উচ্চবিত্ত
পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার ঝোঁক সব সময়ই কম-বেশি ছিল। কিন্তু
মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ন্যূনতম মেধা ও সামর্থ্য রয়েছে, এমন পরিবারের
ছেলেমেয়েরা আজকাল দেশে পড়াশোনা করতে আগ্রহ দিন দিন কমছে। একটা সময়
মাস্টার্স করতে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার চিন্তা করলেও এখন আন্ডার
গ্র্যাজুয়েট করতেই বিদেশমুখী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। নানা কারণে তারা দেশে
থাকার বিষয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। তা ছাড়া দেশের বিশ্বদ্যিালয়গুলোর বৈশ্বিক
মানদণ্ডে অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ার কারণেও বিদেশমুখী প্রবণতা বাড়ছে
শিক্ষার্থীদের।
দেশে সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা উপযুক্ত
মর্যাদার চাকরির সংকট থাকায় বিদেশে গিয়ে অনেকে ফিরছেন না। ফলে দেশ থেকে
ডলার যেমন চলে যাচ্ছে, আবার ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে ফেরত না আসার প্রবণতাও
বাড়ছে। যে কারণে দক্ষ ও মেধাবীদের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।
গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিকপট পরিবর্তনে দায়িত্ব নেওয়া প্রধান
উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত
বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে এনে দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর কথা বলছিলেন। এ
ক্ষেত্রে কয়েকজন দেশে ফিরে এলেও সেটি পর্যাপ্ত নয়।
গত কয়েক বছরের
পরিসংখ্যান পর্যলোচনা করে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য বছরে ৫০ হাজারের
বেশি শিক্ষার্থী দেশ ছাড়ছেন, যা ১০ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ। এই প্রবণতার
জন্য দেশের রাজনৈতিক ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থাই দায়ী। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের
মধ্যে দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে দেশপ্রেমের নিন্মগতি। যদিও
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক
হলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা শাসন ক্ষমতায় গেছেন তারা ধনী লোক। তাদের
মধ্যে দেশপ্রেম খুবই কম। তারা ধনী হওয়ার জন্য অসৎ উপায়, দুর্নীতি, লুটপাট-
এগুলো করতে থাকেন।
ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষা তো এক/দুই ধারায় হওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। তার কারণ হলো ইংরেজি মাধ্যমে যারা ধনী তাদের
ছেলেমেয়েরা পড়বে, মধ্যবিত্তরা বাংলা মাধ্যমে এবং গরিবরা সরকারি স্কুলও
মাদ্রাসায় পড়বে এ রকম নানান শ্রেণি বিভাজন দাঁড়িয়েছে আমাদের শিক্ষা
ব্যবস্থায়। যারা উচ্চবিত্ত তারা কিন্তু দেশের শিক্ষার মান উন্নত করার
ব্যাপারে আগ্রহী না। কেননা, তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। এই
মাধ্যমে পড়ার পরে তারা আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না, বেশির ভাগই
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিদেশে
পাঠিয়ে দেন। এটা দেশের সম্পদ পাচারের মতো ব্যাপার। ধনীরা বিদেশে বাড়ি ঘর
করছেন। দেশের ভবিষ্যত গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই। কাজেই তাদের সব
বিনিয়োগ এই অর্থে সন্তানের ভবিষ্যৎ, নিজেদের বাড়ি ঘর এগুলো তারা বিদেশে
করতে থাকবেন। যারা মধ্যবিত্ত তারাও এই উচ্চবিত্তদের দেখে এই রাস্তায় যাওয়ার
চেষ্টা করছেন। যেহেতু বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা বাংলা মাধ্যমে পড়বে না। ফলে
মূলধারাকে উন্নত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন
মধ্যবিত্ত তাদের ছেলেমেয়েরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। ধনীদের সন্তানরা
প্রাইভেটে বিশ^বিদ্যালয়ে যাবে বা দেশের বাইরে যাবে। রাষ্ট্র যেভাবে সম্পদ
পাচারে বাধা দিচ্ছে না, একইভাবে তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশ পাঠাতে বাধা দিচ্ছে
না।
মেধাবীদের এই বিদেশমুখী প্রবণতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে
বিবেচিত হচ্ছে উপযুক্ত চাকরির অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক
অস্থিরতা ইদানিং আরও অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের
বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে তৎপর থাকেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ক্ষমতা বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের
পরে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট
বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে আবার গুম-খুন বা মামলার ঝুঁঁকি থাকে। সব মিলিয়ে
অভিভাবক মহল তাদের সন্তানদের নিয়ে থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। এ কারণে
