বৃহস্পতিবার ১ মে ২০২৫
১৮ বৈশাখ ১৪৩২
কচুরিপানার উপকারিতাও আছে
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫, ১:২০ এএম আপডেট: ১৭.০৪.২০২৫ ২:২৫ এএম |


 কচুরিপানার উপকারিতাও আছে
বিশ^জুড়ে কচুরিপানাকে ডাকা হয় “দি বিউটিফুল ব্লু ডেভিল” নামে। আগ্রাসী এই জলজ উদ্ভিদটি যতটানা উপকারি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। সুদূর আমাজনের বন থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা আগাছাটি বন্ধ করে দিচ্ছে নদীপথ। প্রবাহ কমিয়ে নদনদীর তলদেশে পলিজমা তরান্বিত করছে। শতবছর ধরে দেশের নদনদী, খালবিল দখলেও সহযোগীতার ভূমিকা পালন করছে এ আগাছাটি। গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র দুই সপ্তাহে কচুরিপানা দ্বিগুণ হতে পারে। অনুকূল পরিবেশ না পেলেও ৩০ বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থেকে এর বীজ অঙ্কুরিত হইতে দেখা যায়। জানা যায়, ১৮ শতকের শেষ দিকে এক ব্যবসায়ী কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে উদ্ভিদটি নিয়ে আসেন। ১৯১৪ সনের মধ্যে খালবিল, নদীনালা দখলে নেয় এই উদ্ভিদটি। নৌপথে পণ্য পরিবহন ও চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। অক্সিজেন সংকটে জলজ প্রাণী বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কমে যায় প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন।
কচুরিপানা ঠেকাতে সরকার বাংলার জলাভূমি আইন, স্থানীয় সরকার আইন, মিউনিসিপ্যালটি আইন ও স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন সংশোধন করে। ১৯৩৭ সনে নির্বাচনে সবদল নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ যুক্ত করার অঙ্গিকার করে। ১৯৪৭ সাল নাগাদ কচুরিপানার সমস্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরের দশকে দেশের অনেক নদীনালার নায্য ফিরে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার জোঁকে বসেছে এই ব্রাজিলিয়ান ব্লু ডেভিল। মধুমতি নদীতে কচুরিপানা জমে গত বছরের নভেম্বরের শুরু থেকে গোপালগঞ্জের সঙ্গে ৫ জেলার নৌকা চলাচল বন্ধ ছিল অন্ততঃ ২০ দিন। দেশের অনেক নদনদী, খাল ও অধিকাংশ আবদ্ধ জলাশয় এখন কচুরিপানার দখলে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্মা নদীর অনেক জায়গায় কচুরিপানা জমতে দেখা যায়, মুন্সিগঞ্জ, সাভার, নারায়নগঞ্জসহ তার আশপাশের প্রায় সব খালবিল কচুরিপানার দখলে। বগুড়া, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর থেকেও কচুরিপানার আগ্রাসী চরিত্রের খরব পাওয়া যায়।
নদনদী বা খালবিলের এই জালকে এখন কালো সোনায় পরিণত করেছে কেনিয়ার হায়াপ্যাক টেকনোলজিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা কচুরিপানা শুকিয়ে তা নিয়ে তৈরি করেছে বিশেষ ধরনের শীট, যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানাহ পণ্য। বাংলাদেশেও কচুরিপানা দিয়ে ব্যাগ, ঝুড়ি, ট্রে, শোপিছ, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ফুলদানি, বালতি, টবসহ বাহারি নানাপণ্য তৈরি করছেন কিছু উদ্যোক্তা। গবেষণাগারে পরিবেশবান্ধব পলিথিনও উৎপাদন করছেন দেশের একদল তরুণ গবেষক। তবে রাষ্ট্রের নজর না থাকায় উদ্যোগগুলো ব্যাপকতা পাচ্ছে না বা পলিথিনের বিকল্প হয়ে দাড়াচ্ছে না। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ক্ষতিকর কচুরিপানাকে পানি থেকে তুলে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। উপদেষ্টার সুন্দর বক্তৃতার চেয়ে এ কাজটি জাতির জন্য অত্যন্ত জরুরী।
পরিবেশ ধ্বংস করছে পলিথিন। বিকল্প না আসার অভিযান নেমেও বাজার থেকে পলিথিন নির্মূল করতে পারছে না সরকার। এইসব সমস্যার সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন গোপালগঞ্জে মেরিন বায়োসাইন্স বিভাগের, এমআইএসটির বায়োমেডিকেল সাইন্সের ও এপ্লাইড কেমিষ্ট্রি ও কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একদল তরুন গবেষকরা। তারা জলের আগাছা কচুরিপানা থেকে তৈরি করে ফেলেছেন পরিবেশবান্ধব পলিথিন ও প্লাষ্টিক ব্যাগ। এই ব্যাগ মাছ মাংস থেকে সবকিছু বহণ করা যায়। বিভিন্ন সামগ্রী মোড়কজাতও করা যায়। মাটিতে ফেলে দিলে ছয় মাসে পঁচে সারে পরিণত হয়। এতে দূষণের পরিবর্তে উর্বর হবে মাটি। নিয়ন্ত্রণ করা যাবে জলজ জীবনের হুমকি কচুরিপানা। তবে তহবিল সংকটে এখনও তারা বাণিজ্যিক উৎপাদানের জন্য গবেষণাটি পরবর্তী ধাপে নিতে পারেনি। মাননীয় পরিবেশ উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ গবেষকদলকে উৎসাহিত করুন।
