কাশ্মীরকে
কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ বিগত সাত দশক ধরে চলে আসছে, তা এই
দেশ দুটির সঙ্গে তাদের প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোকে বারবার রাজনৈতিক ও
কূটনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান কাশ্মীর
সংঘাত শুধুই কি দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক মল্লযুদ্ধ? নাকি সীমান্ত
সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর শক্তি প্রদর্শনের ব্যবস্থা?
নাকি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার উপলক্ষ-যে যুদ্ধে একে অপরের কাছে এসে নিরাপদ
দূরত্বে থেকে আক্রমণ করে?
বিগত সাত দশক ধরে ভারত ও পাকিস্তানের কাছে
কাশ্মীর তা-ই ছিল এবং এখনও রয়েছে। হয়তো এবার যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে,
তা-ও আগেকার যুদ্ধগুলোর মতোই শেষ হবে।এর থেকে যদি আরো একটু বেশি এগোয়, তা
হয়তো বা সীমান্তে এক রক্তক্ষয়ী এবং কিছু দিন স্থায়ী সংঘর্ষে রূপ নেবে। এর
কিছুকাল পরেই ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের সরকার জনগণের কাছে নিজ নিজ
বাহিনীর বীরত্বগাঁথা প্রচার করতে নেমে পড়বে। এই অহেতুক যুদ্ধে আত্মাহুতি
দিতে বাধ্য হওয়া কাউকে কাউকে যুদ্ধের নায়কে পরিণত করা হবে। অকালে প্রাণ
হারানো সেই নায়কদের নিয়ে তৈরি হবে সিনেমা। মাঝ থেকে কিছু মা তাদের তরুণ
টগবগে সন্তান হারাবে, কিছু স্ত্রী অকালে বিধবা হবে। ওই অভাগা মায়েদের জন্য
মায়াকান্না, বিধবাদে জন্য জাতীয় শোক ইত্যাদি পালিত হবে। আর এভাবেই মূল্যায়ন
করা হবে দুই দেশের মহান যোদ্ধাদের।
সবশেষ ২২ এপ্রিল পেহেলগামে
অস্ত্রধারীদের হাতে নিরীহ পর্যটক হত্যার ঘটনা আবার যুদ্ধের হুইসেল বাজিয়ে
জানিয়ে দিল ২০২৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চতুর্থবারের মতো কাশ্মীর ঘিরে
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হতে যাচ্ছে।
সত্যি বলতে কি ভারত এবং পাকিস্তান,
দুই দেশের নেতাদের কেউই কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান না। যদি সত্যি
সত্যি দুই দেশেরই সদিচ্ছা থাকত, তাহলে এই সমস্যার সমাধান ৭৫ বছরের আগেই হয়ে
যেত। মনে-প্রাণে চাইলে রাজনৈতিক নেতারা যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম
এই নজির বিশ্বজুড়ে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে।
কেন এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা?
যুদ্ধে
যদি কোনো সমাধান না আসে, তাহলে এই সমস্যা জিইয়ে রেখে দুই দেশই কেন সাধারণ
নাগরিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়? বিশ্ববাসীকে কেন ধোঁকা দেওয়া হয়? এর
পেছনের উদ্দেশ্য খুবই সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্কোর অর্জন করা। এসবের মূল
উদ্দেশ্যই হয় পরবর্তী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বা জাতিগত সহিংসতা অথবা অন্য কোনো জটিল সমীকরণের ফল
মেলাতে না পেরে দেশের মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে ফেরানো।
ভারত ও
পাকিস্তানের মধ্যে এবারের যুদ্ধও সীমিত আকারের সীমান্ত যুদ্ধের মধ্যেই
সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। প্রশ্ন আসতে পারে এতটা
নিশ্চিত হলাম কি করে?
