আমাদের
দেশে বহুদিনের রীতি-পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই শুরু হয় তার
বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা আর দোষারোপের পালা। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২০২৫
সালের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা
অপ্রত্যাশিতভাবে কমে যাওয়ায় অনেকের কাছেই এটি যেন এক হঠাৎ ধাক্কা। গত দেড়
দশক ধরে অভ্যস্ত ছিলাম ক্রমবর্ধমান পাসের হার আর জিপিএ-৫ পাওয়ার বিজয়মাল্য
দেখে-ফলে এই পতন যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না অনেকে।
তবে আশ্চর্য ব্যাপার
হলো, ফলাফল যখন হঠাৎ ভালো হতে শুরু করেছিল, সেই সময় কিন্তু তেমন প্রশ্ন
উঠেনি! বরং রাষ্ট্রীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল ফল প্রকাশ। বিস্ময়করভাবে গত এক
যুগে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা এমনভাবে বেড়েছে যে, ‘অতি ভালো ফল’ই হয়ে
উঠেছে সন্দেহের বিষয়। শিক্ষার্থীদের মুখে ক্যামেরা সামনে ইংরেজিতে বলা ‘আই
অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ জাতীয় বাক্য শুনে জাতি যেমন হতচকিত হয়েছে, তেমনি হতাশও।
মেধার প্রকৃত মানদণ্ড কোথায়, সেই প্রশ্নটা বারবার উঠেছে-কিন্তু উত্তর
মেলেনি।
পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর দৌড়ে যেভাবে প্রতি বছর ‘সাফল্যের’ গল্প
রচিত হয়েছে, তা এক সময় গুণগত শিক্ষার জন্য এক ভয়াবহ কর্কট রোগে পরিণত
হয়েছে-এ সত্য এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বারবার উচ্চারিত হয়েছে
মানসম্মত শিক্ষার দাবি, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা গেছে। এক
অদ্ভুত কারণে পুরো ব্যবস্থায় যেন কেবল ‘পাস করানো’ই হয়ে উঠেছে চূড়ান্ত
লক্ষ্য। ফলে পাঠ্যবই নয়, নম্বরই হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীর একমাত্র অনুসন্ধান।
এই পরিসংখ্যান-ভিত্তিক উৎসবের মাঝে হারিয়ে গেছে পাঠের আনন্দ, বোধের গভীরতা
আর শেখার মান।
এসব মেধাবীরা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য সেটি প্রমাণিত হয়েছে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। দেশ এখন শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায়
পরিণত হয়েছে। যারা অদক্ষ কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত! তবে ফেল করা শিক্ষার্থীর
সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবশ্যই কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে?
ফেল করার দায়টা
সত্যিই কার? কেবলই শিক্ষার্থীর? পড়াশোনা না করার দায় কি তার একার? নাকি এর
পেছনে আছে সেই শিক্ষক, যিনি সারা বছর পরিশ্রম করেছেন-বা হয়তো করেননি? কিংবা
পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই কি প্রশ্নের মুখে? আসলে ছিদ্রটা কোথায়, যেখান
দিয়ে বারবার টাল খায় আমাদের পাঠদান আর মূল্যায়নের কাঠামো?
বছরের পর বছর
ধরে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে একটি বিতর্ক বিদ্যমান ছিল-বিশেষ করে আওয়ামী লীগ
সরকারের টানা দেড় দশকে ফলাফলের পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা অনেক সময়
অবিশ্বাস্যভাবে উচ্চ ছিল। শিক্ষাবিদদের অনেকেই দাবি করে আসছিলেন, এসব
ফলাফল ছিল ‘ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে’ তৈরি করা, যার পেছনে ছিল একটি রাজনৈতিক সফলতা
তুলে ধরার প্রবণতা রয়েছে।
অনেক সময় প্রশ্ন উঠেছে-যে শিক্ষাপ্রবাহে
শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির হার কম, পাঠদানে ঘাটতি প্রকট, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ
দুর্বল, সেখানে প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কিভাবে পাস করছে?
