বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষ সবার জন্য সুযোগের সমতার কথা বলা হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের মতোই এ দেশের নারীরা অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থেকে ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। গত শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’র সমাবেশে এক ঘোষণাপত্রে নারীরা তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেছেন। ধর্ষণ, নিপীড়ন, অসমতা, অন্যায্যতা, শ্রমের অবমূল্যায়ন ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন নারীরা। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টাকে মেনে না নেওয়ার স্পষ্ট অবস্থানের কথা জানানো হয় ঘোষণাপত্রে।
ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এ দেশের নারীরা এখনো রাজপথে নামেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, এখনো দেশে নারী ও শিশুর প্রতি বৈষম্য রয়েই গেছে। যেখানে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই অভ্যুত্থানের সূচনা, সেখানে আমরা লক্ষ করছি নারী-পুরুষের বৈষম্য যেন ভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আধুনিক সময়ে এসেও নারীকে ঘিরে আলোচনা, সমালোচনা, ভেদাভেদ, রেষারেষি, তর্ক-বিতর্ক- এসব চলছেই। সম্প্রতি দেশে বেশ কিছু নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা খুবই হৃদয়বিদারক। মাগুরায় আলোচিত শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। মূল আসামি হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। এ রায়ের মাধ্যমে দেশে দ্রুত বিচার সম্পন্ন হওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হলো। এ রকম হাজারো মামলার জট খুলতে পারলে এই বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও আমরা লক্ষ করেছি, নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য উসকে দিচ্ছে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ দেশের নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করে আসছেন। কখনো কখনো রাজপথে দাঁড়িয়ে মিছিলে দাবি জানাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নারীবিষয়ক সংস্থার কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশন একটি প্রতিবেদনও তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এর পরই নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ রাজধানীতে সমাবেশ করে। সমাবেশে কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করার পর ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ ব্যানারে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠকরা। এ প্রজন্মের নারীরা রাস্তায় নেমেছেন তাদের বিরুদ্ধে যে ন্যক্কারজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আচরণ প্রকাশিত হচ্ছে, তারই প্রতিবাদ জানাতে। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা এ দেশে ঘটেছে। বর্তমান প্রজন্মের নারীরা অধিকার আদায়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।
সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন শ্রমজীবী নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে জনসমক্ষে। কমিশনের সদস্যদের নিয়েও কেউ কেউ সমালোচনায় লিপ্ত রয়েছেন। কমিশন বিলুপ্ত করার ব্যাপারেও কথা উঠেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আজ নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শরিক হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে চলা বৈষম্য ও সহিংসতা কমিয়ে আনতে সরকার আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, সেটিই প্রত্যাশা।