মধ্যবিত্তরা তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে হলেও সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর ঝুঁঁকি
নিচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে শুধু রাজধানী ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়
শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত হন।
দেশের কোনো সরকারই মেধাবীদের ফেরাতে চায়নি।
এখনো চায় না। যারা বাইরে চলে যেতে চায় এটা তাদের অধিকার। আমাদের রাষ্ট্রের
শৃঙ্খলা বিধান ঠিকমতো হয় না। আইনের শাসনের ঘাটতি রয়েছে। জোর যার মুলুক তার
মতো অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে হবে। এ
ক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত বছরের জুলাইয়ে চাকরিতে কোটা
ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে আন্দোলনে নামেন তরুণরা। পরিসংখ্যান বলছে পর্যাপ্ত
চাকরির অভাবে দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। বাংলাদেশ
শ্রমশক্তির রিপোর্ট অনুযায়ী বেকারদের মধ্যে ৩১ শতাংশই অনার্স, মাস্টার্স
সম্পন্নকারী।
উচ্চমাধ্যমিকসহ বিবেচনা করলে, যা ৫০ শতাংশের ওপরে। ২০১৭
সালে যেখানে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল ৪ লাখ, তা দ্বিগুণ হয় পাঁচ বছরে। এই
পরিসংখ্যানের সত্যতা পাওয়া যায় সরকারি চাকরিতে আবেদন দেখলে। সর্বশেষ বিসিএস
৪৭তম প্রিলিমিনারিতে অংশ নিতে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪৭ জন। আগের
দুই বিসিএসও এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখের বেশি।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে
অনেক নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনায় নেওয়া হয়। এখনো
গ্রহণযোগ্য কোনো পদ্ধতিই নেই। নিজেদের অনুগত ও পছন্দের লোকদের শিক্ষক
হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব
দেখা দিচ্ছে। উপযুক্ত শিক্ষক না থাকার এ আলোচনা সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করায়
অনেক মেধাবীই দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে
পড়াশোনা করে পরবর্তী সময়ে তারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ
পান। কিন্তু তারা এই দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য বিবেচিত হন না। অনেক ক্ষেত্রে
অনিয়মের শিকার হন। আবার যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত
হন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে গবেষণাসহ অন্য কাজ
যথাযথভাবে করতে পারেন না।
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ্যাকাডেমিক
পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ও মান দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে অনেকে শিক্ষা ছুটি
নিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েও ফেরত আসেন না। যার কারণে তাদের পেছনে করা
রাষ্ট্রের বিনিয়োগও বিফলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেকেই গুগল, নাসা,
মাইক্রোসফটসহ বিদেশে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছেন,
বেতন কাঠামো বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির যে কোনো চাকরির তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
আমাদের
দেশে একাধিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোর মান নিয়ে
এখন প্রশ্ন। নতুন স্থাপিত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখনো ভাড়া
বাসায়। চাহিদা অনুযায়ি নেই দক্ষ শিক্ষক। অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
থেকেও কম সুযোগ- সুবিধা বিদ্যমান। অন্যদিকে বিদেশে আন্তর্জাতিক মানের
শিক্ষাগ্রহণ শেষে উচ্চ বেতনে তারা চাকরি লাভ করেন। এর সঙ্গে আরেকটি সুবিধা
হলো সন্তান বিদেশে ভালো বেতনে চাকরি করলে অনেক ক্ষেত্রে দেশ থেকে তার
অভিভাবক বা আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে বসবাসের সুযোগ পান। এসব কারণে
সামর্থ্যবানরা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলে ছেলেমেয়েদের আজকাল বিদেশে পাঠিয়ে
দিচ্ছেন। যে কারণে ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখার গুরুত্ব বাড়ছে।
বর্তমানে
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি মেধাবীদের ও
ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাহলে যোগ্যরা দেশ গঠন ও পরিচালনায়
নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাব্যবস্থার মান বাড়াতে
কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরি,
চাকরির সুযোগ বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয় এবং রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল ও
কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিদেশমুখী প্রবণতা কমতে পারে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।