পাকিস্তান এবং ভারত দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর
দেশ। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়
না নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্যই। এই নিরাপত্তা তারা নিশ্চিত করে বাই ‘দ্য
থিওরি অব ডেটারেন্স’- পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো নিউক্লিয়ার ক্রেডিবিলিটি
নিশ্চিত করে নিজ নিজ পদ্ধতিতে। এর আরও একটি প্রমাণ হলো দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ অবধি পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর কোনোটিই একে
অপরের বিরুদ্ধে অল আউট ওয়ারে লিপ্ত হয়নি। ভারত-পাকিস্তানও একই যুক্তিতেই
সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হবে না।
পারমাণবিক যুদ্ধের পর যে ভয়াবহ মানবিক ও
অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে তা কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা দুই দেশের কারোরই নেই। এমন
কি পাকিস্তান বা ভারত কারই সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা
নেই। প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে প্রক্সি ওয়ার চালানো সামরিক পয়েন্ট
অফ ভিউ থেকে তুলনামুলকভাবে লাভজনক হলেও সর্বশেষ আফগানিস্তান থেকে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান, এর আগে ইরাক ও সিরিয়া থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের
প্রস্থান থেকে বোঝা যায় পাকিস্তানের পক্ষে নন স্টেট অ্যাক্টরদের দিয়ে
প্রক্সি ওয়ার চালানো আর লাভজনক তো নয়ই, এমনকি এধরণের কর্মকাণ্ড পাকিস্তানকে
কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপদগ্রস্থ করে ফেলেছে। তাই এই পথও
পাকিস্তানের জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া দেশের ভেতরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলোর
সঙ্গে যে সব যুদ্ধ চলমান রয়েছে, সেগুলোর কোনো সহজ সমাধান বের করা
পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
যুদ্ধের ফলাফল কি হতে যাচ্ছে?
দৃশ্যকল্প-১:
ভারত পাকিস্তান দুই পক্ষই চেষ্টা করবে লাইন অব কন্ট্রোল স্থিতিশীল রেখে
সামরিক শক্তি প্রদর্শন করবে এবং আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের কুটনৈতিক প্রভাবে
বা মধ্যস্থতায় নিজেরা যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে সরে এসে আলোচনার টেবিলে বসবে।
এতে দুই পক্ষই মুখরক্ষার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার
পরিস্থিতি কিছুটা অস্থিতিশীল হলেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এই যুদ্ধের
আপাতত বিরতি হবে। ভারত এবং পাকিস্তান দুই পক্ষই নিজ নিজ দাবির কিছুটা ছাড়
দিয়ে হলেও আলোচনার টেবিলে ফিরে এসে আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার
সমাধানের রাজনৈতিক পথ উম্মুক্ত করতে পারে। দুই দেশই তাদের অর্থনৈতিক
বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে বড় ধরনের আত্মঘাতী যুদ্ধ এড়াতে চেষ্টা করবে।
দৃশ্যকল্প-২:
যদি দুই দেশেরই প্রাথমিক অভিযানসমূহ একে অপরের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে তাহলে
তারা হয়তো যুদ্ধের সীমানা আকাশযুদ্ধ, নৌযুদ্ধ এবং সীমিত আকারে সীমান্ত
যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে নিজ দেশের জনগণকে সাফল্য দেখাতে চাইবে। যতক্ষণ
পর্যন্ত তাদের লক্ষ্য অর্জনের সফলতা না দেখাতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিরতি
দিয়ে দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
এতে অবশ্য সীমান্তসংলগ্ন সাধারণ বেসামরিক
নাগরিকদের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হবে। তারা অহেতুক ‘কোল্যাটেরাল
ড্যামেজের’ শিকার হবে। তারা নিজ নিজ ভূখণ্ডে পশ্চাদপদ হবার কারণে এরই মধ্যে
দুর্বল অবকাঠামোকে তাদের নিয়তি মেনে নিয়ে সংগ্রাম করে চলছিল। কিন্তু এই
যুদ্ধে সেই ভঙ্গুর অবকাঠামো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা এই এলাকার বাসিন্দাদের
জন্য এক অভিশপ্ত জীবনের অভিজ্ঞতা হবে। একইসঙ্গে এই যুদ্ধ ভারত মহাসাগর
পর্যন্ত গড়িয়ে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য এক অনিরাপদ ও
যুদ্ধকবলিত এলাকায় পরিণত হবে, যার প্রভাব হবে বিশ্বব্যাপী।
দৃশ্যকল্প-৩:
ভারত-পাকিস্তান দুপক্ষই মিসাইলসহ দূরপাল্লার কনভেনশনাল অস্ত্রের ব্যবহার
করবে। ফলে প্রতিপক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এই যুদ্ধ
দ্রুত এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যার ফলে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে এই যুদ্ধ
পারমাণবিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এর ফলে সমগ্র
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো একত্রে ভারত ও পাকিস্তানকে এই আত্মঘাতী
যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিতে থাকবে। যা ভারত ও পাকিস্তানকে মুখোমুখি বসে
কাশ্মীর সমস্যার সমাধান খোঁজার চাপ তৈরি করবে। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধও
ফলাফলবিহীন এক যুদ্ধে পরিণত হবে।
বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে?
