যুক্তরাষ্ট্র ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে জড়াবে কি না সেই সিদ্ধান্ত জানাতে স্বঘোষিত ‘শান্তির দূত’ ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ফলাও করে বলা হয়েছিল, এই সময়টি দেওয়া হয়েছে কূটনৈতিকভাবে সংকট সমাধানের জন্য। কিন্তু মাত্র দুই দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের ১২৫টি যুদ্ধবিমান একযোগে হামলা চালাল ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে। হামলার পর শান্তির দূত সহাস্যে বললেন, তাঁদের বাহিনী অত্যন্ত নিখুঁতভাবে হামলাটি পরিচালনা করেছে।
আর ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন গাজায় গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
মার্কিন হামলাকে ‘নির্লজ্জ’ বর্ণনা করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব বিকল্প খোলা রাখছে। আরাগচি বলেন, ‘কূটনীতির দরজা সব সময় খোলা থাকা উচিত, কিন্তু এই মুহূর্তে তা নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার দেশ হামলার শিকার হয়েছে, আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারের ভিত্তিতে আমাদের এর জবাব দিতে হবে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ‘আন্তর্জাতিক আইনের অমার্জনীয় লঙ্ঘন’।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্য রাষ্ট্র। তাদের এই কর্মসূচি সব সময় নজরদারির মধ্যেই থাকে। অন্যদিকে এনপিটিতে সই না করা ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশ।
তারা কখনোই আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। ইরান বারবারই বলেছে, তাদের পরমাণু গবেষণা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত। ইরান যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে তার কোনো প্রমাণ এ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করছে এমন অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও পাশ্চাত্যের কিছু দেশ। সংশ্লিষ্ট বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট।
আর সেই অভিযোগ নিয়ে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে প্রথমে ইসরায়েল, তারপর যুক্তরাষ্ট্র ভয়ংকর হামলা চালাল। মার্কিন বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকারবিধ্বংসী বোমা জিবিইউ-৫৭ ব্যবহার করল।
হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের অজুহাতের অভাব হয় না। ২২ বছর আগে ইরাক আক্রমণের আগে বলা হয়েছিল, দেশটির হাতে প্রচুর গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যা মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। আর পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো দিনে-রাতে তা প্রচার করে বিশ্ববাসীকে প্রায় বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ইরাক ধ্বংস করা হলেও সেখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এখন ‘একই অজুহাতে’ ইসরায়েলের ‘দোসর’ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানেও হামলা করেছে।
ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। পাশাপাশি খোদ মার্কিন রাজনীতিকদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই হামলাকে মার্কিন সংবিধানের চরম লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও বলেছেন, ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য নেতানিয়াহু অনেক আগে থেকেই ইরানে হামলা করতে চাচ্ছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই হামলার কারণে চলমান ‘সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পক্ষে বড় ধরনের ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানো দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিজিটিএন প্রশ্ন তুলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও ইরাকে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি ইরানে করছে? একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরো অনেক দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো বিপদগ্রস্ত করবে। জ্বালানি তেলের দাম এরই মধ্যে অনেক বেড়েছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তা আরো সংকট সৃষ্টি করবে। অর্থনৈতিক মন্দা ব্যাপকতর হবে। তা ছাড়া এটি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।