তবে
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সেই চিত্রে এক ধরনের নীতিগত পরিবর্তন এসেছে বলে মনে
করছেন শিক্ষাবিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। খাতা মূল্যায়নে এবার নাকি নির্দেশ
ছিল-‘যার যা প্রাপ্য, সে তাই পাবে’-অর্থাৎ নম্বর দেওয়া হবে যথাযথভাবে,
অতিরিক্ত নম্বর বা নমনীয়তা দেখানো হবে না। দীর্ঘদিন ধরে ‘সেক্রিফাইস নম্বর’
বা ‘শিক্ষকের নম্বর’ নামে পরিচিত যে নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীকে পাস করানো
হতো, এবার তা দেওয়া হয়নি।
এর ফলে পাসের হার কমেছে, কিন্তু অনেকের মতে এই ফলাফল বাস্তবতার কাছাকাছি।
যদি
এটা সত্যি হয়, তাহলে এটা শুধু এক বছরে ফল খারাপ হওয়ার ব্যাখ্যা নয়-বরং
এটিও বুঝিয়ে দেয়, পূর্ববর্তী বছরগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা কতটা
আড়াল করা হয়েছে।
ফলাফল-কৃত্রিমভাবে পাসের হার ধরে রাখার আনন্দে আমরা
হয়তো একটি গভীর শূন্যতার ভিত তৈরি করে ফেলেছি। এই কারণেই এবারের ফলাফলটা
এতটা অস্বস্তিকর। কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে-এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর
অকৃতকার্য হওয়াও তো সমাধান হতে পারে না।
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের
পরীক্ষার ফলাফলে যেটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, তা হলো-গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে
পাসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া।
দেশের এগারোটি শিক্ষা বোর্ডেই এই
দুই বিষয়ে পাসের হার কমেছে, যা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং গোটা
শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে গেঁথে থাকা এক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বা প্রাতিষ্ঠানিক ও
কাঠামোগত সংকটের ইঙ্গিত বহন করে।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছর ঢাকা বোর্ডের ৯৪
দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করেছিল। কিন্তু এবার এ বোর্ডে
ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
রাজশাহী বোর্ডে গত বছর ৯৬ দশমিক ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করলেও এবার সে হার ৯৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
কুমিল্লা বোর্ডে গত বছর ৯৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করলেও এবার সে হার দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে।
চলতি বছর বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে ৬৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পাস করেছেন, যা গত বছর ছিল ৯৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
এবার এগারোটি শিক্ষা বোর্ডেই গণিতে পাসের হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
ময়মনসিংহ বোর্ডে ৬৪ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্ধী গণিতে পাস করেছে, গতবছর এ হার ছিল ৮৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বরিশাল বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী, যে হার গত বছর ছিল, ৯২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
অন্যান্য বোর্ডগুলোতেও গণিতে পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে।
গণিত
ও ইংরেজি-এই দুটি বিষয় বৌদ্ধিক দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞানের মূল ভিত্তি। এই দুই
বিষয়ে বিপর্যয় মানে শুধু পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া নয়-এর অর্থ হচ্ছে একটি
প্রজন্ম বিশ্ব নাগরিক হবার যাত্রাপথে পিছিয়ে পড়ছে। শুধু ফলাফলের পরিসংখ্যান
নয়, প্রশ্ন করতে হবে পাঠ্যবই, শিক্ষকের দক্ষতা, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও
মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, গণিত ও ইংরেজি-এই দুই বিষয়ে
শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই প্রাইভেট, কোচিং, টিউশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে
থাকে। তবুও যখন ফলাফল খারাপ হয়, সবার আগে দায়ী হিসেবে উঠে আসে এই দুই
বিষয়ের নাম। এর পেছনে বড় একটি দায় অবশ্যই শিক্ষকদের ওপর বর্তায়-কারণ বছরের
