বৃহস্পতিবার ১ মে ২০২৫
১৮ বৈশাখ ১৪৩২
শ্রম আইনে ও শ্রমিকের জীবনে মে দিবস
রাজেকুজ্জামান রতন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫, ১:২৪ এএম আপডেট: ০১.০৫.২০২৫ ১:৫২ এএম |


  শ্রম আইনে ও শ্রমিকের জীবনে মে দিবস আজ থেকে ১৩৯ বছর আগে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ নয়, ৮ ঘণ্টা কাজ- এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন অগাস্ট, স্পাইজ, এঞ্জেলস, ফিসার। মালিক এবং সরকার ভেবেছিল ফাঁসি দিয়ে শ্রমিক নেতাদের হত্যা করে শ্রমিকদের ভয় দেখানো এবং আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু ন্যায্য দাবিতে গড়ে ওঠা শ্রমিকদের এই আন্দোলন হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা যায়নি। বরং আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর দেশে দেশে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্যারিস কংগ্রেস’-এ প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সালের নিউইয়র্কে প্রথম মে দিবসের সমাবেশের প্রস্তাবে লেখা হয়, ‘৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবি পূরণের সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব- কিন্তু কখনো ভুলব না, আমাদের শেষ লক্ষ্য হলো (পুঁজিবাদী) মজুরিব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন’। তারপর থেকেই ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি আর সমাজবদলের সংগ্রাম একসঙ্গেই চলছে।
মানুষ প্রতিদিন যা কিছু ব্যবহার করে সব কিছুই মানুষের শ্রমে তৈরি। শ্রমিক কাজের বিনিময়ে মজুরি পায় আর মালিক শ্রমিককে কাজ করিয়ে মুনাফা অর্জন করে। কার্ল মার্ক্স হিসাব করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় আর মালিক তা শোষণ করে। মালিকরা শ্রমিকের মজুরি যত কম দেবে এবং যত বেশি সময় কাজ করাবে, তাদের মুনাফা ততই বাড়বে। তাই ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যে লাখ লাখ শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তারা চেয়েছিল এমন মজুরি, যাতে সে মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারে, অসুখে চিকিৎসা, মাথাগোজার ঠাঁই নির্মাণ, বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে।
কারণ, ন্যায্য মজুরি না পেলে যতই পরিশ্রম করুক না কেন শ্রমিকের জীবনে স্বস্তি আসবে না। মাস শেষে মজুরি পেতে না পেতেই বাড়ি ভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করে বাকি মাস চালাতে আবার দেনা করা, এই চক্র চলতেই থাকে। যেহেতু শ্রমিককে শোষণ করেই মালিকের মুনাফা হয়, তাই শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে ন্যায্য মজুরি আদায় করা সম্ভব হয় না। মজুরি বৃদ্ধি ও জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি যেন হাত ধরাধরি করেই চলে। ফলে, ন্যায্য মজুরির আন্দোলন করতে গেলে শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবেই আর স্বপ্ন দেখতে হবে শোষণহীন সমাজের।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ৬ শতাংশের বেশি, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ আর পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বাড়ে ৫ শতাংশ হারে। ফলে প্রতিবছর শ্রমিক মজুরি হারায়। সরকারি মাথাপিছু আয় এখন ২৭৯৫ ডলার। ১১৫ টাকা ডলার ধরলে ৫ সদস্যের একটি পরিবারে মাসিক আয় ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা হওয়ার কথা সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, পৃথিবীর বহুদেশ বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রশংসা করছে- এসব কথা আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রতিদিন শুনছি। কিন্তু বাংলাদেশের এই উন্নতির পেছনে প্রধান শক্তি যে শ্রমিক তারা এত কম মজুরি কেন পায় সে প্রশ্নের উত্তর কী? পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক আর মালিক-শ্রমিকের বিশাল বৈষম্যের দেশ এই বাংলাদেশ। গার্মেন্টস, নিট, সুয়েটার, রি রোলিং, পাট, চা, তাঁত, যানবাহন চালকসহ পরিবহন শ্রমিক, মোটর মেকানিক, রিকশা চালক, দোকান ও হোটেল কর্মচারী, পাদুকাসহ সব সেক্টরের শ্রমিকরা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের মতো মজুরি থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত মিলে ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেও নিজেদের দারিদ্র্য দূর করতে পারছে না, অন্যদিকে কয়েক লাখ কোটিপতির জীবনে বিলাসিতার শেষ নেই। শ্রমিকদের শোষণ করেই তাদের এই সম্পদের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা সচেতন হলে এই অন্যায় শোষণমূলক ব্যবস্থা পাল্টানোর সংগ্রাম করবেই, সে কারণে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পথে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে রেখেছে। শ্রম আইন, বিধিমালা, প্রশাসন, পুলিশ, মাস্তান, শ্রমিকনেতা নামধারী একদল দালালকে ব্যবহার করে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সংগঠিত হতে বাধা দেয়। কারণ তারা জানে, শ্রমিকরা সংখ্যায় যত বেশি হোক না কেন অসংগঠিত থাকলে তারা দুর্বল ও অসহায়।
আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অনেক বেশি উৎপাদন করা যায়, ফলে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। শ্রমিকের মজুরি এত কম দেওয়া হয় যে, আট ঘণ্টা তো বটেই, ওভারটাইম না করলে তাদের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন। ১৩৮ বছর আগে শ্রমিক দাবি করেছিল আট ঘণ্টা কর্ম দিবসের আর আজ শ্রমিক ওভার টাইম করতে চায়। এর কারণ নিহিত আছে স্বল্প মজুরির ফাঁদে। মজুরি কম বলে অতিরিক্ত খাটতে হয়, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বলে সে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায় না আর দক্ষতা কম বলে তার মজুরি কম। এ এক দুষ্ট চক্রে আটকা পড়েছে শ্রমিক।
শ্রম আইন শ্রমিকের জন্য অধিকারের সুরক্ষার পরিবর্তে অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইনি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম শক্তির ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। এরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাদের ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা, মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আর্থিক সহায়তা কোনো কিছুই নেই। শ্রম আইনে আছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। এই আইনের প্রয়োগ সেখানে নেই। ফলে এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক শ্রম আইনের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক যাদের সংখ্যা ১ কোটি তারাও আইনের বেড়াজালে আটকে আছে।
শ্রম আইনের ১০০ ধারায় উল্লেখ আছে কর্ম সময় হবে ৮ ঘণ্টা কিন্তু ১০৮ ধারার বিধান সাপেক্ষে ১০ ঘণ্টাও কাজ করানো যাবে। শ্রম আইনের ২৩ ধারা ব্যবহার করে অসদাচরণের অজুহাতে বিনা নোটিসে, বিনা মজুরিতে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। শ্রম আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী যেকোনো স্থায়ী শ্রমিককে কর্মচ্যুত করা যাবে। আবার ১৮০ ধারায় আছে শ্রমিক হিসেবে নিয়জিত বা কর্মরত না থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়া যাবে না। শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা। আর চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করলে ক্ষতিপূরণ মাত্র আড়াই লাখ টাকা।
ফলে সংসারের দায় পালন করতে এসে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে শেষে সংসারের বোঝা হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক। ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার এবং হাতিয়ার। বিচ্ছিন্ন বিভক্ত লাখ লাখ শ্রমিক অসহায়ের মতো নিপীড়ন সহ্য করে যদি তারা সংগঠিত না থাকে। বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশন ৮৭ এবং ৯৮ অনুস্বাক্ষর করেছে ১৯৭২ সালে। সে অনুযায়ী সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং দরকষাকষি করার অধিকার পাওয়ার কথা। এই অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানেও স্বীকৃত। কিন্তু এখনো শ্রম আইন সংবিধান ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী প্রণীত হয় নেই। সে কারণে ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে মাত্র ৩২ লাখ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য আর প্রায় ২ লাখ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন আছে। ফলে সদস্য সংখ্যা এবং ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা কোনোটাই ৫ শতাংশের বেশি নয়। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের এবং মালিকদের নিয়ন্ত্রিত ট্রেড ইউনিয়ন থাকায় তা শ্রমিক স্বার্থে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
কিন্তু মে দিবস এই শিক্ষা দেয়- শ্রমিকের দাবি যতই ন্যায্য হোক না কেন, লড়াই করা ছাড়া তা আদায় করা যায় না এবং অর্জিত অধিকার রক্ষাও করা যায় না। মালিক এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে দয়া বা করুণা চেয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, ন্যায্যমজুরি আর ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করতে হলে সচেতন ও সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)













সর্বশেষ সংবাদ
হাজী ইয়াছিন এমপি হলে ইনশাআল্লাহ মন্ত্রী হবেন - অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া
কুমিল্লা শ্রম আদালতে রায়ের অপেক্ষায় ১৫২ মামলা
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ টি ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা
লাকসামে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
আনন্দঘন পরিবেশে সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস উইক ২০২৫ সম্পন্ন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় বকশিস নিয়ে সহকর্মীকে হত্যা,আরেক সহকর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
বুড়িচংয়ে আ.লীগের নেতা ও ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন গ্রেপ্তার
ছাত্রসেনার নেতাকে অপবাদ দিয়ে নির্যাতনের পর কারাগারে মৃত্যু ! কুমিল্লায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ টি ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা
কুমিল্লায় রোবো উৎপাদনে ছাড়িয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২