১.
জুলাই বিপ্লব এবং শেখ হাসিনার বিদায়, ভারতে তার আশ্রয়, আওয়ামী লীগের পলাতক
এমপি ও সিনিয়র নেতাকর্মীদের ভারতে আশ্রয় এবং সেখান থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য
দেয়া; ভারতে বসে বাংলাদেশের ভেতরে বাংলাদেশের সমাজে চলমান বিভাজন রেখাগুলো
আরও স্পষ্ট করে দেখানোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক
অস্থিতিশীলতাকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে পারে।
২. শেখ হাসিনার পতনের পর
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতল সম্পর্কের ফলে দুই দেশের মধ্যে যে অসম চুক্তি
বা সমঝোতা স্মারক ছিল, তাতে বাংলাদেশের আপত্তি থাকতে পারে বিধায় পরিবর্তন
বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংশোধনের দাবি উঠতে পারে।
৩. বাংলাদেশের
দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী চীনের সঙ্গে সম্প্রতি যেসব সমঝোতা স্মারক ও
চুক্তি হয়েছে, তাতে ভারত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। কেননা চীনের সঙ্গে
এসব সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশকে ভারতের বৃত্ত থেকে মুক্ত করার একটি উদ্যোগ
বলে মনে করা হয়। এতে বাংলাদেশের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। ফলে
বাংলাদেশের জনগণকে ভারতে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এমনকি
দীর্ঘদিন ভিসা বন্ধ থাকার কারণে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করা এখন প্রায় অসম্ভব।
৪.
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বেশ আগে থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা
নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এরই মধ্যে এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে
হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসীরা মুসলমানদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এই
সুযোগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠানোর মতো অমানবিক
পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
আরও খারাপ হতে পারে। বিজেপি সরকারের এই আচরণের বিরুদ্ধে ভারতের মধ্যপন্থী
দলসহ অন্যান্য বিবেকবান মানুষও তেমন প্রতিবাদ করতে পারছে না, কারণ
প্রগতিশীল ও মধ্যপন্থী দলগুলো মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়ালেই তারা বিজেপির
অপবাদের শিকার হয়।
৫. বিজেপির অনেক নেতা এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে
পাকিস্তানের পক্ষভুক্ত বলে প্রচার চালাচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো
কোনো নব্য বিশ্লেষক অতিমাত্রায় দেশপ্রেমিক হয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও
সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সব মতামত দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশের জন্যও বিপজ্জনক। কেউ
কেউ বলেছেন, এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের উচিত ভারতের সেভেন সিস্টার্স
রাজ্যগুলোয় আক্রমণ চালানো। কেউ কেউ জলপাইগুঁড়ির কাছে চিকেন নেক দখলে নিতেও
বলছেন। এই ধরনের বালখিল্য সুপারিশ ভারতে বাংলাদেশবিরোধী উগ্রবাদীদের আরও
উত্তেজিত করছে।
৬. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ঠিক আগে আগেই
মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে রাখাইনের জন্য মানবিক
করিডোর দেওয়া নিয়ে বিতর্ক এরই মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারকে দেশের ভেতরে ও
বাইরে নানারকম অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। রাখাইনের জন্য করিডোর ইস্যুটি
পাক-ভারত চলমান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকায়
ভারত খুব সন্তুষ্ট নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের এখন কী করা উচিত?
