প্রটেস্ট্যাট প্যাস্টরের
পুত্র ফ্রিডরিুশ নীৎশের জন্ম লাইপৎজিগের কাছে রোয়েকেন গ্রামে ১৫ অক্টোবর,
(১৮৪৪-১৯০০) সালে। খ্রিস্টধর্মে তাঁর আস্থা ছাত্রাবস্থাতেই বিলুপ্ত হয়। বন
এবং লাইপৎজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, ভাষাতত্ত্ব এবং ক্লাসিকস্ ছিল তাঁর
বিশেষ চর্চার বিষয়। প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে হেরাক্লিটাস এবং এপিকুরাস আর
আধুনিকদের মধ্যে শোপেনহাওয়ার তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেন। অপরপক্ষে
সক্রেটিস এবং হেগেল তাঁর বিচারে অশ্রদ্ধেয়। যুবাকালেই তাঁর চিন্তার উৎকর্ষ
এবং মৌলিকতা এতটাই প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে যে কোনও উপাধি অর্জনের আগেই মাত্র
পঁচিশ বছর বয়সে তিনি বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসিকস্ এবং ভাষাতত্ত্বের
অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এখানে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক সহকর্মী ছিলেন
ইটালীয় রেনেসাঁস বিষয়ে বিখ্যাত বীজগ্রন্থের লেখক ইয়াকব বুর্কহার্টকে।
দুজনেই হেগেলীয় দর্শনের বিরোধী, এবং গোয়েটে ও শোপেনহাওয়ারের অনুরাগী। নীৎশে
বুর্কহার্টকে বিশেষ সম্মান করতেন; অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের চিন্তায় মিল ছিল।
কিন্তু পশ্চিমি সভ্যতার মহাসংকট বিষয়ে সচেতন হয়েও যে ক্ষেত্রে বুর্কহার্ট
মানবতন্ত্রী আদর্শের নিত্যকালীন শ্রেষ্ঠত্বে আস্থা বজায় রেখেছিলেন, তাঁর
তরুণ সহকর্মী সেক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলেছিলেন নৈতিক শূন্যবাদের দিকে।
বিবুধান বুর্কহার্টের মানবতন্ত্রী প্রত্যয় যুবক নীৎশের কাছে ঠেকেছিল
নৈরাশ্যকে ঢেকে রাখার উদ্দেশ্যে পরিচিত মুখোশ মাত্র। নীৎশে শান্তি অথবা
প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নিজেকে অথবা অপরকে স্তোক দিতে রাজি ছিলেন না। গোয়েটের
সঙ্গতিচিহ্নিত প্রজ্ঞা বিষয়ে এখানেই তাঁর সংশয়।
বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে
দশ বছর (১৮৬৯-৭৯) অধ্যাপনার পর চিররুগ্ন নীৎশে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে
তাঁকে অধ্যাপনার কাজ থেকে স্থায়ীভাবে অবসর নিতে হয়। পরের দশ বছর ভগ্নদেহ
নিয়ে এক স্বাস্থ্যনিবাস থেকে অন্য স্বাস্থ্যনিবাসে ঘুরেছেন। গৃহহীন,
বন্ধুহীন, উপার্জনহীন। অথচ এই দুরবস্থায় তাঁর মন এবং লেখনী নিরবচ্ছিন্নভাবে
সক্রিয়। আসলে অধ্যাপনা তাঁর ধাতে ছিল না; চলতি ধ্যান-ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে
নিজস্ব অনুভব থেকে নতুন এক জগৎ সৃষ্টি করার বৈপ্লবিক ভূমিকা তিনি বেছে
নিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবার কয়েক মাস আগে অনুরাগী তরুণ সুইডিশ
নাট্যকার আগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গকে চিঠিতে লেখেন, “মানব-ইতিহাসকে দ্বিখণ্ডিত
করবার শক্তি মনে হয় এতদিনে অর্জন করেছি।” এবং মতিবিভ্রমের জন্য যখন তিনি
চিকিৎসাধীন তখন বুর্কহার্টকে লেখা শেষ চিঠিতে পড়ি: “প্রিয় অধ্যাপক, ঈশ্বর
হওয়ার চাইতে বাসনা অধ্যাপকের পদলাভ বেশি কাম্য বটে, কিন্তু সেই লোভনীয় পদের
জন্য নতুন জগৎ সৃষ্টির দায়িত্ব ত্যাগ করব এতটা আত্মকেন্দ্রিক আমি নই।”
১৮৭২
সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই (ঞযব ইরৎঃয ড়ভ ঞৎধমবফু)-তেই নীৎশের সৃষ্টিশীল
ভাবুকতার স্পষ্ট পরিচয় মেলে। তারপরে (১৭৭৮-৮০) সালে (ঞযব উধহি ড়ভ ঃযব উধু:
১৮৮২ সালে। ঞযব ঔড়ুভঁষ ডরংফড়স; ১৮৮৩-৯২ সালের মধ্যে ঞযঁং ঝঢ়ধশব
তধৎধঃযঁংঃৎধ, ১৮৮৬-সালেতে ইবুড়হফ এড়ড়ফ ধহফ ঊারষ; ১৮৮৭-তে ঞড়ধিৎফং ঃযব
এবহবধষড়মু ড়ভ গড়ৎধষং, ১৮৮৮-সালেতে উবৎ অহঃর-ঈযৎরংঃ, ১৮৮৯-তে ঞযব ঞরিষরমযঃ
ড়ভ ঃযব ওফড়ষং Ñএকটির পর একটি কাব্যগুণসম্পন্ন, মৌলিক ভাবুকতা সমৃদ্ধ, পাঠক
মনে বিভিন্ন চিন্তার উদ্দীপক বই। ১৮৮৯ সালেতে তাঁর মানসিক ব্যাধি প্রবল হয়ে
ওঠে, এবং পরবর্তী দশ বছর অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কাটিয়ে ১৯০০ সালে গোয়েটের
স্মৃতি বিজড়িত হাইমারে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে নীৎশের ফেলে যাওয়া খসড়া
নোটসগুলি সম্পাদনা করে ঞযব ডরষষ ঃড় চড়বিৎ নামে বই আকারে বের করেন। নীৎশে এই
বইটির জন্য ভূমিকার যে খসড়া লিখেছিলেন তা থেকে মনে হয় তাঁর পরিণত চিন্তাকে
একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের আকারে রূপ দেবার পরিকল্পনা তাঁর ছিল।
মতি-বিভ্রংশের ফলে সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ১৮৮৮ সালে লেখা ঊপপব ঐড়সড় প্রকাশিত
হয় নীৎশের মৃত্যুর আট বছর পরে ১৯০৮ সালে।
বস্তুত উন্মাদ এবং অকর্মণ্য
হয়ে যাবার পূর্ববর্তী দশ বছর ধরে নীৎশে যেভাবে একটির পর একটি মৌলিক এবং
মননশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন, ভাবুকতার ইতিহাসে তা সম্ভবত তুলনাহীন। অথচ তাঁর
উন্মাদ হয়ে যাবার প্রায় পূর্ব পর্যন্ত নীৎশের অসাধারণ প্রতিভার কোনও
ব্যাপক স্বীকৃতি মেলেনি। ১৮৮৮ সালের মে মাসে কোপেনহাগেনে তাঁর রচনাবলি এবং
ভাবনাচিন্তা নিয়ে সর্বপ্রথম ধারাবাহিক কয়েকটি বক্তৃতা দেন বিদগ্ধ ড্যানিশ
সাহিত্য সমালোচক গেওর্গ ব্রান্ডেস। তাঁর প্রতিভাকে সোৎসাহে স্বাগত করেন
সুইডিশ নাট্যকার আগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ। তারপর শতাব্দী শেষের
জিজ্ঞাসাবিহ্বল আবহাওয়াতে নীৎশের প্রভাব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯০৯ থেকে
