শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২
মাদকের কাছে কি হেরে যাবে আমাদের তারুণ্য?
শাহানা হুদা রঞ্জনা
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫, ১:৩৬ এএম |


 মাদকের কাছে কি হেরে যাবে আমাদের তারুণ্য?
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একদিন দুঃখ করে বললেন, ‘আমি আমার সবকিছু দিয়ে দিতে পারি যদি কেউ আমার ছেলেকে মাদকের হাত থেকে ফিরিয়ে এনে দিতে পারেন। ছেলেটি রিহ্যাব থেকে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরে আসছে, কিন্তু কয়েকমাস পর আবার আগের মতো আচরণ করছে। অকারণে রাগারাগি, গালাগালি, ভাঙচুর করে। কাউকে সহ্য করতে পারে না। আমার সন্তান কবে, কীভাবে এই নেশার জগতে ঢুকে গেছে, আমরা বুঝতেই পারিনি। আমাদের সব অর্জনই আজ ব্যর্থ।’
কোন পরিস্থিতিতে পড়ে একজন বাবা নিজেকে ব্যর্থ মনে করছেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। ঠিক এভাবেই মাদক আমাদের সন্তানদের ছিনিয়ে নিচ্ছে।
সেদিন পান্থকুঞ্জ-এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম চার-পাঁচজন কিশোর বসে পলিথিনের ব্যাগে ফুঁ দিচ্ছে। বুঝলাম ওরা ড্যান্ডি আঠা গ্রহণ করছে। এর আগেও এদের মতো পথশিশুদের দেখেছি প্রকাশ্যে নেশাজাতীয় দ্রব্য ড্যান্ডি গ্রহণ করতে। সারাদিনের সংগৃহীত ভাঙারি বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে একবেলা খাবার কিনে খায়, আর বাকি দুইবেলা নেশা করে তারা।
একইভাবে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং উত্তরাতে দেখেছি সন্ধ্যা নামার আগে জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ছোট ছোট জটলা করে ছেলেমেয়েরা গাঁজা টানছে। হয়তো অন্য তল্লাটেও এমনটা চলছে, আমি লক্ষ্য করিনি। এরা বয়সে তরুণ।
একদিন রাতে পাড়ায় দারুণ হল্লা হতে শুনলাম। রাগারাগি, গালাগালি, ভাঙচুরের শব্দ। পরে জানলাম পাড়ার মাদকসেবীদের মধ্যে কোন্দল। এরা সবাই বয়সে তরুণ, ছোট থেকে দেখছি। কিন্তু কবে যে ওরা এই জগতে ঢুকে গেছে জানতেও পারিনি।
প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ। মাদকাসক্তদের বেশিরভাগ পুরুষ। নারী ও শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তি রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক সমীক্ষায় মাদকাসক্ত জনসংখ্যার এই হিসাব প্রকাশিত হয়েছে।
তবে আমার ধারণা, এই সংখ্যা আরও বেশি। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা, বস্তি, পার্ক এলাকায় এখন মাদকসেবীদের ভিড়। অসংখ্য পরিবার বিপর্যস্ত মাদকের কবলে পড়ে।
প্রতিদিন পত্রিকায় রিপোর্ট থাকে কীভাবে মাদকসেবী সন্তান বাবা-মাকে নিগ্রহ ও নির্যাতন করে, আটকে রেখে টাকা ছিনিয়ে নেয়, নিজের ঘরেই চুরি করে, ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় শুধুমাত্র মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে। এছাড়া চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি মানুষ হত্যা করতেও দুবার ভাবে না।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলছেন, মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা যদি ৮৩ লাখে পৌঁছে যায়, তবে সেটি দেশের মাদক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি নির্দেশ করে। এটা প্রমাণ করে, দেশে মাদক একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি মনে করেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ গাঁজা ব্যবহার করে। এরপরেই প্রায় ২০ শতাংশ ইয়াবা গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা)। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
আমাদের দেশে যত ধরনের সমস্যা রয়েছে, এরমধ্যে অন্যতম ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে মাদক। দিন দিন মাদকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। শহর-গ্রাম সবখানেই মাদক সহজলভ্য। এর ক্রেতা শিশু থেকে বয়স্ক সবাই। শিশু, কিশোর ও তরুণরা এ জাতির ভবিষ্যৎ। অথচ এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এখন মাদকের কবলে। এদের ফেরাতে না পারলে শুধু পরিবার নয়, দেশটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
