বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪
৭ কার্তিক ১৪৩১
বৃষ্টির বিবৃতি ও কবির কবিতা
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪, ১২:১৩ এএম |

  বৃষ্টির বিবৃতি ও কবির কবিতা
যখন বৃষ্টি নামে তখন বিস্ময়কর একটি সিক্ততায় ভূপৃষ্ঠ স্নিগ্ধ হয় এবং দৃষ্টিতে সবকিছু নয়নাভিরাম মনে হয়। বিস্ময়কর স্বচ্ছতায় মেঘলোক থেকে বৃষ্টিবিন্দু পৃথিবীতে পতিত হয়; কখনো ঘাসের উপরে পড়ে, কখনো বা বনাঞ্চলে কখনো ¯্রােতবাহী নদীতে, কখনো কিশলয়ের সবুজে এবং কখনো গৃহাঞ্চলে। সর্বত্রই মহিমান্বিত প্রতাপ নিয়ে বৃষ্টি পতিত হয়। এ কারণেই রসুলে খোদা বলেছেন, বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর প্রসাদ এবং কৃপা। বৃষ্টিকে স্বাগত করো, অভিসম্পাৎ দিও না।
ছোট বয়সে গ্রামে থাকতে বৃষ্টি অনুভব করবার জন্য বৃষ্টিতে ভিজতাম এবং পুকুরের পাড়ে এসে পুকুরের বুকে বৃষ্টিবিন্দুর খেলা দেখতাম। শান্ত নিস্তরঙ্গ পুকুরের বক্ষ্যদেশ বৃষ্টিপতনের ফলে কল্লোলিত এবং স্ফীতকায় হত। আমি তখন আমার দৃষ্টিতে অলৌকিকের সন্ধান করতাম। সে যে কি বিস্ময়কর অনুভূতি তা ভাষায় বুঝিয়ে বলা যায় না। পুকুর এমনিতে শান্ত থাকে। কখনো বাতাসের তাড়ায় ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। পাড় থেকে ছেলেমেয়েরা ইটের টুকরো ছুঁড়ে দিলে টুক করে শব্দ হয়। এর মধ্যে যখন বৃষ্টি নামে তখন সমস্ত পুকুরে সাড়া পড়ে যায়। পুকুর যেন খুশীতে উচ্ছলিত হয়ে কথা বলতে থাকে। ঠিক এভাবেই ধানক্ষেতের উপর বৃষ্টি নামে তখনও অপরূপ দৃশ্য জেগে ওঠে। প্রবল বৃষ্টিপতনের ফলে ধান গাছগুলো নুয়ে পড়ে। আবার মাথা তুলবার চেষ্টা করে, আবার নুয়ে পড়ে। হিল্লোলিত সবুজের অভিবাদনে সে যেন বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানায়। সবুজ ফড়িংগুলো লাফাতে থাকে এবং কয়েকটি কাক ভিজতে ভিজতে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। শৈশবে নদী যেমন দেখেছি-বৃষ্টিও তেমনি দেখেছি। কিন্তু শৈশবে নদীর মাতকতাই ছিল আমার অবলম্বন। বৃষ্টি তখন আমার জীবনকে ততটা পীড়া দেয় নি। কিন্তু শহরে এসে স্কুল জীবন শেষ হল যখন সে সময় যৌবন উন্মেষের কেমন এক প্রকার উদ্বেগে বৃষ্টিকে নতুন করে দেখলাম।
বৃষ্টিকে দেখে বৃষ্টির মধ্যে আপন শরীরকে ছেড়ে দেওয়ার যে আনন্দ সেটা বিশেষভাবে আমি অনুভব করেছি বড় হয়ে। বিশেষ একটি উন্মাদনায় যৌবনের একটি আভাস আমার মধ্যে তখন জেগেছিল। আমি বৃষ্টির সঙ্গে ঐক্য অনুভব করবার চেষ্টা করেছিলাম। বৃষ্টি প্রকৃতির যে ঐশ্বর্য নির্মাণ করে তার মধ্যে যৌবনের বিকাশ অনুভব করা যায়। বৃষ্টি দেখে আমি অজ্ঞাত এবং অনুভূত অবস্থায় কাব্য অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল বৃষ্টি হচ্ছে জীবনধর্মী, বৃষ্টির বিনাশ নেই। বৃষ্টিকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে বৃষ্টি যেন উচ্ছলিত হয়ে হেসে ওঠে। বৃষ্টি নামে প্রবল বেগে, কতদূর আকাশ থেকে জানি না, কিন্তু নামে যখন তখন সমস্ত বাধা বন্ধনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যৌবনের লীলাও হচ্ছে বৃষ্টির মতো। শৈশব এবং কৈশোরে আমরা ভেসে চলি ¯্রােতবাহী নদীর মতো। কিন্তু যৌবনে বৃষ্টির প্রতাপে অধীর হই এবং কম্পমান হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করি আমি কে? আমি কোথায়? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই আকুল জিজ্ঞাসায় প্রাণের একটি স্পন্দন অনুভব করা যায়।
মানুষ যৌবনকে কখন কখন কিভাবে আবিষ্কার করে, বলা কঠিন। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করে আমার মনে হচ্ছে আমি বৃষ্টির মধ্যে যৌবনকে অনুভব করেছি। অতীতের অনুভূতিগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে গিয়ে এভাবেই যৌবনকে বারবার বোঝবার চেষ্টা করেছি। বৃষ্টি হঠাৎ নামে, আবার হঠাৎ চলে যায়। সর্বক্ষণ বৃষ্টির ধারাপ্রবাহ থাকে না। নদী যেমন সতত সঞ্চরমান, বৃষ্টি তেমন নয়। বৃষ্টি যখন আসে সবকিছুকে আলোড়িত করে আসে। আবার যখন চলে যায় তখন তার ধারাপ্রবাহের চিহ্ন থাকে না। সে একই সঙ্গে অসম্ভারে নায়ক এবং বিস্ময়ের প্রাণদ প্রবাহ। যৌবনকালে মানুষের শরীর কেমন যেন আকুল হয়। কি যেন সে চায়। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে সে জানে না সে কি চায়। সে এলোমেলো হতে চায়, সে উৎক্ষিপ্ত হতে চায়। সে সবকিছুকে ভেঙ্গে ফেলতে চায় আবার কখনো প্রবল হতাশায় আক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু এটা সে অনুভব করে যে তার সমস্ত শরীর নতুন রক্ত¯্রােতে উষ্ণ হয়েছে এবং সকল বস্তুকে নতুন করে দেখবার সে দৃষ্টি পেয়েছে। স্কুল জীবনে যা শুধু কৌতূহল ছিল পরবর্তীতে সে কৌতুহলের গভীরে প্রবেশ করবার আগ্রহে জন্মেছিল। জুবাইদা নূর খান- কথা ছিল ঝুম বৃষ্টি হবে কাব্যগ্রন্থে বলেছেন-
কথা ছিল ঝুম বৃষ্টি হবে।
বিছানায় শুয়ে অলস দুপুর কাটাবো।
জানলার ফাঁকা দিয়ে গাছের দোল খাওয়া দেখবো।
বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে মেখে পাতারা কেমন শিহরিত হয়,
তা দেখবো দুচোখ ভরে।
সবুজাভ খয়েরি টুনটুনিটা হঠাৎ করেই
বারান্দার গ্রিলে এসে আশ্রয় নেবে।
ভাববে ওর আশেপাশে বুঝি কেউ নেই।
তাই তো তার মতো করে বৃষ্টির কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে
কতো কী টুইটুই করে বলতে থাকবে।
চোখ বুজে আমিও আওড়াতে থাকবো ধূসর গোধুলি বেলার কতো কী !
সূতা কেটে যাওয়া বিচ্ছেদের নীল ঘুড়ি।
ধূসর বকের পাখনায় ভর করে ভেসে বেড়ানো
সেইসব ভালোবাসার অর্থহীন প্রলাপ।
অথবা, কদম ফুল হাতে বৃষ্টিতে ভেজা সেইসব গাঢ় আলিঙ্গন।
বৃষ্টি দেখে রমণীর যৌবনকে অনুভব করেছিলেন চ-ীদাস। বৃষ্টিসিক্ত শরীরে রাধিকা যখন নীল শাড়ি পরে শরীর সঞ্চালিত করে এগিয়ে যাচ্ছে তার কি অপরূপ বর্ণনা। চ-ীদাস বলছেন, নীল শাড়ি বেয়ে পানি যেমন চুইয়ে পড়ে তেমনি আমার হৃদয় থেকে কামনা বিগলিত হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে যৌবনবতী রমণী শরীর দেখে যে অপূর্ব আনন্দ জাগে একটু বড় হয়ে তা অনুভব করেছি। রমণী শরীরে একটি আন্দোলন আছে, একটি তরঙ্গিত প্রসাদ আছে, যৌবনকালে তা দৃষ্টিকে প্লাবিত করে। আমি আমার গৃহের রমণীকুলকে আত্মীয় পরিচয়ে চিনতাম রমণী পরিচয়ে নয়। কিন্তু অপরিচিতা যুবতী রমণীকে দৃষ্টির মধ্যে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিল এখানেই আমার আকাক্ষিত ঐশ্বর্য। যৌবনের ঔদার্য নিয়ে একটি শরীরী চৈতন্য এগিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক জানি না।
কিন্তু মনে হত একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে আমি সম্পূর্ণ হবো না। প্লেটো তার একটি সংলাপে বলছেন, পুরুষ এবং রমণী এক সময় এক সত্তা ছিল, পরে দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং বিভক্তির পর অনবরত আকুলতা এবং আর্তি নিয়ে একে অন্যকে পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। প্লেটো অবশ্য কথাগুলো পরিহাস করে বলেছিলেন। কিন্তু বিধাতার সৃষ্টিরহস্যের গল্পও তো এমনি! তিনি প্রথম আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। পরে আদমের পাঁজরের একটি হাড় নিয়ে ইভ বা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন। আদম তাঁর অস্থিখ-ের দাবীদার, তাই সে অনন্তকাল ধরে প্রত্যাশায় হাওয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে থাকে এবং শিহরণের সাগ্রহে হাওয়া আদমের দিকে কৌতূহলে এগিয়ে আসে। পল এন্যুয়ার রমণীকে ‘বরাট চলিষ্ণু হাহাকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রমণীর চলিষ্ণু শরীর পুরুষের চিত্তে হাহাকার তোলে, আর্তরোল তোলে, কামনার নতুন কম্পমানতা তোলে। যুবতী রমণীর কেশগুচ্ছ থেকে পদাঙ্গুলি পর্যন্ত একটি কম্পমান শিহরণের মতো একজন পুরুষ তার যৌবনকে আবিষ্কার করে, সে একাকী সম্পূর্ণ নয় তার অনুভূতিও নিঃসঙ্গ নয়। একটি আসঙ্গের কল্পনা নির্মাণ করে সে তার যৌবনকে অনুভব করে।
যৌবনে ফুলকে আমরা নতুন দৃষ্টিতে দেখি। আমাদের বাড়িতে গোলাপ ফুলের গাছ ছিল অনেকগুলো। হঠাৎ একদিনে লাল গোলাপগুলো আমাকে চমকিত করলো। তখন সূর্য ডুবছে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়েছে, লাল কৃষ্ণচূড়ায় পথে পথে শোভা নেমেছে। ঠিক সেই সময় বাতাসের দোলায় গোলাপের সবুজ ডালে লাল গোলাপ ফুলগুলো আমাকে আকুল করেছিল। আমি অনেকক্ষণ গোলাপের গাছগুলোর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। স্নায়ুতে যে রক্ত প্রবাহিত হয় তার রক্তিমাভা অনুভব করা যায়। গোলাপ ফুল দেখে সেদিন আমার স্নায়ু চঞ্চল হয়েছিল। আমি বিপুল অধীরতায় একটা কিছুকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে একটা কিছু যে কি, তা তখন জানতে পারি নি। গ্রীক দেবতা এপোলো কবিতা এবং ঔষধের দেবতা। মানুষের জীবনে ঔষধের প্রয়োজন আছে। কামনার নিপীড়ন মানুষকে ঔষধের জন্য আকুল করে। এপোলো সে ঔষধ এনে দেন কবিতার ব্যঞ্জনায়। তাই বোধ হয় যৌবনের উন্মেষ মানুষকে প্রথম কবি করে।
বৃষ্টির অবিরল ধারা দেখে মনে হত, এর শেষ নেই, আরম্ভও নেই। একটি অনাদি অশান্ত ধারাপ্রবাহ সমগ্র জীবনকে সিক্ত করছে। যৌবন উন্মেষের লগ্নে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করতো। ইচ্ছে হত সর্ব আবরণমুক্ত হয়ে নিজেকে বৃষ্টির সঙ্গে মিশিয়ে দেই। মধ্যযুগের কবিরা বলেন যে চাতকের মতো প্রেমিক হতে হয়, প্রত্যাশী হতে হয়। চাতক বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করে এবং সে পানি পান করে যৌবনময় হয়। চতুর্দিকে অথই পানি থাকলেও চাতক সে পানিতে ওষ্ঠ স্পর্শ করবে না, সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে একবিন্দু বৃষ্টির নির্যাসের জন্য। মধ্যযুগের কবিরা আরো বলেছেন, বর্ষাকাল যখন আসে, বৃষ্টি যখন শব্দ করে নামে, তখন কল্যাণী রমণী প্রিয় প্রত্যাশায় হস্ত প্রসারণ করে, কিন্তু কোথাও কাউকে না পেয়ে বিপুল হাহাকারে আর্তনাদ করে। বর্ষার বিরহবেদনা অসহনীয়। কেননা, বর্ষা আগমনের সংকেত দেয়, প্রত্যাশার অভিপ্রায় চিত্তে জাগায়। সে মুহূর্তে প্রত্যাশার পাত্রকে না পেয়ে হৃদয় অস্থির হয়। আমি এতটা বুঝতাম, কিন্তু এটা বুঝতাম যে বৃষ্টির প্রবাহ আমার জন্য নতুন জীবনের কথা বলছে।

যদি জিজ্ঞেস করা হয় মহৎ কবিতা কি? তাহলে তার উত্তরে আমরা বলব, যে কবিতা পাঠকের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে তার স্মৃতিকে ভাস্কর থাকে, সুরের ঝংকার অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভাসতে থাকে এবং সে ফিরে আসে কবিতাটির কাছে বারবার-তাহলেই সে কবিতাটি মহৎ কবিতা।
একজন কবি নিজে যা উপলব্ধি করেন তা অন্যের উপলব্ধিতে আনতে চান। যেমন-আনন্দ কাকে বলে, আশা কাকে বলে, সৌন্দর্য কাকে বলে, ন্যায় এবং সত্য কাকে বলে এগুলোর উত্তর মহৎ কবিরা দিয়ে থাকেন। আমরা কবিদের কাছ থেকে এ সমস্ত উত্তর পেয়ে থাকি এবং উত্তরগুলো আমাদের মনকে নাড়া দেয়। ওয়াল্ট হুইটম্যান। একটি মহৎ কবিতা লিখেছিলেন যার নাম ‘খবধাবং ড়ভ এৎধংং.' এ কবিতাটিতে জীবনী শক্তির বন্দনা আছে, বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা আছে এবং অগ্রযাত্রায় অগ্রসর হওয়ার সাহসী প্রত্যয়ের কথা আছে। কবিতাটি যদিও আমেরিকার মানুষদের জন্য কিন্তু সকল দেশের মানুষদের জন্য এর একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। ইংরেজিতে ‘চৎড়ভড়ঁহফ’ বলে একটি শব্দ আছে। সমালোচকগণ হুইটম্যানের কবিতাকে ‘চৎড়ভড়ঁহফ’ বলে বর্ণনা করেছেন। আমরা বাংলাতে এটাকে বলতে পারি মহত্ত্বের দ্বারা আক্রান্ত। অথচ কবিতার ভাষাটি কত সরল ও সহজ-ঘাসের পাতার মতো সহজ সুস্পষ্ট, অথচ অনন্য সাধারণ । স্কুলে যখন পড়তাম তখন টেনিসনের একটি কবিতা পাঠ্য হিসেবে পড়তে হয়েছিল। কবিতাটির নাম যখন তারা সৈনিকটির মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে এল। ইংরেজি শিরোনাম হচ্ছে ‘ঐড়সব ঃযবু নৎড়ঁমযঃ যবৎ ধিৎৎরড়ৎ ফবধফ'। কবিতাটিতে বলা হয়েছে, যখন তার যোদ্ধার মৃতদেহেকে বাড়িতে আনা হলো, সে জ্ঞানহারা হলো না অথবা ক্রন্দনও করল না। সখিরা এই দৃশ্য অবলোকন করে বলল, তাকে কাঁদাতে হবে, তা না হলে সে মরে যাবে।' সখিরা তখন সৈনিকটির প্রশংসা করতে লাগলো এবং বলল যে, সে ছিল। ভালোবাসার উপযুক্ত পাত্র। আরও বলল, সে ছিল যথার্থ বন্ধু এবং শক্রর প্রতি আচরণেও ছিল মহৎ। এসব কথা শুনেও সৈনিকটির স্ত্রী সাড়া দিল না এবং কোনো কথা বলল না। তখন একজন সখি ধীরে ধীরে উঠে এসে মৃত সৈনিকের মুখাবরণ উন্মুক্ত করল। তার স্ত্রী এটা দেখল, কিন্তু কাঁদলো না। তখন একজন বৃদ্ধা ধাত্রী সৈনিকটির স্ত্রীর ক্রোড়ে তার শিশুপুত্রকে দিল। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বর্ষার বৃষ্টির মতো মেয়েটি কাঁদতে লাগলো এবং বলল, হে আমার পুত্র, তোমার জন্যই আমি বেঁচে থাকব।'
কবিতাটি একটি অসাধারণ কবিতা। এখানে মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবনের জয় ঘোষণা করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে অত্যন্ত অল্প কথায়। এই অল্প কথার মধ্য দিয়ে জীবনের শক্তি প্রমাণিত হয়েছে। এই কবিতাটিতে জীবনের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন কবির কাছে সন্তানের প্রতি মাতার মমতা এবং পিতার আগ্রহ অলৌকিক বলে মনে হয়। মৃত সৈনিককে যখন বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তখন সে অবস্থা বোঝার মতো ক্ষমতা তার শিশু পুত্রর হয়নি। শিশুর এই অসহায়তাকে অবলম্বন করে তার মাতা বাঁচবার প্রতিজ্ঞা করছে। জুবাইদা নূর খান লেখা হবে কবিতায় বলেছেন-
লেখা হবে লেখা, অনেক অনেক লেখা,
লেখা হবে সবকিছু, যা হয়েছে দেখা।
লেখা হবে আঙ্গুলে, লেখা হবে কালিতে,
লেখা হবে সাগরে, ঝুরঝুরে বালিতে।
লেখা হবে বাড়িতে, যানজটে গাড়িতে,
লেখা হবে তুলিতে, আটপৌরে শাড়িতে।
লেখা হবে গোলগোল, লেখা হবে সোজা,
সব লেখার কারণ! কী দরকার খোঁজা !
লেখা হবে কাগজে, লেখা হবে খাতাতে,
লেখা হবে পোস্টারে, সাদা সব পাতাতে।
লেখা হবে ব্যানারে, লেখা হবে দেয়ালে,
লেখা হবে সবকিছু, যা আছে খেয়ালে।
পড়বে লেখা দানবে, পড়বে লেখা মানুষে,
লেখা হবে সত্য সাদা, নয়কো রঙিন ফানুসে।
কোনো লেখা হাসবে, কোনো লেখা কাঁদবে,
মায়ার বাঁধনে লেখা, কখনো বা বাঁধবে।
কিছু লেখা ছিড়বে, কিছু লেখা ছাপবে,
কিছু লেখা পড়ে বুক দুরুদুরু কাঁপবে।
লেখা যাবে ফাঁসিতে, লেখা যাবে কারাতে
লেখা পড়ে হইচই শুরু হবে পাড়াতে।
চলবে তবু লেখালেখি, লেখা নিয়ে ছোড়াছুড়ি
লেখার পিঠে জুড়বে লেখা, দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি।
একজন কবি সাধারণ মানুষের চিত্তের অন্তর্গূঢ় রহস্য যেভাবে উদ্ঘাটন করেন অন্য কেউ তা করতে পারে না। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘কবর’ কবিতাটিতে গ্রামের একজন সাধারণ বৃদ্ধের মর্মবেদনাকে যেভাবে উদ্ঘাটন করেছেন তার তুলনা হয় না। বৃদ্ধের স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, পুত্রবধূ নেই, একমাত্র একটি দৌহিত্র রয়েছে। দৌহিত্রকে বৃদ্ধ তার জীবনের ইতিহাস বলছে। বৃদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় আমরা অভিভূত হই এবং একটি করণ বেদনাকে নিজেদের বেদনা বলে মনে করি। ইংরেজীতে হাম্বল’ বলতে যে অর্থটি বোঝায় এই বৃদ্ধটি সেরকমই অতি সাধারণ এবং সকরণ। আমাদের বাংলা কাব্যের বিস্মৃত ধারাক্রমের মধ্যে এটি একটি অনন্যসাধারণ কবিতা। যে বৃদ্ধের কাহিনী এখানে বর্ণিত আছে সেই বৃদ্ধের দরিদ্র দশা আমরা বুঝতে পারি, সে যে ধনী হবার কোনো সুযোগ পায়নি তাও আমরা বুঝতে পারি। এই অসহায় বঞ্চিত ব্যক্তির অবলম্বন ছিল শুধুমাত্র তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূ। এরাই যখন চলে গেল তখন বেঁচে থাকবার কোনো উপায়ই তার রইলোনা। শুধুমাত্র দৌহিত্রকে আঁকড়ে ধরে কবরগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে সে সান্ত¡না খুঁজছে। আমি গ্রে-র ইলিজি’র কথা বলেছি। সেখানেও গ্রে দরিদ্র এবং অসহায় মানুষগুলোর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ মহত্ত্বের উপকরণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সুযোগের অভাবে অনেকের মহত্ত্বের বিকাশ ঘটে না। গ্রে-র কবিতাটি এবং একই সঙ্গে জসীমউদ্দিনের কবিতাটি-কবিতা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন বেঁচে থাকবে।
রবার্ট ফ্রস্টের নাম আমরা জানি। অতি সাধারণ কথায় অসাধারণকে তিনি প্রকাশ করতে পারতেন। তাঁর একটি অনন্যসাধারণ কবিতা হচ্ছে যে পথ আমি নেই নি ‘ঞযব ৎড়ধফ হড়ঃ ঃধশবহ'। কবিতাটিতে বলা হয়েছে, একটি হলুদ বনভূমির মধ্য দিয়ে দুটি পথ গিয়েছিল। একসঙ্গে দুটি পথ আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভবপর ছিল না। একটি পথ আগাছায় পরিপূর্ণ ছিল, অস্পষ্ট ছিল, অন্য একটি পথ ছিল পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত। আমি ভালো পথটি অন্য কোনো সময়ের জন্য রেখে দিয়ে অসুবিধার পথে পা বাড়ালাম। সন্দেহ হলো আর কখনও ফিরে আসতে পারব কি। বিশ্বাস , যে পথ দিয়ে কেউ যায় না, সে পথ দিয়ে গিয়েই আমার যত কিছু পরিবর্তন।
ফ্রস্টের ভাষায়ঃ ঃড়ড়শ ঃযব ড়হব ষবংং ঃৎধাবষষবফ নু. অহফ ঃযধঃ যধং সধফব ধষষ ঃযব ফরভভবৎবহপব এই কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ সম্পদ। যে পথ দিয়ে সবাই যায় সে পথ দিয়ে যাওয়া সহজ, কিন্তু সে পথ মানুষকে কীর্তির শিখরে নেয় না। কীর্তির শিখরে পৌঁছতে হলে বিপদের মধ্য দিয়েই যেতে হয় এবং বিপদের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলে যে বিজয় আসে তার কোনো তুলনা নেই। কবি কীটসের একটি কবিতায় আছে যে, পৃথিবীর কবিতা কখনও হারিয়ে যায় না। তিনি সে কবিতাটিতে অল্প কথায় বুঝিয়েছেন যে, সুর-ঝংকার পৃথিবীর সর্বত্রই আছে তাকে শুধু খুঁজে পেতে হয়। ফ্রস্টের সঙ্গে কীটসের তুলনা করা চলে। এঁরা দুজনই অসাধারণকে সহজ শব্দে প্রকাশ করেছেন।