১৯১৩ সালের মধ্যে লন্ডন থেকে অস্কার লেভির সম্পাদনায় আঠারো খণ্ডে নীৎশের
রচনাবলির ইংরেজি অনুবাদ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মূল জার্মান রচনাবলির
পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ (গঁংধৎরড়হ-অঁংমধনব) বার হয় তেইশ খণ্ডে ১৯২২ সালে মিউনিখ
থেকে। বিশ শতকের প্রথম ভাগ জুড়ে পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে যাঁরা কবি,
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং ভাবুক তাঁদের ভিতরে অনেকের সঙ্গে নীৎশের
মানস-আত্মীয়তা খুবই স্পষ্ট। বস্তুত একজিস্টেনশিয়ালিস্ট এবং আংশিকভাবে
সমকালীন পোস্ট-মডার্নিস্ট ভাবান্দোলনের অন্যতম প্রধান উৎস এই একদা অবহেলিত
শূন্যবাদী জার্মান ভাবুক শিল্পী।
যদিও যৌবনকালের দশটি বছর তিনি
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন, যদিও তাঁর প্রায় সব লেখারই কেন্দ্রে
বিবিধ দার্শনিক জিজ্ঞাসা বা উপলব্ধি বিদ্যমান, নীৎশে কিন্তু কান্ট, হেগেল
বা অন্যান্য দার্শনিকদের মতো কোনও সুসংলগ্ন, সুপরিকল্পিত, পৌর্বাপর্ব
বিচিন্তিত দর্শনশাস্ত্র গড়ে তোলেননি। আসলে তিনি ছিলেন ভাবুক এবং শিল্পী।
অসংখ্য জিজ্ঞাসা তাঁর মনে, প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণার মধ্যে যাদের
কোনও সদুত্তর মেলেনি। প্রশ্নের অনুসরণ করতে গিয়ে যখন যে ভাব জেগে উঠেছে
তাকে ভাষায় রূপ দিয়েছেন। তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর ত্রুটি সহজেই চোখে পড়ে,
কিন্তু যে যাদুতে ভাষা শিল্প হয়ে ওঠে যুবকালেই সে যাদু তাঁর আয়ত্তে এসেছিল।
সহজ উত্তরে তাঁর কোনওদিনই আস্থা ছিল না, এবং উত্তরহীন জিজ্ঞাসা যে কত
দুর্বহ তা জেনেও স্তোক দেওয়া মিথ্যা উত্তরে তিনি শান্তি খোঁজেননি। তাঁর
ভাবনায় স্ববিরোধ আছে; পর্বান্তর আছে। ফলে তাঁর বক্তব্যের কোনও সংক্ষিপ্তসার
দেবার চেষ্টা মূঢ়তা। রাসেল তাঁর অ যরংঃড়ৎু ড়ভ ডবংঃবৎহ চযরষড়ংড়ঢ়যুÑতে এ
ধরনের চেষ্টা করে নীৎশের প্রতি (এবং নিজের প্রতি) বেশ কিচুটা অবিচার করেছেন
বলে আমি মনে করি। বরং তাঁর চিন্তা এবং চরিত্রের অনেকটা নির্ভরযোগ্য পরিচয়
মেলে ঋ.অ. খবধÑর ঞযব ঞৎধমরপ চযরষড়ংড়ঢ়যবৎ; অ ংঃঁফু ড়ভ ঋৎবফৎরপয ঘরবঃুংপযব
গ্রন্থে।
নীৎশের বিচারে ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুই-ই প্রাণের অবিচ্ছিন্ন
বহমানতার বিরোধী। ধর্ম মানুষকে জীবনবিমুখ করে, পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখতে
চায়, প্রশ্নশীলতাকে নিদ্রাবিষ্ট করে, নানা রকমের ভয় এবং লোভ দেখিয়ে মানসিক
নাবালকত্বকে আমৃত্যু টিকিয়ে রাখতে চায়। যারা আত্মজিজ্ঞাসার বদলে নিশ্চিত
