শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২
মাদক নিয়ন্ত্রণ করা কেন সম্ভব হচ্ছে না
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫, ১:৩৬ এএম |


 মাদক নিয়ন্ত্রণ করা কেন সম্ভব হচ্ছে না
গত ২৬ জুন খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘মাদকের হাট অনলাইনেও রমরমা’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন পড়ে রীতিমতো চমকে উঠলাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘মদ বাজার’ নামে একটি পেজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে ওই প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম। 
সারা দেশে যেখানে মাদকের ভয়াবহ থাবায় তরুণসমাজ ধ্বংস হওয়ার পথে, সেখানে বাড়তি উদ্বেগ বাড়িয়েছে অনলাইনে মাদকের এমন প্রচার। এ প্রবণতা যদি খুব শিগগিরই থামানো না যায়, তাহলে আমাদের তরুণ সমাজের ভয়াবহ অবক্ষয় অপেক্ষা করছে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোথায় কী ধরনের মাদক পাওয়া যায়, সে-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য উল্লেখ করে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেওয়া কতটুকু আইনসম্মত, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে মাদক গ্রহণ এবং মাদক বেচাকেনার সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে, সেখানে গোটা দেশের তরুণ সমাজকে টার্গেট করে মাদক বিক্রির প্রচার চালানোর বিষয়টি খুব শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখছি।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানলাম, দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ। মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা যদি ৮৩ লাখে পৌঁছে যায়, তবে সেটি দেশের মাদক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি নির্দেশ করে। এটা প্রমাণ করে, দেশে মাদক একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়। অথচ এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখের কিছু বেশি। দেখা যাচ্ছে, গত সাত বছরে মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি (খবরের কাগজ, ২৬ জুন ২০২৫)।
মাদক বিস্তারের ফলে তরুণদের একাংশের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তি বাড়ে। সমাজে অপরাধ বাড়ে। হানাহানি এবং নিরাপত্তাসংকট চরমভাবে বেড়ে যায়। মাদকাসক্তরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার (আংকটাড) রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু মাদকের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার হয়, যা অবৈধ মাদক কারবারে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বে পঞ্চম এবং এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে রেখেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর কার্যকর ফল এখনো আমাদের হাতে ধরা দেয়নি। এর পেছনে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষই নানাভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি আমাদের দেশে মাদক চোরাচালানের একটি ভয়াবহ বিষয় হলো নারী, শিশু এবং কিশোরদের এ ধরনের গর্হিত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
বিশ্বজুড়ে মাদক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত, যা শুধু একজন ব্যক্তির নয়, একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আজ বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ মাদক নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় সফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এমনকি মাদকের প্রচার-প্রসার বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে। এ কেমন পরিবেশ, ভাবতে অবাক লাগে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র মাদক নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশেও অনুসরণ করে সফলতা পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
পর্তুগাল প্রায় দুই যুগ আগে মাদক ব্যবহারে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মাদকসেবনকে অপরাধ হিসেবে নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে। এর ফলে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য মাদক বহনের অপরাধীকরণ তুলে দেওয়া হয় এবং সেবনকারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়। এতে করে মাদকজনিত মৃত্যুর হার, এইচআইভি সংক্রমণ এবং অপরাধ অনেকাংশে কমে যায়। পর্তুগাল দেখিয়েছে, শাস্তি নয়, সচেতনতা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
নেদারল্যান্ডসে ‘হার্ম রিডাকশন’ নীতির আওতায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কঠোর আইনের পাশাপাশি মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ ইনজেকশন কেন্দ্র, চিকিৎসা-সহায়তা এবং কাউন্সেলিং কার্যক্রম চালু রয়েছে। সরকার এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে সমন্বয় ও তথ্যভিত্তিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা মাদকব্যবসা ও আসক্তি দুই-ই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
এক সময় থাইল্যান্ড মাদকের জন্য কুখ্যাত ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে দেশটি ডধৎ ড়হ উৎঁমং নামক জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। পুলিশের কড়া নজরদারি, সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা এবং সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে সফলতা পায়। তবে এ অভিযান নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে, যা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
আইসল্যান্ড কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মাদক, অ্যালকোহল ও ধূমপান রোধে ণড়ঁঃয রহ ওপবষধহফ প্রোগ্রাম চালু করে। এর আওতায় স্কুলে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বাবা-মায়ের অংশগ্রহণ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। ফলে সেখানে মাদক গ্রহণের হার নাটকীয়ভাবে কমেছে।
বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাক্সিক্ষত ফল দিচ্ছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য মাদকচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ; (২) সীমান্তরক্ষীরা কেউ কেউ চোরাচালানে সহায়তা করার অভিযোগ; (৩) সমাজে মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অনেকেরই সচেতনতা নেই। ফলে তারা নিজের অজান্তেই আসক্তির পথে পা রাখে; (৪) দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু রিহ্যাব সেন্টার থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশই অদক্ষ, অব্যবস্থাপনায় ভরা এবং অর্থনৈতিকভাবে অপ্রতুল; এবং (৫) অনেক সময় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় মাদকব্যবসা চলে, যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
মাদক নিয়ন্ত্রণ একটি রাষ্ট্রের জন্য শুধু আইন প্রয়োগের বিষয় নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ। বিশ্বের অনেক দেশ সাহসিকতা, উদ্ভাবনী নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। বাংলাদেশকেও তথ্যভিত্তিক, মানবিক ও কঠোর কৌশল একসঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এখনই আমাদের জেগে উঠতে হবে, নতুবা মাদকের এ অন্ধকারে গোটা জাতি ডুবে যাবে। উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকেও একটি সুস্থ, সচেতন ও মাদকমুক্ত জাতি গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আরও অধিকতর সতর্ক হতে হবে গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে, যাতে মাদক বেচাকেনায় সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ যথাযথভাবে সমাজে আরোপ করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়












সর্বশেষ সংবাদ
ঘোষণা দিয়ে তিনজনকে হত্যা
‘রাতেই ফোনে হত্যার হুমকি দেয় বাছির’
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে হামলা
চার আসামির ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর
মুরাদনগরে ধর্ষণকাণ্ড- ভিডিও ছড়ানোর ‘মাস্টারমাইন্ড’ শাহ পরান আটক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে গণপিটুনি, কুমিল্লায় এক পরিবারের তিনজন নিহত
ফজর আলীর ভাই শাহপরানের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ
কুমিল্লায় ভেজাল ঘি ও নকল বৈদ্যুতিক তারের বিরুদ্ধে অভিযান, ৪০ হাজার টাকা জরিমানা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলীতে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত স্লাজ বর্জ্য
ঘোষণা দিয়ে তিনজনকে হত্যা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২