মানুষকে
ভাষা দিয়ে চেনা যায়, চেনা যায় ক্ষমতা দিয়েও। ভাষা বরঞ্চ অধিক বাঙ্ময়,
ক্ষমতার চেয়ে। মুখ খুললেই বক্তার পরিচয় হেসে-খেলে কিংবা রেগে-মেগে বের হয়ে
আসে। ভাষা পারে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিতে এবং যন্ত্রের মতো ঠেলে দিতে
পারে দূরে। কাছে টেনে নেওয়াটা বিশেষভাবে ঘটে প্রবাসে; প্রবাসে বাঙালি
মাত্রই বাঙালির মিত্র, শত্রুতে পরিণত হওয়ার আগে। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে, আমারও আছে বলে দাবি করতে পারি। আজ থেকে ৬৭ট্টি বছর
আগে আমি বিদেশে গিয়েছিলাম পড়তে। তখন আমরা পাকিস্তানি। সেই পরিচয়েই গিয়েছি
ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে। উর্দুভাষী যে পাকিস্তানিরা সহযাত্রী ছিল
আমার, তাদের কারও কারও সঙ্গে যে বন্ধুত্ব হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু বিদেশে
পা দিয়ে বাঙালি মাত্রকেই বন্ধু মনে হয়েছে, সে বাঙালি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক
হোক; ভারত-পাকিস্তান তখন শত্রুর সম্পর্ক, কিন্তু সেই শত্রুতা ভারতীয়
বাঙালিদের আপনজন ভাবার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি।
পরে, একাত্তর সালে,
ভাষার টানের আত্মীয়তাটা আবার দেখেছি, হিন্দু ধর্মের মানুষ মাত্রই কাফের ছিল
পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে; তবে এমন ঘটনা গল্পে নয় বাস্তবেই ঘটেছে,
বিমানবিহারীকে তার নাম শুনে তারা ছেড়ে দিয়েছে, বিহারি ভেবে, কিন্তু তাজুল
ইসলামকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেছে লোকটা জয় বাংলার মানুষ কি না সেটা
জানার জন্য। ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজের চোখে দেখেছি কাপ্তানবাজারের
কসাইপাড়ার যে বিহারিরা কসমখাওয়া পাকিস্তানি ছিল, বাঙালি নিধন যাদের ধর্মীয়
কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহারি এবং অবশ্যই
হিন্দিভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের কী অসামান্য দোস্তালি। জড়িয়ে
ধরছে, গলাগলি করছে, টেনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে, পাটনা ও মুঙ্গেরের খবর
আদান-প্রদান করছে। ধর্ম ও রাষ্ট্র মিথ্যা হয়ে গেছে ভাষার হাতে পড়ে। হ্যাঁ,
ভাষা এ ক্ষমতা রাখে বৈকি। রাখতে থাকবে।
তবু অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার চেয়ে
বেশি জোরদার হয় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থের শক্তি। সেই শক্তি ক্ষমতা রাখে
ভাষাকে জব্দ করার। বাঙালিরা যে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়েছে সেটা ভাষার কারণে
নয়, ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতির হাতে, সেই ক্ষমতার
বলীয়ান যারা ভূখণ্ডকে তারা দুই টুকরা করে ছেড়েছে। আর বাংলাদেশেও বাঙালিরা
যে এক নয়, তার কারণ কারও হাতে ক্ষমতা আছে, কারও হাতে ক্ষমতা নেই।
ক্ষমতাবানরা আগে ছিল অবাঙালি, এখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা বাঙালি পরিচয়েই
এসেছিল বটে, কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে বাংলাভাষা ব্যবহার করছে কম, কথাবার্তায়
বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে। যার কথায় যত বেশি ইংরেজি শব্দ, বুঝতে হবে সে
ব্যক্তি তত অধিক ক্ষমতাবান। অন্য প্রমাণের দরকার পড়ে না, ওই একটি প্রমাণই
যথেষ্ট, এ সত্য প্রমাণের জন্য যে ক্ষমতাবানরা বাঙালি থাকছে না, থাকতে চাইছে
না, যতই উঠছে ততই বিচ্যুত হচ্ছে তাদের আদি বাঙালিত্ব থেকে। এ ভূখণ্ডের
আদিবাসীরা আগের কালে ক্ষমতাবঞ্চিত ছিল, এখনো তাই। বাংলা ভাষা যখন
রাষ্ট্রভাষা হয় তখনো তা রাষ্ট্রের ভাষা হয় না। কেননা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা
তাদের হাতে নেই। রয়েছে তাদের হাতে, যারা বাংলা বলতে অনাগ্রহী।
ক্ষমতা যে
ভাষার চেয়ে জোরদার, সে অভিজ্ঞতা লাভ ওই আমার প্রথম প্রবাসকালেই ঘটেছিল,
ঢাকায় ফেরার পথে বাঙালির শহর কলকাতায় থেমে। কলকাতায় এসেছিলাম জল ও স্থলপথে।
জাহাজে যে কয়জন বাঙালি ছিল সবার সঙ্গেই খাতির জমেছিল, আমরা তিন বাঙালি তো
একই কেবিনে থেকেছি, ২০ দিন। করাচিতে একজন নেমে গেছে, সে জাহাজ ধরবে
অস্ট্রেলিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবব্রত আর আমি বম্বে (মুম্বাই) হয়ে
এসেছি কলকাতায়। হাওড়া রেল স্টেশনে পা দিয়েই মনে হলো দেশে ফিরেছি। আমার
ছেলেবেলার একটা অংশ কলকাতায় কেটেছে, ১৩ বছর পরে সেখানে এসে আপনজনদের দেখতে
পেলাম, যদিও কাউকেই আমি চিনি না, এক দেবব্রতকে ছাড়া।
বিকেলে পরিচিত
রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করেছি, চৌরঙ্গী এলাকায় কোনো সিনেমা হলে পাওয়া না
যাওয়ায় ভবানীপুরে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখেছি। সন্ধ্যার পরে দেবব্রতের সঙ্গে
ধর্মতলা, গড়ের মাঠ, পদ্মার ধার, এসব জায়গায় পায়চারি করেছি। অপ্রত্যাশিত
ঘটনাটা ঘটল পরের দিন সকালে। অতিপ্রত্যুষে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লোক আমাকে
জমা রেখে গেছে গ্র্যান্ড হোটেলে, পরদিন সকালে তাদের ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে
দমদম বিমানবন্দরে। বাক্সপেঁটরা নিয়ে নিচে নেমে দেখি হোটেলের কাউন্টারে কাজ
করছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। আমি উৎফুল্ল হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় চেয়েছি, যেন
আপনজন। তিনি বললেন, ‘বিলের টাকা দিন’। আমি বললাম, ‘সে তো দেবে ব্রিটিশ
কাউন্সিল।’ তিনি কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে বলেন, ‘না, তেমন কোনো চিঠি তার
টেবিলে নেই।’
গোলমাল আঁচ করে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারটি এগিয়ে এসে জানতে চাইল
ঘটনা। সে লোক কলকাতার আদিবাসী, কথা বলে বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে;
কাউন্টারের ভদ্রলোককে সে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমার সত্যবাদিতার বিষয়ে
সন্দেহ দেখা দিয়ে থাকলে ফোন করে আমার সাহেবের সঙ্গে কথা বললেই সব পরিষ্কার
হয়ে যাবে।’ বলে ফোন নম্বর দিল এবং আশ্বস্ত করল যে, তার সাহেবকে অবশ্যই
বাসায় পাওয়া যাবে; এত সকালে যাবেন আর কোথায়, নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত
ইংরেজ সাহেবকে জাগানো ঠিক হবে কি না, এ ব্যাপারে হোটেলের বাঙালি
কর্মচারীটিকে দ্বিধান্বিত দেখে লোকটি পকেট থেকে তার সচিত্র পরিচয়পত্র বের
করে বলল, ‘এই যে আমার নাম-ঠিকানা, সব লিখে নিন, দরকার হলে আমি সই করে
দিচ্ছি। কিন্তু আর বিলম্ব করবেন না। করলে প্লেন ধরা যাবে না।’ এতে কাজ হলো।
ড্রাইভারটি সই করল, আমি মুক্ত হলাম।
পথিমধ্যে সে তার মিশ্রিত ভাষায়
আমাকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করল। পার্টিশনের পরে সে ঢাকায় গিয়েছিল, কিন্তু নকরির
সুবিধা না দেখে অল্পদিন পরে ওয়াপস চলে এসেছে। সে মুসলমান, সেই হিসেবে আমার
নিকটজন, তাই বলেছে কথাটা। কথাটা হলো, আমি মস্তবড় ভুল করেছি কাউন্টারে বাংলা
বলে। আমি হচ্ছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের গেস্ট, ফিরছি লন্ডন থেকে কিন্তু সেটা
বোঝা যাবে কী করে, বাংলা বললে? যদি বাংলায় কথা না বলে ইংরেজিতে দাপট দিতাম,