উত্তরের আশ্রয় খোঁজে, অস্তিত্বের প্রত্যাভূতিহীন প্রবাহের মুখোমুখি হতে
যারা শঙ্কিত, ধর্ম তাদের অবলম্বন। সব সমাজ সংগঠনেই যারা শক্তিমান বা শাসক
তারা ধর্মের প্রাধিকার খাড়া করে তারি ভিত্তিতে নানা নীতিনির্দেশ, আচার
অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন ও প্রচলনের দ্বারা যারা দুর্বল এবং শাসিত তাদের মনে
দাস্য ভাবকে দৃঢ়মূল করে। অপরপক্ষে দুর্বল এবং শাসিত জনগণ ধর্মবিশ্বাসের
সহায়তায় তাদের ব্যর্থতা ও আক্রোশকে রূপান্তরিত করে প্রতিবাদহীন আত্মগ্লানি ও
অনতিক্রম্য পাপবোধে। নীৎশে সব ধর্মকেই বাতিল করেছেন, কিন্তু তাঁর
জীবনব্যাপী প্রখরতম আক্রমণের লক্ষ্য খ্রিস্টধর্ম। তাঁর বিচার খ্রিস্টধর্ম
জন্ম নিয়েছিল দাস মনোভাব থেকে এবং তার প্রচার এবং প্রসারের ফলে দাস বৃত্তিই
হয়ে দাঁড়িয়েছেন জনজীবনে ব্যাধিত নৈতিকতার ভিত্তি। কল্পিত ঈশ্বরের চরণ
সেবার আদর্শ সাধারণ স্ত্রী-পুরুষকে শক্তিমানের কাছে আত্ম নিবেদনে অভ্যস্ত
করে। ডাওনিসিয়ান প্রাণশক্তির পুনঃপ্রবাহ ছাড়া এই জীবনবিমুখ,
পাপবোধাক্রান্ত, মর্ষকাম হীনম্মন্যতাবোধ থেকে মানুষের উদ্ধার অসম্ভব।
নীৎশের খ্রিস্টধর্ম বিরোধিতা শুধু ঞযব ইরৎঃয ড়ভ ঞৎধমবফু এ নয়, অন্যান্য
রচনাতেও প্রবলভাবে ঘোষিত।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান ছাড়াও নীৎশে প্রবলভাবে
আক্রমণ করেছেন সমকালীন বুর্জোয়া সমাজ-সংস্কৃতিকে। বুর্জোয়া সভ্যতা
প্রাণশক্তিকে বন্দী করেছে যন্ত্রের শৃঙ্খলে; সৃজনশীলতাকে পর্যবসিত করেছেন
নির্দিষ্ট ছাঁচের পৌনঃপুনিক প্রয়োগে; বিশিষ্টকে বিলুপ্ত করেছে গড়পড়তায়;
আবেদন অনুভূতি সৌন্দর্য চেতনাকে বলি দিয়েছে উপযোগিতা এবং হিসেবি বুদ্ধির
হাড়িকাঠে; নিরানন্দ শ্রম এবং সঞ্চয়ের নেশাকে করেছে জীবনের আদর্শ; এপোলো এবং
ডাওনিসাস দুজনকেই বরবাদ করে সিংহাসনে বসিয়েছে টাকাকড়ি বা মুদ্রা দেবতাকে।
প্রলেটারিয়েটের বৈপ্লবিকতায় নীৎশের কোনও আস্থা ছিল না, কিন্তু মার্কসের মতো
তিনিও বুর্জোয়া “মানি-ফেটিশিজম্’-এর উচ্ছেদ চেয়েছেন। ঞযব ইরৎঃয ড়ভ ঢ়ড়বিৎ
-এ নীৎশে ঘোষণা করেছেন যে বুর্জোয়া সভ্যতার ধ্বংস শুধু অবশ্যম্ভাবী নয়, তা
সমাসন্ন:
বেশ কিছুকাল ধরে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ভিতরের বিবর্ধমান চাপে
প্রবল গতিতে এগিয়ে চলেছে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে। এই সংস্কৃতি আত্মজিজ্ঞাসায়
পরান্মুখ, পুনর্বিচারে অপারগ। যে সব প্রত্যয়, যে সব ধারণা রীতিনীতিকে
অবলম্বন করে এই সভ্যতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে তারা যে একেবারেই শূন্যগর্ভ, অলীক,
তাদের কাছে আশ্রয় খোঁজা যে নিজের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়, তা আর