পর বছর একই ধরনের রুটিনমাফিক শেখানো, ধারণা নয়, কেবল নিয়ম মুখস্থ করানো,
গণিত ও ইংরেজিকে শেখার আনন্দ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
আমরা বরাবরই বলে
এসেছি, শুধু পাসের হার নয়, চাই মেধার বিকাশ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে
হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ফেল করিয়ে সেই মেধা যাচাই করতে হবে। বরং এই ধারার
বিপরীতে আমরা প্রতি বছর দেখতে পাই-ফেল করা কিশোর-কিশোরীদের কেউ কেউ বেছে
নিচ্ছে আত্নহননের পথ। এটা শুধু দুঃখজনক নয়, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গভীর
লজ্জার।
শিক্ষাকে আমরা এমন এক বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তর করেছি, যেখানে
পাস বা ফেল হয়ে উঠেছে সামাজিক মর্যাদা কিংবা আত্মমর্যাদার মাপকাঠি। ফলাফল,
ব্যর্থতা আজ আর ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা নয়-বরং হয়ে উঠেছে চূড়ান্ত পরাজয়ের
প্রতীক। এই চিত্র বদলানো জরুরি। আমরা যেমন চাই না সবাইকে অন্ধভাবে পাস
করিয়ে দেওয়া হোক, তেমনি এটাও চাই না যেন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ঢাকতে
গিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়।
একটি পাবলিক
পরীক্ষার পাসের হার কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়-এর মাধ্যমে পুরো
শিক্ষাব্যবস্থার মান ও কার্যকারিতা প্রতিফলিত হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন
ধরে সেই মান বোঝা সম্ভব হয়নি, কারণ চলেছে এক ধরনের ‘পাস-পাস’ খেলা। আর এই
খেলায় ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। ফলাফল হিসেবে সবচেয়ে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষা কাঠামো।
যে কোনো ভাঙা প্রথা নতুন
করে গড়তে সময় লাগে-তেমনই মেধাভিত্তিক শিক্ষায় রূপান্তরেও প্রয়োজন ধৈর্য ও
প্রস্তুতি। যদি সত্যিই মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় পাসের হার
কমে, তাহলে তা নিয়ে আফসোসের কিছু নেই। বরং এই হারের পতনের কারণ খুঁজে বের
করে তার প্রতিকার করাই এখন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
শিক্ষার্থীদের
ব্যর্থতার দায় কেবল তাদের একার নয়-এই দায় গিয়ে পড়ে শিক্ষকের অদক্ষতা কিংবা
গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির ওপরও। শিক্ষকদের যদি দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়,
তাহলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব। কারণ, পরীক্ষা মানে শুধু পাস বা
ফেল নয়-এটা একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক শেখার পরিপক্বতার প্রকাশ।
যারা
পাস করেছে, তারা নিঃসন্দেহে পরিশ্রম করেছে। কিন্তু যারা ফেল করেছে, তারা কি
সত্যিই মেধাহীন? যদি তাই হতো, তাহলে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন
শিক্ষার্থীও পাস না করার অর্থ কী? দু-একটি বিষয়ে ফেল করলেই কি তার সামগ্রিক
মেধা অস্বীকার করা যায়?
মেধা কেবল নম্বরে ধরা পড়ে না। সার্টিফিকেট
কখনোই কাউকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বানায় না। পৃথিবীতে বহু মানুষ আছেন, যারা
পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন না-তবু পরবর্তী জীবনে বিশাল অবদান রেখেছেন। এমন
উদাহরণ প্রচুর।
তাই আমরা যেমন চাই না অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে বানানো সাফল্য
তৈরি করতে, তেমনি চাই না প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফেল করুক,
হতাশায় ডুবে যাক। এ চিত্র আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নগ্ন রূপ তুলে ধরে।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করা, যাতে তারা
আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে-কোনো সেক্রিফাইস নম্বরের ভরসায়
নয়।
এবার অন্তত আমরা সার্টিফিকেট-নির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে
মানসম্মত ও মানবিক শিক্ষার পথে হাঁটি-যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী বিকাশের
সুযোগ পায়, ব্যর্থতা যেখানে হেরে যাওয়ার নয়, শেখার নতুন শুরু হবে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক