দুর্নীতি বাংলাদেশের জাতীয়
সমস্যা। দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু প্রায়। দেশের
ব্যাংক ডাকাতি, অর্থ পাচার, প্রোজেক্ট ব্যবসা সব দুর্নীতিরই ফসল। দুর্নীতি
শুধু অর্থনীতিকেই ধ্বংস করে না বরং মানুষের নৈতিক চেতনাও হত্যা করে, সমাজে
একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের
জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চিন্তা করে এবং কোনো প্রকার ভয় ছাড়াই কাজ করে। এখানে
দুর্নীতিবাজরা সম্মানিত হয়, পুরস্কৃত হয়।
বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী
সংস্থাগুলো অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে, প্রায়শই তারা ক্ষুদ্র অপরাধীদের
নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগী হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি
কোটি টাকা লোপাট করে বড় বড় রুই কাতলারা শাস্তি পায় না। এমনকি তারা
ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এর ফলে সরকারের দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার ওপর জনগণের
আস্থা নষ্ট হয়েছে এবং হুইসেল ব্লোয়ারদের এগিয়ে আসতে নিরুৎসাহিত করেছে।
সর্বোপরি,
দুর্নীতি ফাঁস করতে সাংবাদিকতা কেন ঝুঁকি নেবে যখন প্রকৃত অপরাধীরা
অস্পৃশ্য থেকে যায়? যারাই সাহস নিয়ে প্রভাবশালীদের থলের কালো বিড়াল বের করে
দিতে এগিয়ে এসেছে তারাই কোনো না কোনোভাবে বিপদে পড়েছে। কাউকে জেলে পচতে
হয়েছে, কাউকেবা দেশ পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে।
দিনে দিনে দুর্নীতি,
স্বার্থপরতা এবং লোভ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাঠামোয় অনুপ্রবেশ করেছে
এবং আইনের শাসন মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। লুটপাট, সন্ত্রাস, অনাচার,
অবিচার দুঃশাসন জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে। দুর্নীতির মূলে রয়েছে দেশের
রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ব্যবসায়ী মহল।
দুর্নীতিবাজ নেতারা ঠিক যেন ভেড়ার
পোশাকে একেকজন নেকড়ে। তারা লোভ, ক্ষমতা এবং কারসাজির মাধ্যমে একেকজন
রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত হয়ে উঠেছিল। তারা সমাজের স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিগত
লাভের জন্য তাদের পদ কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিকে বৈধ করে তুলেছে। যখন সরকার
জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বেছে নেয় তখন কানাডায় বেগম
পাড়ার জন্ম হয়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম হয়, সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশি ধনীদের
ধনসম্পদ বাড়তে থাকে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, যাদের দায়িত্ব জনস্বার্থ রক্ষা
করা, তারা কেন এই ধরনের দুর্বৃত্তায়নের চালিকা শক্তিতে পরিণত হবে বা এটি
চলতে দেবে? উত্তরটি নির্মমভাবে সহজ, দুর্নীতির মাধ্যমে তারা আরেক মেয়াদে
ক্ষমতায় টিকে থাকতে সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। দুর্নীতির মাধ্যমে যদিও তারা
তাদের ক্ষমতায় থাকার সময় বাড়াতে পারে, এটি জাতিকে গভীর সংকটে নিপতিত
করে-ধসে পড়ে স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামো এবং অপর্যাপ্ত সামাজিক
পরিষেবায় জনগণের ভোগান্তি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
দুর্নীতি একটি
সমাজের ভিত্তিকে ক্ষয় করে এবং ভিন্নমতকে নীরব করে দেয়। এটি কিছু মানুষকে
সমৃদ্ধশালী এবং প্রতাপশালী করে তুললেও, দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আঁকড়ে
থাকা নেতাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ এবং ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়।
দুর্নীতি দমনে
প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সব পক্ষ থেকে একে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের
তরুণেরা জাতির জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের বৈষম্য বিরোধী
স্পিরিটকে দেশ সংস্কার এবং বিনির্মাণের কাজে লাগাতে হবে। টার্গেট করে
দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করলে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে
পারে।
ফলে, আমাদের তরুণদের থেকে শুরু করে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে
তুলতে হবে। সমাজে দুর্নীতির ধ্বংসাত্মক প্রভাবগুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন
করে তুলতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে
হবে। নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতার প্রাথমিক উপলব্ধি তাদের মধ্যে বিকাশ করা এবং
লালন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে দুর্নীতি মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের
জ্ঞান ও দক্ষতার সাথে প্রস্তুত করার জন্য বিদ্যালয়ে দুর্নীতি বিরোধী
বিতর্কের আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের দুর্নীতি সম্পর্কিত আইন ও
নীতির ধারণার সাথে পরিচিতি করা প্রয়োজন। এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণেরা
তাদের নিয়ন্ত্রণকারী আইন এবং সরকারি পরিষেবায় প্রত্যাশিত নৈতিক মানগুলো
সম্পর্কে জানতে পারবে। তরুণদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে সহযোগিতা
করবে।
তরুণেরাই আমাদের ভবিষ্যতের নেতাÍসমাজে তাদের দায়িত্ব অনেক। সে
দায়িত্ব স্বচ্ছতা এবং সততা বজায় রেখে পালন করার গুরুত্ব তাদের অবশ্যই বুঝতে
হবে। নৈতিক আচরণের প্রাথমিক শিক্ষা একটি প্রজন্মকে জবাবদিহিতার বিষয়ে
উৎসাহিত এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে সহযোগিতা করবে।
২০২৪ এর ছাত্র জনতার
গণবিপ্লবের পর আবারও প্রমাণিত হয়েছে দিনশেষে জনগণের শক্তিই আসল শক্তি।
দুর্নীতির স্বরূপ এবং প্রভাব বিষয়ে জনগণকে সচেতনতার মাধ্যমে এই শক্তিকে
দুর্নীতি রোধে কাজে লাগানো সম্ভব। দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলো সরকার
নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে সমাজে দুর্নীতিবাজদের
চিহ্নিত করতে পারে। এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতি ও
কর্তৃত্বের অপব্যবহার দূর করার জন্য একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান চিন্তা করা
যেতে পারে যারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করবে।
একটি ঐক্যবদ্ধ ও অটল রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে শাসন
ব্যবস্থার ওপর দুর্নীতির কালো ছায়া দূর করা সম্ভব। দুর্নীতি দমন কমিশন,
যদিও প্রয়োজনীয়, তবে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ছাড়া অপর্যাপ্ত এবং
অকার্যকর। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি শুধু কমবেই না, দূরও হবে।
ইতিহাসে সুস্পষ্ট উদাহরণ আছে যে যেখানে নেতৃত্ব দৃঢ় হয়, সেখানে জাতি
পরিবর্তিত হয়। যেমন চীনে, জনসাধারণের তহবিলের অব্যবস্থাপনার জন্য
মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোরতম শাস্তি চালু করে। সরকারের এই কঠোর অবস্থান চীনের
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
চীনের
নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিল যে, জবাবদিহিতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। দুর্নীতির
বিরুদ্ধে তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সফলতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা
বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। দুর্নীতির প্রতি চীনের
দৃষ্টিভঙ্গি শুধু কঠোর নয় বরং সুচিন্তিত। তারা বুঝতে পেরেছিল যে দুর্নীতি
তার বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে বিকাশ লাভকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যে বার্তাটি
এখানে পরিষ্কার তা হলো, যখন রাজনৈতিক সংকল্প নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই
করা হয়, তখন একটি দেশের সমৃদ্ধির পথ পরিষ্কার হয়।
একইভাবে সিঙ্গাপুরের
আজকের উন্নয়নের পেছনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান অনন্য
ভূমিকা রেখেছে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ (খবব কঁধহ ণব)ি মনে
করতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণের পবিত্র আমানত এবং কোনোভাবেই দুর্নীতি সহ্য করা
উচিত নয়। তার প্রশাসন দেখিয়েছে যে, সত্যিকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংস্কার শুধু সম্ভবই নয়, তা অনিবার্য।
বাংলাদেশে
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতির ব্যাপকতা অব্যাহত ছিল। ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে যে দুর্নীতির জন্য সরকার প্রতিবছর
রাজস্বের বড় অংশ হারায়। বিষয়টি অবহেলা বা অদক্ষতার বিষয় নয়, এটি ইচ্ছাকৃত।
বাংলাদেশ এমন এক পঙ্কিলতায় ডুবে ছিল যেখানে দুর্নীতিকে শুধু সহ্য করা হয়নি
বরং লালনও করা হয়েছে। শাসনযন্ত্রের চূড়ায় বসে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায়
নেতৃত্ব দিচ্ছে বছরের পর বছর তারা কর পরিশোধ করছে না। প্রতি বছর দুর্নীতির
মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
দুর্নীতির
বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের আইন বা প্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল তা নয়। এই
আইনগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করার কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। ফলে,
রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার একটি অন্যতম পথ। বাংলাদেশে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতি দমনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
না হলে বিদ্যমান আইনি কাঠামো কাজে আসবে না এবং কোনো পরিবর্তন হবে না।
সবক্ষেত্রে
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যবিরোধী গণ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যারা ক্ষমতায়
আছে তাদের কাছে এই জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। আমরা আশাবাদী বর্তমান
অন্তর্র্বতীকালীন সরকার চীন এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশ ও জাতিকে সবার ঊর্ধ্বে
স্থান দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত করতে দৃঢ় এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
নোবেলজয়ী
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন বিশ্বনেতা যখন বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছে,
তখন অবিশ্বাস ও নেতৃত্বের সংকট অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে এবং সেই সাথে আমাদের
আশা অনেক গুণ বেড়েছে। রাজনৈতিক মূল্য নির্বিশেষে দুর্নীতিবাজ যতই শক্তিশালী
হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করতে পিছ পা হবেন না।
যতদিন তিনি
পারছেন না, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতির খপ্পরে আটকে থাকবে, হাজার
হাজার কোটি টাকা পাচার হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্ভাবনা লোভ
এবং ব্যক্তিস্বার্থের চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়