গোপন নেই। ফলে এই মর্তুকাম সভ্যতার শূন্যবাদে বিলুপ্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও
বিকল্প নেই। আমি ঘোষণা করছি, আগামী দুই শতাব্দী জুড়ে শূন্যতার নিশ্চিত
আধিপত্য।
হেগেলের ভাববাদী বিশ্ববীক্ষার বৈপরীত্যে শোপেনহাওয়ার প্রস্তাব
করেছিলেন যে ডরষষ বা নৈর্ব্যক্তিক ইচ্ছাবৃত্তি বা বাসনা প্রবাহই
অস্তিত্বের যথার্থ স্বরূপ। ইন্দিয়গ্রামের কাছে যা দেহরূপে প্রতিভাত হয় তা
আসলে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আবার ব্যক্তির বাসনাও অধ্যাস
মাত্রÑজগৎব্যাপী আদিÑঅন্তহীন নৈর্ব্যক্তিক ইচ্ছাবৃত্তির প্রবাহে ব্যক্তি
অথবা তার বাসনার প্রকৃতপক্ষে কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। এই ভেদজ্ঞানরহিত
ইচ্ছাবৃত্তি স্থানকালপাত্রোত্তীর্ণ। কিন্তু এই সর্বব্যাপী ইচ্ছাবৃত্তি
ধর্মকল্পিত ঈশ্বর নয়; বস্তুত জাগতিক সমস্ত দ্বন্দ্ব, দুঃখ বা যন্ত্রণার এই
ইচ্ছাবৃত্তিই উৎস। বৌদ্ধ চিন্তার দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়ে শোপেনহাওয়ার
সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে বাসনাকে সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত করার দ্বারা দ্বন্দ্ব
ও দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। স্থানকালপাত্রের যে অবভাসে ব্যক্তির
চেতনা বন্দী, সর্ববিধ বাসনাকে বর্জন করতে পারলে তবেই তা থেকে উদ্ধার মিলতে
পারে। অহং-এর নির্বাণ ঘটলে বিশ্বও বিলুপ্ত হয়, ব্যক্তি এবং জগতের মধ্যে
কোনও প্রভেদ থাকে না, সর্ববিধ সংঘাত ও বেদনার অবসান হয়। খ্রিস্টধর্ম কল্পিত
‘আদি পাপ’ থেকে ঈশ্বরের কৃপায় ব্যক্তির উদ্ধার নয়, অথবা হিন্দুদের কাম্য
স্বর্গ, মোক্ষ অথবা ব্রহ্মত্ব অর্জন নয়, বুদ্ধ বর্ণিত নির্বাণই ছিল
শোপেনহাওয়ারের উদ্দিষ্ট। তিনি ঞযব লড়ুভঁষ রিংযফড়স-এ লিখেছেন: “অন্ধ অধৃষ্য
বৈশ্বিক ইচ্ছাশক্তির প্রবাহে ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে পারলে
তবেই দুঃখের উচ্ছেদ সম্ভব। ব্যক্তিত্ব বজায় রাখবার বাসনা থেকেই দুঃখ ও
দ্বন্দ্বের উদ্ভব। সেই বাসনার বিলোপের ফল নির্বাণের অখণ্ড শান্তি। যথার্থ
শূন্যবাদী জানে এবং মানে যে যে-জগতে সে আছে তার অস্তিত্ব অসংগত এবং তার
পরিবর্তে যে-জগৎকে ভাবা হয় প্রকৃষ্ট তার অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব।
হেগেলকে
বর্জন করে শোপেনহাইয়ারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নীৎশেও ডরষষ অথবা অনাত্মা
ইচ্ছাশক্তিকে অস্তিত্বের স্বরূপ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর কল্পনায়
ইচ্ছাশক্তির মূলে আছে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা, এবং এই আকাক্সক্ষা
একাদিকে যেমন সভ্যতা সংস্কৃতির (এবং তার উপাদান হিসেবে ধর্ম, বিজ্ঞান
রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) জন্মদাতা, অন্যদিকে তেমনি বিভেদ-বিলোপী
প্রাণ প্রবাহের সহায়ক। অস্তিত্ব অর্থহীন, তার নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রবাহে
সভ্যতা, ধর্ম, বিজ্ঞান, রীতিনীতি ইত্যাদির বিলোপ অবশ্যম্ভাবীÑএই সত্যকে
স্বীকার করে যাঁরা তার মুখোমুখি হন শূন্যতার ভিতরে তাঁরাই স্বাধীনতার
সম্ভাবনাকে সূচিত করেন। কারণ শূন্যতা দাবি করে যে যার বিলোপ অনিবার্য তাকে
না আঁকড়ে তার বিকল্পের অনুসনধান। এবং যদিও এই বিকল্পেরও আদৌ নিত্যতা নেই,
তবু বিকল্পের অনুসন্ধান এবং রচনার দ্বারাই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। নীৎশের
চিন্তা ও ক্ষেত্রে শোপেনহাওয়ার থেকে স্বতন্ত্র। শূন্যতাÑসচেতন নিরাশ্বাস
সৃজনের প্রেরণা এবং সামর্থ্য যাঁদের আছে তাঁরা কখনও গড়পড়তা স্ত্রীÑপুরুষ
হতে পারেন না। তাঁরা বিশিষ্ট, তাঁরা ট্র্যাজেডির নায়ক, তাঁদের ভিতরে
ডাওনিসাসের ভরবেগ সক্রিয়। নীৎশে তাঁর বিভিন্ন লেখায় এই বিশিষ্টজনদের কিছু
কিছু বিবরণ দিয়েছেনÑতাঁর সর্বশেষ যে বইটি তিনি নিজে ঘসেমেজে সম্পূর্ণ কোনও
রূপ দিয়ে যেতে পারেননি সেই ঞযব রিষষ ড়ভ ঢ়ড়বিৎÑএ তিনি এদের নামকরণ করেছিলেন
ঁনবৎসবহংপয বা অতিমানব। তারা প্রকৃতিতে গড়পড়তা স্ত্রী-পুরুষ থেকে একেবারেই
আলাদা, কিন্তু মনুষ্যÑপ্রজাতি থেকে তারা স্বতন্ত্র কোনও প্রজাতি রূপে
কল্পিত কিনা তার স্পষ্ট নির্দেশ নীৎমের রচনাবলীতে আমি অন্তত পাইনি। যা
পেয়েছি তা হল এই সম্ভাব্য অতিমানবদের চরিত্র সম্পর্কে নীৎশের বিভিন্ন লেখায়
কিছু কিছু নকসা বা পরিলেখ। ১৮৮১ সালে লেখা গড়ৎমবহৎড়ঃব গ্রন্থে লিখেছেন:
“তারা নির্ভীক, জীবন রসিক, তাদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল, কোনও সংকটেই তারা
কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা ভোগবৃত্ত হয় না। তারা যেমন জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ
করে, মৃত্যুকেও তারা তেমনি স্বাগত করতে জানে।”
পরের বছর প্রকাশিত ঞযব
লড়ুভঁষ রিংযফড়সÑএ পড়ি: “অসাধারণ এই মানুষরা ধীর, স্থির, প্রসন্নচিত্ত;
বিপদের মধ্যে বাস করতে তারা ভালবাসে; মানচিত্রহীন উত্তাল মহাসমুদ্রে তারা
তরী ভাসায়; অজেয়কে জয় করতে তারা উদ্যোগী; তারা জীবনশিল্পী, কারণ তারা
নিজেদের প্রয়াসেই নিজেদের গড়ে তোলে। আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম বলেই তারা যথার্থ
স্বাধীন, তারা স্বাভাবিককে পূর্ণ মূল্য দিয়ে সৌন্দর্য রচনা করে। যেমন
প্রবল তদের ক্ষমতার অভিলাষ তেমন সহজেই তাদের শাসন অন্যরা মেনে নেয়।
১৮৮৭
সালে ঞড়ধিৎফং ঃযব মবহবধষড়মু ড়ভ সড়ৎধষং -এ: “সাধারণ থেকে স্বতন্ত্র এই