তাহলে দেখা যেত কত সহজে কাজ হচ্ছে। কাউন্টারের ভদ্রলোক এতসব কথা বলতেন না,
চোখ তুলে তাকাতেনও না, ঘাড় গুঁজে কুইকুই করে আমাকে বিদায় দিতেন।
এ
আলোচনা আর যাতে না এগোয় সেই লক্ষ্যে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করি,
জানতে চাই ঢাকা তার কাছে কেমন লেগেছে। বলল, না, ঢাকা তার মোটেই ভালো
লাগেনি, খুবই গরিব শহর। দেখি বেশ দাপটের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে, একে তো
কলকাতার বাসিন্দা, তদুপরি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। শহর ছেড়ে শহরতলির
ভেতর দিয়ে চলছে গাড়ি, চারপাশে মানুষ জেগে উঠছে, তাদের ভাষা বাংলা, কিন্তু
তাদের হাতে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা অবাঙালির হাতে। গ্র্যান্ড হোটেলের
নিম্নপদস্থ কর্মচারীটিই শুধুই বাঙালি, তার ওপরের সবাই উত্তর ও দক্ষিণ
ভারতীয়। ওই অবস্থানে থাকলে আমিও হয়তো অমন আচরণই করতাম, কাউন্টারে বাঙালি
ভদ্রলোক যেমনটা করেছেন আমার সঙ্গে।
এটা ১৯৬০ সালের কথা। তার পর অবস্থার
যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে এখন একুশে
ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়, আরও বড় খবর এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে
অফিস-আদালতে এখন থেকে বাংলা ব্যবহার করা হবে, ইংরেজির পরিবর্তে। কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গ তো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, সে ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র, সীমানা
পার হলেই বাংলাভাষা হারিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ পরিণত হন একজন প্রাদেশিক
কবিতে। একদিন তার গান ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছিল, কিন্তু সেটা
অতীতের ব্যাপার, একালে হলে পেত না। একালে অন্য ক্ষমতা তো বটেই, সাংস্কৃতিক
ক্ষমতাও চলে গেছে অন্যদের হাতে। আগের দিনে বাঙালি লেখকরা ইংরেজি ছেড়ে
বাংলায় লিখতেন। কেননা, দেশ তখন প্রত্যক্ষরূপে পরাধীন ছিল এবং পরাধীনতাকে
তারা পরাধীনতা বলেই জানতেন। আজকের দিনের পরাধীনতাটা অপ্রত্যক্ষ, যে জন্য
পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে মনে করা সম্ভব হচ্ছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
তার মাইকেল পরিচয় ফেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মধুসূদন হতে চেয়েছিলেন, আজকের
দিনের কোনো মাইকেল অমনটি করবেন না। তিনি বরঞ্চ তার মধুসূদনত্বকেই বর্জন
করতে চাইবেন। মাইকেল সত্তাকে উচ্চে তুলে ধরবেন; লিখবেন ইংরেজিতেই কেননা, ওই
ভাষার ক্ষমতা বেশি, বাজারের কারণে। কোনো গ্লানি নেই।
বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক ভাষাই থাকবে, যতই উচ্চে উঠুক না কেন। প্রাদেশিক ভাষা হবে, সরকারি হবে না।
তাছাড়া
অর্থনৈতিক ক্ষমতাও তো বাঙালির হাতে নেই, যে হোটেলের মালিক অবাঙালি, তার
বাঙালি কর্মচারীটির সাধ্য কি সেই মালিকানায় পরিবর্তন আনে, সে বেচারা বাঙালি
গ্রাহক দেখলে বরঞ্চ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, ভাবে ঠকাবে, নয়তো পালাবে বিল
বাকি রেখে। বড় দোকানেও এমনই ঘটনা। কর্মচারীটি বাঙালি, ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে
রয়েছে অবাঙালি। বাঙালি কর্মচারী অবাঙালি ক্রেতা পেলে খুশি হয়, বাঙালি
আগন্তুক দেখলে ধরে নেয় নাড়াচাড়া করবে, কিনবে না। সব মিলিয়ে সত্যটা এই যে,
দপ্তরে যাই হোক, ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার মোটামুটি নিষিদ্ধ।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়