পানি ধ্বংস করে দিচ্ছে পলিথিন। বিকল্প পণ্য এখনও বাজারে আসেনি। সাধারণ পাটের ব্যাগ বাজারে আছে, তবে পরিমাণে কম, দাম বেশি। এতে মাছের মত ভেজাপণ্য বহন করা যায় না। এছাড়া পাট এক মৌসুমে পাওয়া যায়।  শিমুল তুলা, ভূট্টা, কলাগাছের আঁশ থেকেও ব্যাগ তৈরি করা যায়, তবে এগুলোর কাঁচামালের সংকট আছে। কচুরিপানা থেকে তৈরি পরিবেশবাদ্ধব প্লাষ্টিক পলিথিনের চাহিদা যেমন পূরণ করবে, আবার মাটিতে ফেললে সার হবে। কাঁচামাল সংগ্রহে তেমন খরচ না হওয়ায় এই ব্যাগের দামও অনেক কম হবে। এটাকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে নিতে পরীক্ষামূক একটা কারখানা স্থাপন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় সহযোগীতা প্রয়োজন। উদ্ভাবনকে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে তহবিল দরকার। অনেক বিজ্ঞজন বলেছেন, দূষণের দায়ে সরকার যে জরিমানা আদায় করেছেন, সেই টাকা থেকে পরিবেশবান্ধব এইসব গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ দিলে এক উদ্যোগে দুই কাজ হয়ে যাবে।
কচুরিপানার ভালো দিকেরও কমতি নেই। পরিকল্পিত ব্যবহারে এ উদ্ভিদকে অনেকেই সম্পদে পরিণত করেছে। কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে গাছের টব, ব্যাগ, ট্রে, শোপিছ, ঝুঁড়ি, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ফুলদানি, বালতিসহ বাহারি নানাহ দ্রব্যাদি। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে বিদেশে পাচ্ছে অনেক কদর। বাংলাদেশের কিছু উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশে এসব পণ্য রপ্তানি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। বিবর্তন হ্যান্ড মেইড পেপার প্রজেক্ট নামের একটি সংগঠন কচুরিপানা থেকে তৈরি করেছে বিশেষ ধরনের কাগজ। সেই কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে ৩০ টিরও বেশি পণ্য। এসব পণ্যের বেশির ভাগ রপ্তানি হচ্ছে। পাবনা সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার প্রায় ১৫ টি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন কচুরিপানা কেনাবেচায় জড়িত। সেখানকার তৈরি কচুরিপানার পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। বিডি ক্রিয়েশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুকনো কচুরিপানা কিনে প্রক্রিয়াজাত করে বাহারি পণ্য তৈরি করে আটটি দেশে রপ্তানি করছে। রংপুরের পায়রাবন্দে কে হ্যান্ডিক্রাফট নামে কচুরিপানার হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাদের পণ্য যাচ্ছে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কৃষিবিদরা বলছেন, কচুরপানা থেকে হয় উন্নতমানের জৈব সার। এছাড়া কচুরিপানা দিয়ে ভাস্যমান বেড তৈরি করে করা যায় ফসলের আবাদ। তাতে মাটির চেয়ে কম সময়ে বেশি ফসল পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে কচুরিপানা দিয়ে পণ্য উৎপাদানের প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতে সহযোগিতা এবং জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে জলজ আগাছাটি সম্পদে পরিণত হত, দেশ পরিবেশ উন্নয়নে সহায়তা পেত। 
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ












সর্বশেষ সংবাদ
হাজী ইয়াছিন এমপি হলে ইনশাআল্লাহ মন্ত্রী হবেন - অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া
কুমিল্লা শ্রম আদালতে রায়ের অপেক্ষায় ১৫২ মামলা
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ টি ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা
লাকসামে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
আনন্দঘন পরিবেশে সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস উইক ২০২৫ সম্পন্ন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় বকশিস নিয়ে সহকর্মীকে হত্যা,আরেক সহকর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
বুড়িচংয়ে আ.লীগের নেতা ও ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন গ্রেপ্তার
ছাত্রসেনার নেতাকে অপবাদ দিয়ে নির্যাতনের পর কারাগারে মৃত্যু ! কুমিল্লায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ টি ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা
কুমিল্লায় রোবো উৎপাদনে ছাড়িয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২