১.
ভারত ও পাকিস্তানের এই যুদ্ধে জনসাধারণের সমর্থন বা মতামত যাই হোক না কেন,
আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনেই বাংলাদেশের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকা
উত্তম। কাশ্মীরকে ঘিরে পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীরিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন
হবে না। তাই এই সমস্যার সমাধানে উভয় দেশ সম্মিলিতভাবে তাদের প্রজ্ঞা এবং
তাদের নিজ নিজ জনগণের আকাক্সক্ষা মূল্যায়ন করে শান্তির সমাধান খুঁজে
নেবে-এটিই যে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের চাওয়া, সেই বার্তাটি পরিষ্কার করে
দিতে হবে।
২. ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশসহ বন্ধুপ্রতিম সকল দেশের
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সামুদ্রিক পথ যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকে, সেজন্য ভারত
মহাসাগরকে নো ওয়ার জোন ঘোষণা করে যুদ্ধের বাইরে রেখে পাক-ভারত যুদ্ধের
সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা
চালিয়ে যেতে হবে। পাকিস্তান ও ভারতকে শক্ত চাপ দিয়ে বাধ্য করা যাতে উভয়
দেশই ভারত মহাসাগরকে তাদের যুদ্ধক্ষেত্র না বানায়। একই সঙ্গে নিজেদের
বাণিজ্যিক রুট নিরাপদ রাখতে ভারত মহাসাগরে স্বার্থ আছে, এমন দেশগুলোর সঙ্গে
নিবিড় যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
হবে।
৩. বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে নব্য বিশ্লেষক এবং ফরেন পলিসি
এক্সপার্টদের বলব, অনুগ্রহ করে অতি দেশভক্তি বা অতি বিপ্লবী হওয়ার দরকার
নেই। নিজের ড্রইংরুমে অতি বিপ্লবী হওয়ায় কোনো দোষ নেই। কিন্তু গণমাধ্যমে
কথা বলা ও লেখা, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়ও
আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চলা উচিত। উত্তেজক মন্তব্য না করে বা না লিখে
নিজেদের সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের গবেষণাকেন্দ্রে চলমান ইস্যুতে নিজেদের
সুপারিশ পাঠানো যেতে পারে।
৪. এই ধরনের জটিল পরিস্থিতি সামলানোর জন্য
রাজনীতিদের শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, বরং সরকারের উচিত সিরিয়াস ক্লোজড ডোর
বৈঠক করা। ইন সার্ভিস এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের
মতামত নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা।
৫. এটি অনস্বীকার্য যে বিগত ১৬ বছরে
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার নীতিসমূহে অযাচিত ও বালখিল্যসুলভ যে সব
পরিবর্তন হয়েছে তা পুনরায় বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনায় এনে নিজেদের সম্ভাব্য
ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতাগুলো মূল্যায়ন করতে হবে এবং এই সব নাজুক অবস্থানের
নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য পরিকল্পনা করা আবশ্যক। জাতীয় পরাজয়ে প্রবচন
নির্মাণের চেয়ে সামরিক অপারেশন লেভেলে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যাসে
পরিণত করা প্রয়োজন।
৬. দেশের নাজুক অবস্থানসমূহের নিরাপত্তার জন্য
আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ ছাড়াও সীমিত আকারে আক্রমণ পরিচালনার বিষয়টি বিবেচনায়
নেওয়া এবং তার অনুশীলন সম্ভব না হলেও, নেতৃস্থানীয় সামরিক ব্যক্তিবর্গের
চিন্তাশীল অনুশীলনে রাখা আবশ্যক।
৭. মনে রাখতে হবে দেশের স্বার্থ, দেশের
মানুষের স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্ব সর্বাগ্রে। সার্বভৌমত্ব থাকলে আমাদের
সবার স্বার্থ নিশ্চিত হবে। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নিজেদের বিভাজনের কারণগুলো
যাচাই করুন এবং দেখুন ওইসব ক্ষুদ্র স্বার্থ জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কাছে
খুবই নগণ্য।
লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, আর সি ডি এস, পি এস সি (অব.)