কেন দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে? কারণ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে মাদকাসক্তের প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী। বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে শিশু-কিশোররা সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ও কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। আর সহজলভ্য হওয়ায় ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলালউদ্দীন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলছেন, যারা মাদকাসক্ত, তাদের মধ্যে বড় অংশই তরুণ-যুবক। ফলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। সারা দেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্র এবং পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের যদি পুনর্বাসন করা না যায়, তবে তারা সমাজের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন।
পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, পরিবারে অবহেলা, আদর-যত্নের অভাব বা অতিরিক্ত আদর, অর্থ সংকট বা অর্থের আধিক্য, বেকারত্ব, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা ইত্যাদি কারণেও যুবসমাজ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে।
ক্যাম্পাসগুলো মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠায় বহিরাগতরাও নিরাপদে মাদক সেবনের জন্য ক্যাম্পাসে ভিড় করে। শুধু ক্যাম্পাস নয়, বিভিন্ন এলাকার মাঠগুলো, ক্লাব, অব্যবহৃত বাড়িঘর মাদকসেবীদের আড্ডায় পরিণত হয়েছে। এগুলো কিশোর গ্যাং এর আস্তানাও। ফলে এই এলাকাগুলোয় মাদক, অস্ত্র সবকিছুর জোগান সহজলভ্য।
তাহলে কি আমরা হাল ছেড়ে দেবো? আমাদের সন্তানের জীবন কি ধ্বংস হয়ে যাবে মাদকের ছোবলে? এই নীল দংশন থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে কী করবো আমরা? সবচেয়ে আগে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। এছাড়াও দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রয়োজন।  
বাংলাদেশের তারুণ্য মাদকের কাছে হেরে যাবে কিনা, তা নির্ভর করে সমাজ, সরকার, পরিবার এবং ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। মাদকাসক্তদের জন্য আলাদাভাবে সংশোধনাগার বানাতে হবে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ডোপ টেস্ট করাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এবং বছর বছর তা চালিয়ে যেতে হবে।
মাদকাসক্তদের জন্য যেমন রিহ্যাব দরকার, এরচেয়েও বেশি দরকার যারা মাদক বিক্রি করছে, যারা বিক্রি করাচ্ছে অর্থাৎ গড ফাদারদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা। পরিবারের উচিত হবে সন্তানকে বুঝিয়ে কাছে রাখা, ভালোবাসা দিয়ে ও খোলামেলা আলোচনা করে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
মাদকাসক্তি যেমন ব্যক্তিকে ধ্বংস করতে পারে, তেমনি একটি পরিবারকে ও জাতিকে ধ্বংস করতে পারে। মাদকাসক্তি পরিবারের সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক এবং শারীরিক স্থিতিশীলতাকে ভেঙে দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে একটি পরিবার ও দেশকে ধ্বংস করতে মাদকই যথেষ্ট। তাই এর হাত থেকে বের হতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে এবং সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ












সর্বশেষ সংবাদ
ঘোষণা দিয়ে তিনজনকে হত্যা
‘রাতেই ফোনে হত্যার হুমকি দেয় বাছির’
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে হামলা
চার আসামির ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর
মুরাদনগরে ধর্ষণকাণ্ড- ভিডিও ছড়ানোর ‘মাস্টারমাইন্ড’ শাহ পরান আটক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সকালে গণপিটুনি, কুমিল্লায় এক পরিবারের তিনজন নিহত
ফজর আলীর ভাই শাহপরানের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ
কুমিল্লায় ভেজাল ঘি ও নকল বৈদ্যুতিক তারের বিরুদ্ধে অভিযান, ৪০ হাজার টাকা জরিমানা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলীতে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত স্লাজ বর্জ্য
ঘোষণা দিয়ে তিনজনকে হত্যা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২