মানুষরা প্রচলিত সমস্ত প্রত্যয়, মূল্যগ্রাম এবং রীতিনীতির সম্পূর্ণ নতুন
করে মূল্যায়ন করে। এবং তারা জানে এই মৌলিক মূল্যায়নের অবশ্যম্ভাবী ফল
বৌদ্ধিক ও নৈতিক নৈরাজ্য বা শূন্যবাদ। কিন্তু এই চেতনার দ্বারা তারা অভিভূত
হয় না, কারণ নবতর মূল্যগ্রামের তারা সন্ধানী। অবশ্য তারা জানে, তাদের
সন্ধান ফলপ্রসু হবে এমন সম্ভাবনা সুদূর পরাহত, ফলপ্রসূ হলে তা আবার যথাকালে
অস্তিত্বপ্রবাহে বিলুপ্ত হবে। সাফল্যের অনিশ্চয়তা তাদের উদ্দীপিত করে,
কারণ এই উদ্যমের ভিতর দিয়েই তাদের বিশিষ্টতা স্বপ্রকাশ। ঞযব লড়ুভঁষ
রিংযফড়সÑএ আরেক জায়গায় লিখেছেন: “সব প্রচলিত বিশ্বাসকে বর্জন এবং নিশ্চিতির
আকাক্সক্ষাকে উচ্ছেদ করার ফলে যে আনন্দ, আত্মনিয়ন্ত্রণের যে শক্তি, ইচ্ছার
যে স্বাধীনতা তারা অনুভব করে, তার সামর্থ্যে মহাশূন্যতার সন্নিধানে তারা
নৃত্যপরায়ণ।” এবং পরিশেষে ঞযব রিষষ ড়ভ ঢ়ড়বিৎÑএর একটি অনুচ্ছেদে: “শুধু
মাত্র শাসনের মধ্যে এই অতিমানবদের সীমাবদ্ধ নয়। নানা সঞ্জীবনী ক্রিয়াকলাপের
ভিতরে প্রকাশ পায় তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিÑসৌন্দর্যে, সংস্কৃতি রচনায়,
আচার ব্যবহারে, চারিত্রিক ভয়হীনতায়, এমনকী অতি-বিমূর্ত তত্ত্বচিন্তায়। তারা
নানাভাবে জীবনের সম্ভোক্তা, নৈতিকতার অত্যাচারকে অগ্রাহ্য করার মতো তারা
শক্তিধারী, তারা এতটাই সম্পন্ন যে কী হিসেবীপনা কী লোক-দেখানো আতিশয্য
কোনওটারই তাদের প্রয়োজন ঘটে না। তারা ভালমন্দের সীমানা অতিক্রম করেছেÑতারা
অভিজাত।”
তাঁর কোনও কোনও লেখায় নীৎশে শিল্পী এবং কবিদের এই অতিমানব
গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ, বিভক্ত, বিখণ্ড, নি®প্রাণ উপাদান সমূহকে
তারা একটি প্রাণবন্ত সমগ্রতায় রূপান্বিত করে। তাদের সৃজনশক্তি শুন্যতা এবং
নৈরাশ্যকে রূপান্তরিত করে আত্মম্ভর সৌন্দর্যে। শূন্যতার সঙ্গে মোকাবিলার
যন্ত্রণা ও উল্লাস খাঁটি শিল্পীরাই জানে। যথার্থ কবি ও শিল্পী মাত্রই
বিপ্লবী। তাদের অনুভবে অস্তিত্বের বহমানতা প্রত্যক্ষ; তারা জানে যা
প্রতিষ্ঠিত ও প্রাচীন তার বিলোপ অনিবার্য। উপাদানের ওপরে তাদের ক্ষমতাকে
শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করার সময়েও তারা অনিত্যতার অবশ্যম্ভাবী ট্র্যাজেডি
বিষয়ে পূর্ণ সচেতন। শিল্পকর্মের সূত্রে মানুষ প্রাকচেতন অস্তিত্বকে খুঁজে
পায়। ধ্বংসের অনিবার্যতার মুখোমুখি হয়ে ব্যক্তির চেতনা যুগপৎ ত্রাসে এবং
উল্লাসে আক্রান্ত হয়। শিল্প উচিত-অনুচিত নির্দেশের বাইরে। এপোলো ও ডাওনোসিস
যে একই অস্তিত্বের অচ্ছেদ্য দুটি মুখ, মহত্তম শিল্পে এই সত্য স্বপ্রকাশ।
নীৎশের
সঙ্গে পরবর্তী কালের ফাসিষ্ট প্রতিন্যাশের নাড়ির যোগ সেটি মোটেই
অপ্রত্যক্ষ নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা সাম্যের আদর্শকে নীৎশে প্রবলভাবে
ঘৃণা করতেন। তাঁর ভাষায়: “গণতন্ত্র ব্যক্তিকে পর্যবসিত করে অতিক্ষুদ্র,
গোলাকার, পলকা, বালুকণায়”। “গণতন্ত্রে সকলেই তুল্যমূল্য; যেখানে সংখ্যার
প্রাধান্যে যারা নিতান্ত নিকৃষ্ট তারা প্রতিভাসম্পন্ন গুণীজনকে বিনাশ করে
গুণহীন গড়পড়তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে।” “প্রকৃষ্টজনদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার
প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ ছাড়া সভ্যতা-সংস্কৃতির অকল্পনীয়।” নীৎশের দৃষ্টিতে
সাধারণ স্ত্রী-পুরুষ কোনওদিনই ব্যক্তিত্ব অর্জন করে না। শোপেনহাউয়ারের মতো
নীৎশেও উচ্চণ্ড নারীবিদ্বেষী। জরথুস্ত্রতে লিখেছেন, “স্ত্রী-পুরুষদের
বন্ধুত্ব অসম্ভব। আসলে মেয়েরা পুরুষদের সম্পত্তি মত।” নীৎশের সমালোচকরা
সঙ্গত কারণেই মনে করেন তাঁর এই গণতন্ত্র-বিরোধী মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়াশীল
উক্তি নাৎসি এবং ফাসিষ্টদের বিকৃত বুদ্ধির পোষণে সহায়তা করেছিল।
আগেই
লিখেছি নীৎশে কল্পিত ‘অতিমানব'দের চরিত্রে তিনি কিছু কিছু গুণ আরোপ
করেছিলেন যা মোটামুটি আকর্ষণীয়। ধীর স্থির, প্রসন্নচিত্ত, নির্ভীক,
আত্মনির্মাণে সমর্থ, প্রচলিত রীতিনীতি বিশ্বাাসের আগাগোড়া নতুন করে
মূল্যায়নে উদ্যোগী, শিল্প এবং সৌন্দর্যের স্রষ্টা এবং ভোক্তা,
স্বাধীনবৃত্তি ও অনিয়ন্ত্রিতÑস্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এ সব গুণের যারা
অধিকারী তারা অবশ্যই সম্মানীয়। নির্দ্বিধায় বলা যায় নাৎসি বা ফাসিষ্টরা
অতিমানবদের এই মডেল অনুসরণ করেনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও অবশ্য লক্ষণীয়
যে নীৎশে তাঁর কল্পিত ‘অতিমানব'দের চরিত্র থেকে এমন অনেকগুলি গুণ বা
প্রবণতাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয় বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেগুলির অভাবে
ব্যক্তির জীবন অসহনীয় এবং সমাজজীবন শুধু দ্বন্দ্ব সংকুল হতে বাধ্য। প্রেম,
সৌহার্দ্য, মমতা, করুণা, দুর্বলের প্রতি সবলের দায়িত্ববোধ, সেবাবৃত্তিÑএ
সবই নীৎশের বিচারে দাসভাবের লক্ষণ এবং সে কারণে ক্ষমতার সাধকদের পক্ষে
সযত্নে বর্জনীয়। তিনি এ কথাও খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে নির্বোধ গড়পড়তা
জনগণের ওপরে নব সভ্যতা চাপিয়ে দেবার জন্য যদি “অতিমানব” শাসকদের নিষ্ঠুর
বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয়, তা তাঁর বিচারে সঙ্গত। নীৎশের নৈতিক শূন্যবাদের এই
মারাত্মক ব্যবহারিক নির্দেশ আরও অনেকের মতো আমার বিচারেও পুরোপুরি অগ্রহণীয়
মনে হয়।