পৃথিবীতে সকল মহৎ কাব্যই বিশ্বাসের কাব্য। অবিশ্বাস নিয়ে কখনও কাব্য রচনা করা যায় না। অতীতেও কখনও যায়নি। যারা অবিশ্বাসের কথা বলেন তারাও বিশ্বাসের কাব্য পাঠ করে স্বস্তি পান এবং আনন্দবোধ করেন। বিশ্বাসের দ্বারা অস্তিত্বের সচেতনতা প্রমাণ হয় এবং বিশ্বাসই অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে। কবি কীটস তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন, 'যখন আমার মনের মধ্যে ভয় জাগে যে আমার সব কথা লেখার আগেই আমি হয়তো পৃথিবী থেকে চলে যাব, যখন রাত্রির তারকাখচিত আকাশে আমি প্রণয়ের অভিযান দেখি তখন ভাবি আমি হয়তো একদিন এর কিছুই দেখতে পাব না, তখন মনে হয় এ বিরাট পৃথিবীতে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি এবং প্রেম ও প্রশংসা একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।' কীটস এ কবিতায় বলতে চেয়েছেন যে, মানুষ থাকে না, কিন্তু সৌন্দর্য ও প্রেম সুনিশ্চয়ভাবে থাকে। তিনি অবশ্য মৃত্যুর কথা বলেছেন এবং বলেছেন যে, মৃত্যুর কারণে তিনি সবকিছু হারিয়ে ফেলবেন। এ কথার মধ্যে বেদনা আছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ বিশ্বাসের পরিচয় আছে যে, প্রেম ও সৌন্দর্য চিরকালের জন্যই থাকবে। অন্য একটি কবিতায় তিনি বলেছেন, পৃথিবীর কবিতা কখনই মরে যায় না।' জন মিল্টন সম্পর্কে উইলিয়াম ব্লেক একটি কবিতায় বলেছেন, আমি আমার মনোজগতে ভ্রমণ করব অনন্তের পথে, আমার তরবারি কখনও আমার হাতে ঘুমিয়ে পড়বে না। আমি নতুন জেরুজালেম গঠন করব ইংল্যান্ডের সবুজ ও মধুর প্রান্তরে। এখানে বিশ্বাসের একটি অসাধারণ পরিচিতি উপস্থিত করা হয়েছে।
বাংলা কবিতার জগতে দীর্ঘকাল আমরা কবিতার শব্দ ব্যবহার এবং তার নির্মাণ কৌশল নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সেই ব্যস্ততার মধ্যে আমরা জীবনানন্দ দাশ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামছুল হককে পেয়েছিলাম। জুবাইদা নূর খানের মধ্যে আমরা কাব্যকলার নতুন স্পন্দন পেলাম। এটাকে আধুনিক না বলে বলতে হয় চিন্তার উচ্চারণগত অভিব্যক্তি। আধুনিক কাব্যে এটা সর্বাংশে নতুন। তাঁর কণ্ঠস্বরের নিশ্চয়তায় আমরা আরও অনেক দিন বাস করব।
কথা ছিল ঝুম বৃষ্টি হবে... জুবাইদা নূর খান ॥ প্রথম প্রকাশ একুশে বই মেলা-২০২৪, প্রকাশক মেঘদূত, প্রচ্ছদ- মোস্তাফিজ কারিগর, পৃষ্ঠা- ৬৪, মূল্য- ২৫০ টাকা।













সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা সিটির ‘বঞ্চিত’ অপসারিত কাউন্সিলরদের পুনর্বহালের দাবি
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
ধর্মপুর-সাতরার রাস্তার সংস্কার কাজ উদ্বোধন করেন জামায়াতের কুমিল্লা মহানগর সেক্রেটারি অধ্যাপক এমদাদুল হক মামুন
বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ ঢুকে পরার চেষ্টা, বাধা
কুমিল্লা নগরীর ২৭ হাজার কিশোরী পাবে বিনামূল্যে এইচপিভি টিকা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানববন্ধন
সুমি জুয়েলার্সের ২৭তম বর্ষপূর্তি উদযাপন
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
বুড়িচংয়ের আলোচিত আদনান হায়দারসহ গ্রেপ্তার ২
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২