মানব
ইতিহাসে সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নতুন নয়; বরং এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ধারাবাহিক অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং
আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পরিসরে যুদ্ধ, নিপীড়ন, জাতিগত সহিংসতা ও দমননীতি
একাধিকবার মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
থমাস হবস (ঞযড়সধং ঐড়ননবং)-এর
‘প্রকৃতির রাজ্য’ ধারণা অনুযায়ী মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সহিংস এবং রাষ্ট্র
হলো এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের প্রধান অবলম্বন। অন্যদিকে, মিশেল ফুকো
(চধঁষ-গরপযবষ ঋড়ঁপধঁষঃ) মনে করেন, আধুনিক রাষ্ট্র শৃঙ্খলার নামে মানুষকে
দমন করে, যার ফলেই মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে
বাস্তববাদ (জবধষরংস) তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থই মুখ্য এবং
সেই স্বার্থ রক্ষার জন্য যেকোনো উপায় অবলম্বন করা বৈধ, এমনকি যুদ্ধও। এই
দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমরা দেখি, ‘মানবাধিকার রক্ষার’ নামে অনেক সময় বড়
রাষ্ট্রগুলো অন্য রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ করে।
অন্যদিকে উদারতাবাদ ও
গঠনমূলক শান্তি তত্ত্ব (চড়ংরঃরাব চবধপব ঞযবড়ৎু) প্রবক্তা ইয়োহান গালতুং
(ঔড়যধহ এধষঃঁহম) বলেন, ‘শান্তি মানে কেবল যুদ্ধবিরতি নয়, বরং একটি সহনশীল,
সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা’।
সংঘাত তাই কেবল রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি
ব্যক্তি ও জাতির অস্তিত্ব সংকটে ফেলে। তাইতো প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে কীভাবে
যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করা যায়। কিন্তু, উপসালা ইউনিভার্সিটি কনফ্লিক্ট ডাটা
প্রোগ্রাম (টঢ়ঢ়ংধষধ ঈড়হভষরপঃ উধঃধ চৎড়মৎধস - টঈউচ) অনুসারে, যুদ্ধ ও
অভ্যন্তরীণ সংঘাত একবিংশ শতাব্দীতে ঢের বেড়েছে। তাহলে এর থাকে পরিত্রাণ
পাওয়ার উপায় কী? শান্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠা সম্ভব?
দক্ষিণ আফ্রিকার কালো
মানুষের উপর সাদা বর্ণবাদী শাসনের নিষ্ঠুর শৃঙ্খল চলেছিল দীর্ঘ চার দশক। এই
সময়ের সবচেয়ে প্রতীকী চরিত্র নেলসন ম্যান্ডেলা (ঘবষংড়হ জড়ষরযষধযষধ)-যিনি
২৭ বছর ধরে অন্ধকার কারাগারে বন্দি ছিলেন, কেবল ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর
অপরাধে। কিন্তু যখন অবশেষে বর্ণবাদী শাসনের পতন হলো এবং কালো মানুষেরা বিজয়
অর্জন করল, তখন বিশ্বজুড়ে একটা শঙ্কা—এবার বুঝি প্রতিশোধ আসছে । শ্বেতাঙ্গ
সংখ্যালঘুরা হয়তো নির্মমতার শিকার হবে।
কিন্তু ম্যান্ডেলা সেই
প্রতিশোধের পথ বেছে নেননি। তিনি দেখালেন এক নতুন দৃষ্টান্ত-ক্ষমাশীলতা,
বোঝাপড়া এবং সমাজ পুনর্গঠনের। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (ঞৎঁঃয
ধহফ জবপড়হপরষরধঃরড়হ ঈড়সসরংংরড়হ)’ গঠনের মাধ্যমে তিনি বললেন, ন্যায়বিচার
মানে কেবল শাস্তি নয়, বরং সত্যকে প্রকাশ করে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে
একটি ক্ষতবিক্ষত জাতিকে আবার একত্রিত করা। ম্যান্ডেলার এই দূরদর্শিতা
প্রমাণ করে, শান্তি ও ন্যায়বিচার যদি হৃদয়ের গভীর থেকে আসে, তবে দীর্ঘতম
শত্রুতাও সহাবস্থানে রূপ নিতে পারে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় অহিংসা একটি
রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। মহাত্মা গান্ধী (গধযধঃসধ
এধহফযর) দেখিয়েছেন, কীভাবে সত্যাগ্রহ, আত্মসংযম ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে
জনগণকে একত্রিত করে শাসকের অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করা যায়। তার মতে, ‘চোখের
বদলে চোখ নিলে পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে’-এই মানবিক বোধ আজকের বিশ্বের
জন্যও এক চিরন্তন আহ্বান।
নেলসন ম্যান্ডেলা ও মহাত্মা গান্ধীর মতো
শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্বের উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য হলেও,
আরও অনেক নেতা ও ব্যক্তিত্ব আছেন যারা তাদের মতো অহিংসা, মানবিকতা ও সত্যের
পথে থেকে সমাজকে পরিবর্তন করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন
লুথার কিং জুনিয়র আফ্রিকান-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস
আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘ও
ঐধাব ধ উৎবধস’ ভাষণে এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যেখানে মানুষকে
গায়ের রঙ নয়, মানবিক গুণাবলির ভিত্তিতে বিচার করা হবে। অনুরূপভাবে, দক্ষিণ
আফ্রিকার বিশপ ডেসমন্ড টুটু (উবংসড়হফ গঢ়রষড় ঞঁঃঁ) শান্তিপূর্ণভাবে
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে গঠিত ট্রুথ
অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মাধ্যমে জাতিকে পুনর্মিলনের পথে এগিয়ে নিয়ে
যান।
পোল্যান্ডের লেখ ওয়ালেসা (খবপয ডধłęংধ) ‘সলিডারিটি’ নামের একটি
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে কমিউনিস্টস্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী
মানুষের অধিকারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। একইভাবে, পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই
(গধষধষধ ণড়ঁংধভুধর) তালেবানের গুলিতে আহত হয়েও নারী শিক্ষার পক্ষে
বিশ্বব্যাপী সংগ্রামী কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তিনি কিশোরী বয়সেই নোবেল শান্তি
পুরস্কার লাভ করেন।
এসব উদাহরণ আমাদের শেখায় যে অহিংস আন্দোলন, মানবিক
মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল থেকে একটি জাতিকে শুধু
মুক্তই নয়, নৈতিকভাবে উন্নত করাও সম্ভব। শান্তি গবেষক জোহান গালতুং (ঔড়যধহ
এধষঃঁহম)-এর মতে, এসব নেতা শুধুমাত্র নেতিবাচক শান্তি (সহিংসতার
অনুপস্থিতি) নয়, বরং ইতিবাচক শান্তি (ন্যায়, সমতা ও সামাজিক কল্যাণ)
প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বিশ্ব আজ এমন এক সময় পার করছে, যেখানে যুদ্ধ,
দারিদ্র্য, গণতন্ত্রের সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মিলিয়ে সংঘাতের নতুন
মাত্রা তৈরি হচ্ছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, মিয়ানমার থেকে শুরু করে
বাংলাদেশেও রাজনৈতিক মেরুকরণ, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং
প্রশাসনিক সহিংসতার বহুমাত্রিক রূপ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে
শান্তি প্রতিষ্ঠা আর কেবল যুদ্ধ বিরতির নামে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; বরং
তা হতে হবে অন্তর্নিহিত কাঠামোগত সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করার প্রক্রিয়া।
নেলসন
ম্যান্ডেলার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ মডেল, মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা
নীতি’, কিংবা গালতুংয়ের ‘ইতিবাচক শান্তি’ তত্ত্ব—সবগুলোই দেখায় যে সহিংসতা
নয়, বরং সহনশীলতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনই একটি
টেকসই শান্তির পথ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ন্যায্যতা ও
অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি সবচেয়ে জরুরি।
প্রথমত, জবাবদিহিমূলক ও
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নয়,
সব মত ও শ্রেণির মানুষ নীতিনির্ধারণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ
করতে পারে। এ জন্য ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসি’ বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের
ধারণা অনুসরণ করা যেতে পারে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জনগণের মতামতকে
গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মানবিক ও সহনশীল
শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং মূল্যবোধ,
সহমর্মিতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান শেখায়। ‘পিস এডুকেশন’ বা শান্তি
শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাতের ইতিবাচক ব্যবস্থাপনার কৌশল ও
সহানুভূতির মানসিকতা গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষার মাধ্যমে যদি শিশুরা অন্যের
দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে শেখে, তবেই ভবিষ্যৎ সমাজে সহিংসতা কমে আসবে।
তৃতীয়ত,
দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করতে হবে, কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্যই সবচেয়ে
বড় কাঠামোগত সহিংসতার জন্ম দেয়। যারা শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা বা
ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত, তাদের ক্ষোভ একসময় ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক রূপ
নেয়। তাই ‘স্ট্রাকচরাল ভায়োলেন্স’ ধারণার আলোকে সমাজে ন্যায়ভিত্তিক সম্পদ
বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম আয়ের
নিশ্চয়তা এবং শ্রমজীবী জনগণের অধিকারে রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
শান্তি
প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় সংলাপ ও সহাবস্থান চর্চা-রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক
দলগুলোকে দলীয় স্বার্থ ছাড়িয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এক টেবিলে বসতে হবে।
‘কনফ্লিক্ট ট্রান্সফরমেশন (ঈড়হভষরপঃ ঞৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ)’ তত্ত্ব অনুযায়ী, শুধু
বিরোধ মেটানো নয়, বিরোধের মূল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো
চিহ্নিত করে সেগুলোর টেকসই সমাধানই সত্যিকারের শান্তির ভিত্তি।
সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য কেবল অস্ত্র
পরিহার যথেষ্ট নয়, দরকার মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা,
সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকার। অহিংস রাজনীতি,
ন্যায্য প্রশাসন এবং মানবিক অর্থনীতি-এই তিন উপাদান ছাড়া শান্তি কখনো
স্থায়ী হতে পারে না। ব্যক্তির প্রতি, ভিন্নমতের প্রতি এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর
প্রতি যে সম্মানবোধ গড়ে উঠবে, সেটাই হবে শান্তি প্রতিষ্ঠার মৌলিক ভিত্তি।
এই
মানবিক রাজনীতিই আগামী বিশ্বের ও বাংলাদেশের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতার
দৃঢ় ভিত গড়ে দিতে পারে। এখন প্রয়োজন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সচেতনতা
এবং নাগরিক অংশগ্রহণের সম্মিলিত প্রয়াস।
লেখক: অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়