অর্থনীতিবিদ
জেফরি হিল তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘এন্ডেনজারড ইকোনমিজ’এ দেখিয়েছেন জলবায়ুর
আরও অবনতি ঠেকাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পরিস্থিতি
কোন পর্যায়ে। জেফরি হিল সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন, প্রকৃতিজাত পৃথিবীর যে
ক্ষতি আমরা করছিÑ অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংস করছি এর প্রভাব অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব শুধু বাতাস ও পানির উপর পড়ছে না,
আমাদের ব্যবসার উপরও পড়ছে। কারণ এসব ব্যবসা নির্ভর করে প্রাকৃতিক সুবিধা
যেমনÑ পরগায়ন, পানির চক্র, সামুদ্রিক ও বনবাস্তু ব্যবস্থা ও অন্যান্য
সুবিধার উপর। ফলে ‘প্রাকৃতিক পুঁজি’ সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা ব্যবসাখাতে
পুঁজির মুনাফার হার বাড়াতে পারি। সবক্ষেত্রে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির
আকাঙ্খা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। কারণ এতে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পুঁজি ফুরিয়ে
যাচ্ছে। মানুষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চায়। কিন্তু সেটা ‘সবুজ’ পরিবেশের ক্ষতি
বা ধ্বংস সাধন করে নয়। একই সঙ্গে আমরা পরিবেশের উন্নতি চাই। কিন্তু সেটা
উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যতিত নয়।
টিকে থাকতে হলে মানবজাতিকে
অবশ্যই বায়ুমন্ডলে জমা হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করতে হবে। এটাও
নিশ্চিত করতে হবে, যেন কার্বন বায়ুমন্ডলের বাইরে থাকে। এর খরচ মেটাতে অনেক
অর্থনীতিবিদ একটি বাজারের প্রস্তাব করেছেন। সেখানে ধারণকৃত কার্বন
বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিক্রি করা হবে। আরেকটি সম্ভাব্য সমাধান হল
‘সঞ্জীবনী কৃষি’ যা জীব বিজ্ঞানীরা সামান্য হলেও চালু করেছেন। যদি লাভজনক
করা যায়, তাহলে এসব উদ্ভাবন বেসরকারি খাতে কার্বন ধারণে প্রনোদনা সৃষ্টি
করতে পারে। এর পরিধি যেকোন জাতীয় সরকারের চেয়ে বেশি হতে পারে। তবে সফলতা
নির্ভর করবে ক্রমবর্ধমান যোগান এবং দাম পড়ে যাওয়ার সময়ও ‘কার্বন ফার্মিং’
লাভজনক থাকছে কিনা তার উপর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শিল্পায়ন ও দূর্বল
শাসনব্যবস্থার মতো মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলোর উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন নিশ্চিত
করার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যে কেউ হয়ত জলবায়ু পরিবর্তন
বিষয়ক বহু গবেষণার দিকে তাকিয়ে বলতে পারে যে আমরা এবার আয়েশ করতে পারি। কি
করতে হবে, তা বিশেষজ্ঞরা আবার এত অপরিপক্ক নন, তাঁরা জানেন ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে না। তাঁরা এও জানেন, পুরো
বিষয়টা নির্ভর করবে সামাজিক কল্যাণকে মুনাফার লক্ষ্যে ব্যবহার করা যাবে
কিনা। তার উপর সমস্যা হল, অনেক মানুষ ধরে নেয় যে আমাদের ব্যবসা বানিজ্য ও
পরিবারের নীতিনির্ধারকেরা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করবে। যেমন সব
কোম্পানি তাদের কৃতকর্মের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য সামাজিক চাপে বা
রাষ্ট্রের হুমাকিতে ক্ষতিপূরণ দেবে। আবার যেমন ধরে নেয় যে সব সরকার কার্বন
নির্গমন কমাতে এবং ধীরে ধীরে নির্মূল করতে কার্বন কর বা ক্যাপ এন্ড ট্রেড
ব্যবহার প্রবর্তন করবে।
আসল কথা হল, জলবায়ু ইতিমধ্যে খুব খারাপ অবস্থায়
চলে গেছে। এটা সমাজের জন্য যেমন ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে, জীবনের জন্যও মারাত্মক
হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যারিবিয়ায় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে হারিকেনের
সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ^জুড়ে বাতাসের গুণাগুণ উল্লেখযোগ্যভাবে নষ্ট হয়ে
গেছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি নি¤œাঞ্চলের অনেক শহরের জন্য
হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও একটি সমস্যা হলো, অনেক দেশ এখনো শিল্পায়নের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ধরে নিলাম দুনিয়ার সব দেশে হয়ত দূষণের মাথাপিছু হার
কমাবে। কিন্তু বিশে^র যেসব দেশ শিল্পায়নের পর্যায়ে রয়েছে এবং তাদের চলমান
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাত যেভাবে চলছে, তা আবার বৈশি^ক দূষণের গড় বাড়িয়ে
দেবে। কার্বন নির্গমন সীমিত করতে জেফরি হিলের প্রস্তাবিত পদক্ষেপ অনুসরণ
করতে চাইলে জনসংখ্যাগত এই স্পষ্টতই কঠিন অবস্থা তৈরি করবে। আমাদের আরেকটি
সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। আর তা হলো, সব সরকারই নিজস্ব স্বার্থের উর্ধ্বে
উঠতে পারে না। শক্তিশালী কোম্পানীগুলো সরকারের গৃহীত পরিবেশগত
বাধ্যবাধকতাগুলো লঙ্ঘন করতে পারে। বিশেষ করে তারা যদি হয় আয় ও চাকরির
প্রধান উৎস।
সর্বশেষে, ভবিষ্যতে মজুরী ও কর্মসংস্থানে নবায়নযোগ্য
জ¦ালানি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ¦ালানি
কর্তৃপক্ষের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বায়ু ও সৌরশিল্পে ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৭৭
হাজার লোক নিয়োগ পেয়েছে। আবার কয়লাশিল্পে কর্মসংস্থান ক্রমাগত কমছে। কিন্তু
পর্যবেক্ষণ হিসাবে এটা কার্যকর নয়। কারণ, নতুন শিল্পে যেসব কর্মী আসছেন,
তাঁরা বিরাট বেকার জনগোষ্ঠী থেকে আসছেন না। বরং তাঁরা উচ্চপদের কর্মী।
প্রতিটি নতুন শিল্পে সার্বিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে Ñএটা ভাবা বোকামি।
তবে এ ব্যাপারে বলার জন্য নবায়নযোগ্য জ¦ালানি খাতের উপাত্ত দেখতে হবে। তবে এ
শিল্প যদি কালক্রমে পুঁজিনির্ভর হয়ে ওঠে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই।
দুঃশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, স্থিতিশীলতার নামে অনেক দেশের অর্থনীতি এর মধ্যে
যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত। সবুজ অর্থনীতির নামে এগুলো আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত হবে।
তবে অনেক নিয়ন্ত্রণই প্রয়োজনীয়। কিন্তু পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টায় আমাদের
সক্রিয় সচেতনার মাত্রা এমনি বাড়াতে হবে যেন আমরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ
উৎসগুলো ধ্বংসযজ্ঞে মেতে না উঠি। (সংগৃহিত)
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