












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কোম্পানীগঞ্জে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
গোপালগঞ্জে কারফিউয়ের মেয়াদ আরো বাড়ল
আটক ১৬৪
ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশে যোগ দিতে কুমিল্লা থেকে যাবেন লক্ষাধিক নেতাকর্মী
কুমিল্লায় বিএনপির মৌন মিছিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
যাত্রীর ফেলে যাওয়া ১৫ লাখ টাকা ফেরত দিলেন ইজিবাইক চালক
তিতাসে যুবকের মরদেহ উদ্ধার- বরিশাল থেকে কুমিল্লায় এনে গলা কেটে হত্যা
বিএনপি কারো উস্কানিতে জড়াবেনা -আবুল কালাম
কোম্পানীগঞ্জে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
সরকারই উস্কানি দিয়ে তাদেরকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়েছে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২